|| মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু ||
ভোট গণনার সময় যখন ডনাল্ড ট্রাম্প ‘কারচুপি’ নিয়ে অনেক চিল্লাপাল্লা করছিলেন তখন আমার এক মার্কিনপ্রবাসী আত্মীয় ফোনে বললেন, ট্রাম্প তো আউটসাইডার, পলিটিসিয়ান না, সিনেট বা হাউজে কখনো ছিলেন না, তাই এমন উল্টাপাল্টা করছেন। আরেক প্রবাসী বন্ধু একদিন বললেন, ওঁর কিছু মেন্টাল প্রবলেম আছে।
আরেকজন বললেন, হীনম্মন্যতা আছে তাই চেঁচামেচি করে নিজের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান।
আমি এঁদের বলি, এত বড় সমস্যা এসব হালকা কারণ দিয়ে বোঝার চেষ্টা ঠিক না।
তাঁদের প্রশ্ন, তাহলে কী?
আমি বলি, একা ট্রাম্পের ব্যাপার না। যা ঘটছে তা পুঁজিবাদী-সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার সংকট, তা থেকে মার্কিন শাসক-শোষক শ্রেণীর অভ্যন্তরীণ সংকটের বহিঃপ্রকাশ। তারা সংকটের সমাধান দিতে অক্ষম। সংকট তীব্র হলে তারা জনগণকে বিভক্ত করে ও যুদ্ধ বাধিয়ে সাময়িক পরিত্রাণ খোঁজে। সে-রকম একটা পরিস্থিতির সূচনা আমরা দেখছি।
সঙ্গে সঙ্গেই আক্রমণ, আপনারা শুধু থিওরি কপচান।
আমি বলি, বাস্তব থেকেই তো থিওরি আসে। আর দেখুন থিওরির সত্যতা বাস্তবে পেতে পারেন।
তাঁরা কেউ বলেন, বাইডেন এলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
ফেসবুকেও দেখছি এ-রকম কথা অনেকে বলছেন। তাঁদের চোখে ট্রাম্প গণ্ডগোল করেছেন। তিনি হেরে গেছেন। নতুন প্রেসিডেন্ট আসায় আমেরিকা আবার আগের মতোই চলবে। আমি বলতে চাই, এটা খুব সরল বিশ্বাস হবে। ঐতিহাসিকভাবে আমরা দেখি, রিপাবলিকান ও ডেমোক্রেটিক পার্টির মধ্যে মূলগত পার্থক্য খুব সামান্য। শাসক-শোষকদেরই দুই দল। লক্ষ্যে ভিন্নতা নাই, কৌশলগত দৃষ্টিভঙ্গীতে পার্থক্য। শোষণের ধারাবাহিকতায়, আমেরিকানরাই বলে যে, সম্পদের ভাগাভাগি হয়েছে ১% ও ৯৯%। এক শতাংশ মানুষের হাতে ৯৯% সম্পদ। আর নিরানব্বই ভাগ মানুষের ভাগ্যে ১% সম্পদ। অঙ্কের এই প্রকাশভঙ্গী অতিরঞ্জিত হতে পারে তবে ধনবৈষম্য অবশ্যই অতিশয় প্রকট। আমরা সাম্প্রতিক দশকগুলোতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সময় গ্লোবালাইজেশন-বিরোধী, কর্পোরেট-বিরোধী, ওয়াল স্ট্রিট-বিরোধী অনেক আন্দোলন দেখেছি। এগুলোর আওয়াজ বৈষম্য-বিরোধী। আমেরিকার শাসকশ্রেণী ও তাদের দুটো দল এ সমস্যার কোনো সমাধান করতে পারবে না। জাতীয় ও ভূ-রাজনৈতিক আরও অনেক সংকট আমেরিকার বাড়ছে। তাতে তারা বিশ্বের প্রধান শক্তির অবস্থান ধরে রাখতে পারছে না। উৎপাদিকা শক্তির সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রাধান্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে চীনের কাছে আমেরিকা ইতিমধ্যেই হেরে গেছে। আজ হোক কাল হোক, মধ্যপ্রাচ্য, এমনকি ইউরোপ থেকেও আমেরিকার সৈন্য প্রত্যাহার করতে হবে। তখন সংকট আরও বাড়বে। মন্দা মোকাবেলা, কর্মসংস্থান, নাগরিকদের স্বাস্থ্যসেবা, বৈশ্বিক পরিবেশ রক্ষায় সঠিকভাবে সাড়া