সাত বছরেও বিচার মেলেনি রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির

|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||

শ্রমিক হত্যার নৃশংস নজির হয়ে আছে রানা প্লাজা ধস। আজ থেকে সাত বছর আগে ২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল ঘটেছিল দেশের ইতিহাসে সবচাইতে ভয়াবহ এই শিল্প দুর্ঘটনা। এতে মারা যান ১ হাজার ১৩৬ জন। গুরুতর আহত হয়ে পঙ্গু হয়ে জীবন টেনে নেওয়া শ্রমিকের সংখ্যা ১ হাজার ১৬৯ জন।

এ ঘটনায় মোট তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে অবহেলাজনিত মৃত্যু চিহ্নিত হত্যা মামলাটি করে পুলিশ। ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন করে ভবন নির্মাণের অভিযোগে অপর মামলাটি করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। আর ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে আরেকটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলাগুলোর কোনটিরই তেমন কোন অগ্রগতি নেই। 

পুলিশের দায়ের করা হত্যা মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ এনে বিচার শুরুর আদেশ দেন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালত। সেও আজ থেকে চার বছর আগের কথা। এই মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ শুধু তিনজন রয়েছেন কারাগারে। বাকি সবাই জামিনে মুক্ত অথবা পালিয়ে রয়েছেন। অনেক অভিযুক্তই আদালতে গেছেন অভিযোগ গঠনের পুনর্বিবেচনার জন্য।

মামলার দুজন অভিযোগপত্রভুক্ত আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় বর্তমানে মামলার সাক্ষ্য গ্রহণও বন্ধ রয়েছে। কবে নাগাদ এই সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম শুরু হবে, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ জানাতে পারেননি ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের প্রধান আইন কর্মকর্তা সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) খোন্দকার আবদুল মান্নান।

বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘রানা প্লাজা ধসের ঘটনার হত্যা মামলায় দুজন আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ বহাল থাকার কারণে সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ রয়েছে। আমরা আশা করছি, চলতি বছরের মধ্যে ওই দুই আসামির পক্ষে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করা হবে এবং মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ কার্যক্রম শুরু হবে।’

পিপি আবদুল মান্নান জানান, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে তাঁদের (পিপি) পক্ষে কিছু করার থাকে না। বরং অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের দায়িত্বপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তারা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আইনি পদক্ষেপ নেবেন। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বৃহস্পতিবার জানান, সুপ্রিম কোর্ট খোলার পরপরই রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় করা হত্যার মামলায় দুই আসামির পক্ষে থাকা স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন।

অবশ্য রানা প্লাজা ধসের ঘটনার সাত বছরের মাথায় বিচার শেষ না হওয়ার পেছনে রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটির নির্বাহী পরিচালক কল্পনা আক্তার। তিনি বলেন, ‘সাভারের রানা প্লাজা ধসে ১ হাজার ১৩৬ জন মারা গেলেন। ঘটনার সাত বছর পূর্ণ হচ্ছে। অথচ আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের বিচার মোটেও এগোয়নি। কয়েক বছর ধরে একই কথা শুনে আসছি। স্থগিতাদেশে সাক্ষ্য গ্রহণ বন্ধ। আমরা মনে করি, রাষ্ট্রপক্ষের আন্তরিকতার অভাব রয়েছে। যে কারণে এই মামলার বিচার এগোচ্ছে না।’

এদিকে শ্রম আদালতের মামলাগুলোর কোন ধরনের কার্যক্রমই শুরু হয়নি। অগ্রগতি নেই দুদক ও রাজউকের করা মামলারও। বাংলাদেশে গার্মেন্টস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সভাপতি বাবুল আক্তার বলেছেন, বিচারে বিলম্ব শ্রমিকদের মধ্যে হতাশার জন্ম দিচ্ছে। “বিচার বিভাগ ইচ্ছে করলেই দ্রুত এর বিচার করতে পারতো। বিচার যদি হয়ে যায় তখন কারখানার মালিক শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে এবং তারা ভাববে সেটা যদি তারা না করে তাহলে তাদেরও বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে। তাতে তারা আইনও মেনে চলবে এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভাবে কারখানা চালাবে না,” বলেন তিনি।