দেওয়া, বর্ণবিদ্বেষ প্রভৃতিও আমেরিকান সংকটের বড় বড় দিক। ট্রাম্প যতই গলা ফাটিয়ে বলুন, Make America great again, তাঁর চার বছরের শাসনশেষে আরও পরিস্কার হয়ে ওঠে যে great নয়, বরং America is in decline. সংকটের ক্রমবিস্তারের পটভূমিতে মার্কিন শাসকশ্রেণীর ভেতরের যে অস্থিরতা তারই প্রকাশ ট্রাম্পইজম যাকে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত স্বৈরাচারী আচরণ বা পাগলামি হিসেবে অনেকে মনে করছেন। অথচ এটা এখন আমেরিকার জনগণের প্রায় দু’শ বছর ধরে গড়ে তোলা, বিশ্বে আদর্শস্থানীয় বলে মনে করা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার সংকটে পড়া অবস্থা। অন্তত এর সূচনা। সেই গণতন্ত্রের প্রতীকস্বরূপ মার্কিন কংগ্রেস ভবন ক্যাপিটল হিলে ৬ই জানুয়ারি ট্রাম্প সমর্থক উগ্র শেতাঙ্গদের তাণ্ডব যে এত তীব্র হবে তা আগের দিনও ক’জন কল্পনা করতে পেরেছিল?
ফেসবুকে আমার দুই বন্ধু মন্তব্য করেছেন যে, আমেরিকার শাসনতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলি খুবই শক্তিশালী। তাই ট্রাম্পের কার্যকলাপে আমেরিকার গণতন্ত্র বিপন্ন হবে না। প্রাতষ্ঠানিক ব্যবস্থায় সামাল দেওয়া সম্ভব হবে।
অবশ্যই মার্কিন গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির ভিত্তি অনেক মজবুত। দু’শ বছর ধরে জনগণ এগুলো ধাপে ধাপে গড়ে তুলেছে। তাতে রিপাবলিকান, ডেমোক্র্যাট ও অন্যান্য রাজনৈতিক-সামাজিক সংগঠনের নানা ভূমিকা আছে। আমরা এই নির্বাচনেও দেখেছি যে, মহামারির মধ্যেও সচেতন ভোটাররা ভোটের অধিকার প্রয়োগ করে, আগাম ভোট দিয়ে, ডাকযোগে ভোট দিয়ে ট্রাম্পের পরাজয় নিশ্চিত করেছেন নিজেদের দেশকে আরও খারাপ অবস্থায় যাওয়া থেকে বাঁচাতে। ট্রাম্পের বিপুল সমর্থন থাকায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছে। বাইডেনের ভোটাররা বেশি সংখ্যায় ভোট না দিলে বিপর্যয় ঘটতো। অন্যদিকে কারচুপির মিথ্যা অভিযোগ তুলে ভোটের ফলাফল নস্যাৎ করার ট্রাম্পপন্থীদের মরিয়া চেষ্টাগুলো– গণনা বন্ধ করা, সার্টিফিকেশন ঠেকানো, আদালতে বহুসংখ্যক মামলা– কোনোকিছুই কাজে এলো না এইসব প্রতিষ্ঠানের শাসনতান্ত্রিক দায়িত্বের প্রতি অনুগত থাকার কারণে। এটাই প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি, যা আমাদের দেশসহ অনেক দেশে নেই। সর্বশেষ কাপিটল হিলে হামলার ঘটনায় শুরুতে পুলিশি ও গোয়েন্দা দায়িত্ব পালন নিয়ে কিছু সমালোচনা থাকলেও দ্রুতই সকল সংস্থা সঠিকভাবে তৎপর হয়েছে।
এবার দেখুন। ট্রাম্প কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলিকেই আক্রমণ করেছেন। আমাদের মনে আছে শপথ গ্রহণের পর তিনি শুরুই করেছিলেন মিডিয়াকে দেশের শত্রু আখ্যায়িত করে। নতুন প্রেসিডেন্ট বাইডেনসহ অনেকেই বলেছেন যে, ট্রাম্প চার বছর ধরে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর আক্রমণ চালিয়েছেন যার পরিণতি ক্যাপিটল হাঙ্গামা।
কিন্তু কেনো?
এই কেনোর জবাবেই আমরা খুঁজে পাব মার্কিন শাসকদের ভেতরের দ্বন্দ্বের স্বরূপ। এই শাসকগোষ্ঠী ও তাদের দ্বিদলীয় গণতন্ত্রের দীর্ঘদিনের সাফল্য হচ্ছে তাদের সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব অভিযানে পরোক্ষ-প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে তারা যে ঘৃণ্য পাপগুলো করেছে– মধ্যপ্রাচ্যের তেল লুণ্ঠনের জন্য সিআইএকে (CIA – Central Intelligence Agency) দিয়ে ইরানের মোসাদ্দেক সরকারকে উৎখাত ও হোসেন ফাতেমিকে হত্যা থেকে শুরু করে এই সেদিন সাদ্দাম-গাদাফিকে হত্যা, মাঝে লুমুম্বা হত্যা, আলেন্দে হত্যা, সুকর্ণ উৎখাত, লাতিন আমেরিকায় অসংখ্য সামরিক অভ্যুত্থান, ভিয়েতনামকে নাপামে জ্বালিয়ে দেওয়া, বাংলাদেশে পাকিস্তানি গণহত্যায় মদদ, বঙ্গবন্ধু হত্যায় কিসিঞ্জারের মুচকি হাসি– এই সবই করেছে মার্কিন জনগণের সমর্থন নিয়ে। এসব পাপে রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট দুই দলেরই সমর্থন ছিল। দুই দলের বাইরে কোনো রাজনৈতিক শক্তিরই সাধ্য নাই ওই ধনাঢ্যনিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্রে গিয়ে পাত পাড়ে।
এহেন গণতন্ত্রেও এখন মার্কিন শাসকরা নিরাপদ বোধ করছে না। কিভাবে শাসন-শোষণ অব্যাহত রাখা যায় তা নিয়েই মতবিরোধ। শাসকদের একাংশ মনে করছে গণতন্ত্র সীমিত করে কর্তৃত্বমূলক শাসন চালাতে হবে। তারা অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অভিবাসীদের দায়ী করে শ্বেতাঙ্গদের খেপিয়ে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষকে “আমরা” বনাম “ওরা” বলে খুব সহজে খেপানো যায়, যাতে প্রকৃত শোষকরা আড়ালে থাকে। গত শতাব্দীর কু ক্লুক্স ক্ল্যানের মতো বর্তমানের কিউ-আনন ও প্রাইড বয়রা এখন ট্রাম্পের ক্যাপিটল আক্রমণের সৈনিক।
শাসকদলের অপর অংশ মনে করে গণতন্ত্র রক্ষা করেই শাসন চালাতে হবে। গণতন্ত্র ধ্বংস হলে পরিণামে আম-ছালা দুই-ই চলে যেতে পারে। তাই বাইডেনকে এখন আমাদের ভালো লাগছে। অবশ্যই তুলনামূলক দিক থেকে বাইডেন ভালো। ট্রাম্প বিদায় নিলেও তিনি বাইডেনের জন্য রাজনীতি কঠিন করে যাচ্ছেন, যেমন আমাদের দেশেও একজন সামরিক শাসক ঘোষণা দিয়েই রাজনীতিবিদদের জন্য রাজনীতি কঠিন করে গেছেন। তবে আমেরিকায় গণতন্ত্রের ক্ষতি হলে অন্যান্য দেশ ও আমাদেরও ক্ষতি। কারণ তাতে আমাদের মতো ছোট ছোট দেশেও অনেক “ট্রাম্প” খুশিতে লাফাতে থাকবেন। আমরা চাইবো আমেরিকার জনগণ যেন ধনিকশ্রেণীর কুক্ষিগত গণতন্ত্রের বেড়া ভেঙে ফেলে আরও উদার গণতন্ত্র গড়ে তুলতে পারে।
লেখক: সাংবাদিক