২০১৩ সালের ২৪শে এপ্রিল সকালে সাভার বাস স্ট্যান্ডের কাছে রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় সব মিলিয়ে রয়েছে ১৪টি মামলা। অবহেলা-জনিত মৃত্যুর অভিযোগে পুলিশের মামলা, রাজউকের করা ইমারত নির্মাণ আইন লঙ্ঘন এবং নিহত একজন পোশাক শ্রমিকের স্ত্রীর দায়ের করা খুনের মামলা। এসব মামলার দিকে নজর রাখছে বাংলাদেশে লিগাল এইড অ্যন্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট। সংস্থাটির আইন শাখার উপপরিচালক মো. বরকত আলী বলছেন, এসব মামলার কার্যক্রম কার্যত স্থবির হয়েই রয়েছে।

বরকত আলী বলেন, “হত্যা মামলাসহ যে মামলায় অভিযোগ গঠন হয়েছে সেগুলোর শুনানি এখনো শুরু হয়নি। বেশ কটি তারিখ ছিলো শুনানির কিন্তু সাক্ষীর অভাবে শুনানি শুরু হয়নি।” তিনি আরো বলেন, “তিনটি মামলায় অভিযোগ গঠনের বিরুদ্ধে অভিযুক্তরা রিভিশনের জন্য আদালতে গেছেন।”

অন্যদিকে, দায়িত্ব পালনে অবহেলা, শ্রমিকদের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থতা বা সরকারি কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে ব্যর্থতাসহ বেশ কটি অভিযোগে শ্রম আদালতে মামলা রয়েছে ১১ টি। সেগুলোর এখনো পর্যন্ত অভিযোগ গঠনের কোনো শুনানিই হয়নি।

মো. বরকত আলী বলেছেন, “আমরা আশা করেছিলাম যে এই ধরনের বিশেষ একটি ঘটনার মামলা হয়তো বিশেষ নজর পাবে বা বিশেষ গতিতে চলবে। দুর্ভাগ্য হলো সেটা হচ্ছে না। যেমন শ্রম আইনের ১১টি মামলার বেশির ভাগেরই অভিযোগ গঠনের শুনানি হয়নি। অর্থাৎ মামলার কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুই হয়নি।”

স্মরণ সহকর্মী-স্বজনদের, বিচার না পাওয়ায় ক্ষোভ

এমন পরিস্থিতিতে রানা প্লাজার সাবেক শ্রমিক, নিহতদের আত্মীয় স্বজন এবং বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সাভারের সেই দুর্ঘটনাস্থলে এসেছিলেন তাদের স্বজন ও সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। রানা প্লাজা যে জায়গাটিতে ছিলো সেই জায়গাটিতে অনেক আগে থেকেই পানি জমে পুকুরের মতো হয়ে গেছে। কচুরিপানায় ঢেকে যাওয়া সেই পুকুরে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। সকাল থেকেই ছিলো মুষল ধারায় বৃষ্টি। তার মাঝেই দাঁড়িয়ে চোখের অশ্রু ফেলছিলেন অনেকেই।

যারা এসেছিলেন তাদের সবার মুখেই ছিল ক্ষতিপূরণ আর এই ঘটনার বিচারে দীর্ঘসূত্রিতা নিয়ে ক্ষোভ। নিউ ওয়েভ স্টাইলস-এ কাজ করতেন নিলুফার ইয়াসমিন। তিনি বলছেন, “এখন আমরা যেভাবে বেঁচে আছি তার চেয়ে মরে যাওয়াও ভাল ছিলো।” ক্রাচে ভর দিয়ে এসেছেন মাহমুদ হাসান। তিনি আক্ষেপ করে বলছিলেন, “অনুদান হিসেবে আমাদের নাম মাত্র ভিক্ষা দেয়া হয়েছে। আর এত লোক মারা গেলো তাতে দোষী যেসব আসামী ছিলো তার মধ্যে তিনজন এখন শুধু জেলে। আর সবাই বাইরে। আমরা কি কোনদিন বিচার পাবো?”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন