মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখীতে প্রাণ গেলো ১৩জনের

গাইবান্ধায় প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় ধরে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ঝড়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দশজনে দাঁড়িয়েছে। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গাতে ঝড়ে গাছচাপায় মারা গেছেন মা ও মেয়ে। রাজশাহীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চলতি মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী ঝড়ে আমের গুটি, বরজের পান ও ক্ষেতের ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে কালবৈশাখীর তোড়ে উড়ন্ত টিনে গলা কেটে মারা গেছে একজন।

|| বার্তা সারাবেলা ||

মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখি ঝড়ে দেশের বিভিন্নস্থানে প্রাণহানীসহ বিস্তর ক্ষতি হয়েছে জানমালের। গাইবান্ধায় প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় ধরে বয়ে যাওয়া কালবৈশাখী ঝড়ে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দশজনে দাঁড়িয়েছে। ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গাতে ঝড়ে গাছচাপায় মারা গেছেন মা ও মেয়ে। রাজশাহীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চলতি মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী ঝড়ে আমের গুটি, বরজের পান ও ক্ষেতের ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়া কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে কালবৈশাখীর তোড়ে উড়ন্ত টিনে গলা কেটে মারা গেছে একজন।

বিস্তারিত আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্যে:

গাইবান্ধায় ঝড়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ১০

রোববার বিকালে গাইবান্ধা জেলার ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ঝড়ে কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালার ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। জেলাজুড়ে বন্ধ রয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। জেলা প্রশাসক আব্দুল মতিন জানান, ঝড়ে গাইবান্ধা সদরে চারজন, পলাশবাড়ীতে তিনজন, ফুলছড়িতে দুইজন এবং সুন্দরগঞ্জে একজন মারা গেছেন। এ পর্যন্ত এই সংখ্যা দশজনে দাঁড়িয়েছে।

নিহতরা হলেন- গাইবান্ধার পলাশবাড়ী উপজেলার বেতকাপা ইউনিয়নের বাকেরপাড়া গ্রামের ইউনুছ আলীর স্ত্রী জাহানারা বেগম (৫০), একই ইউনিয়নের মোস্তফাপুর গ্রামের আব্বাস আলীর ছেলে আবদুল গোফ্ফার (৪২), গাইবান্ধা সদর উপজেলার মালিবাড়ী ইউনিয়নের ঢনঢনিপাড়া গামের মিঠু মিয়ার স্ত্রী সাহারা বেগম (৪১), সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের কিশামত হলদিয়া গ্রামের সোলায়মান আলীর স্ত্রী ময়না বেগম (৪৭), ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারি গ্রামের বিশু মিয়ার স্ত্রী শিমুলি বেগম (২৬), সদরের রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের হরিণসিংগা গ্রামের হিরু মিয়ার ছেলে মুনির (৫), একই ইউনিয়নের আরিফ খান বাসুদেবপুর গ্রামের রিজু মিয়ার স্ত্রী আর্জিনা বেগম (২৮), বাদিয়াখালী ইউনিয়নের রিফাইতপুর সরকারেরতারি গ্রামের খগেন্দ্র চন্দ্রের স্ত্রী জোৎস্না রানী (৫৫), পলাশবাড়ী উপজেলার মনোহরপুর  ইউনিয়নের কুমেদপুর গ্রামের আবদুল কাদের মিয়ার স্ত্রী মমতা বেগম (৬৪) এবং ফুলছড়ি উপজেলার এরেন্ডাবাড়ী ইউনিয়নের ডাকাতিয়ার চর গ্রামের বারেক মিয়ার ছেলে হাফিজ উদ্দিন (৬৫)।

পলাশবাড়ী উপজেলার বেতকাপা ইউনিয়নের ডাকেরপাড়া গ্রামের জাহানারা বেগম রোববার বিকেল ৩টার দিকে বাড়ি উঠানে সাংসারিক কাজ করছিলেন। হঠাৎ কালবৈশাখী ঝড়ে একটি গাছ উপড়ে পড়লে তাতে চাপা পড়ে জাহানারা ঘটনাস্থলেই মারা যান।

বেলা সাড়ে ৩টার দিকে আবদুল গোফ্ফার মোস্তফাপুর বাজার থেকে বাড়ি ফিরছিলেন। তিনি বাড়ির কাছাকাছি পৌঁছলে একটি গাছ তার ওপর উপড়ে পড়ে। এতে তিনি চাপা পড়ে ঘটনাস্থলে মারা যান বলে জানানো হয়েছে বলেন ওসি।

ধোপাডাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান গাছ চাপায় ময়না বেগমের মৃত্যুর খবর জানিয়ে বলেন, বেলা সোয়া ৩টার দিকে কিশামত হলদিয়া গ্রামের ময়না বাড়ির আঙিনায় কাজ করছিলেন। এ সময় বাড়ির একটি গাছ ভেঙে পড়লে চাপা পড়ে মারা যান তিনি।

ফুলছড়ি থানার ওসি কাওছার আলী জানান, বেলা পৌনে ৪টার দিকে ফুলছড়ি উপজেলার গজারিয়া ইউনিয়নের কাতলামারি গ্রামের বিশু মিয়ার স্ত্রী শিমুলি বেগম একইভাবে বাড়ির উঠানে কাজ করার সময় গাছ চাপায় মারা যান।

মালিবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আলী আজম জানান, গাইবান্ধা সদরের ঢনঢনি পাড়ার সাহারা বেগম ঝড় শুরু হলে খড়ি কুড়াইতে বাড়ির উঠানে যান। এ সময় গাছের ডাল তার মাথায় ভেঙে পড়লে তিনি মারা যান।

জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা ইদ্রিশ আলী জানান, ঝড়ে শতাধিক মানুষ আহত হওয়ার খবরও পাওয়া গেছে । জেলার অসংখ্য কাঁচা ঘরবাড়ি ও গাছপালার ক্ষতি হয়েছে। কী পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে তা জরিপ করে দেখা হচ্ছে।

এদিকে ঝড়ের শুরু থেকেই জেলার বিভিন্ন এলাকা বিদ্যুৎহীন রয়েছে জানিয়ে পিডিবির নির্বাহী প্রকৌশলী এমদাদুল হক বলেন, ঝড়ে খুঁটি ভেঙে, গাছ পড়ে তার ছিঁড়ে গেছে বিভিন্ন জায়গায়।

রাতের মধ্যে জেলা শহরের কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

ফরিদপুরে গাছচাপায় মামেয়ের মৃত্যু

ফরিদপুরে বছরের প্রথম কালবৈশাখী ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে মা-মেয়ের মৃত্যু হয়েছে। রোববার সন্ধ্যায় আলফাডাঙ্গা উপজেলার বানা ইউনিয়নের টাবনী ঘোষবাড়ির সামনে এ দুর্ঘটনা ঘটে। নিহত মোসাম্মাৎ হালিমা (২৫) ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার বাজিতপুর গ্রামের মো. জাহিদের স্ত্রী এবং তাদের এক বছর চার মাস বয়সী শিশু কন্যা আফছানা।

ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক রাফেজা আক্তার মিলি জানান, “ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে মোসাম্মাৎ হালিমা ঘটনাস্থলেই মারা যান। হাসপাতালে আনার পথে গুরুতর আহত তার শিশুকন্যা আফছানা মারা যায়। মৃত অবস্থায় তাকে হাসপাতালে আনা হয়।”

আলফাডাঙ্গা উপজেলার বুড়াইচ ইউনিয়ন পরিষদের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মিটু মোল্লা জানান, বুড়াইচ ইউনিয়নের পাকুড়িয়া গ্রামের কাবিল মোল্লার মেয়ে হালিমা তার মেয়েকে নিয়ে বাবার বাড়িতে আসার সময় ঝড়ের কবলে পড়েন। একটি গাছের ডাল ভেঙে তাদের উপর পড়লে ঘটনাস্থলেই হালিমা মারা যান।

স্থানীয়রা জানায়, নিহত মোসাম্মাৎ হালিমা তার মেয়ে আফছানাকে নিয়ে আলফাডাঙ্গা উপজেলার বানা ইউনিয়নের শিরগ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যান। সেখান থেকে সন্ধ্যায় রিকশাভ্যানে করে পাশের বুড়াইচ ইউনিয়নের পাকুড়িয়ায় তার বাবার বাড়ি উদ্দেশ্যে রওনা হন।

সন্ধ্যা ৭টার দিকে কালবৈশাখী ঝড় শুরু হলে বানা ইউনিয়নের টাবনী ঘোষবাড়ির সামনে পৌঁছালে রাস্তার পাশের সজনে গাছের একটি বড় ডাল তাদের উপর ভেঙে পড়ে। এতে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই হালিমা মারা যান।

স্থানীয়রা আফছানাকে উদ্ধার করে বোয়ালমারী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের জরুরি বিভাগে নিয়ে যায।

কুষ্টিয়ায় উড়ন্ত টিনে গলা কেটে যুবকের মৃত্যু

কুষ্টিয়ায় বছরের প্রথম কালবৈশাখী ঝড়ে উড়ে আসা টিনের আঘাতে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে। রোববার বিকেলে দৌলতপুর উপজেলার মহিষাডোরার আল্লারদর্গা এলাকার শশীধরপুর গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। প্রয়াত রবিউল ইসলাম (৪০) স্থানীয় বাসিন্দা সাদ মন্ডলের ছেলে এবং পেশায় একজন সবজি ব্যবসায়ী।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার তাপস কুমার সরকার বলেন, রোববার সন্ধ্যায় তাকে হাসপাতালে মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল।

এদিকে, দৌলতপুর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শাহাদত হোসেন বলেন, ঝড়ে টিন উড়ে একজন নিহত হওয়ার খবর শুনেছি। তবে বিস্তারিত তথ্য জানতে ঘটনাস্থলে পুলিশ রওনা হয়েছে।

নিহতের স্বজন ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার বিকেলে রবিউল ভেড়ামারা উপজেলার সাতবাড়িয়া হাটের আড়ত থেকে পেঁয়াজ কিনে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় ঝড়ের কবলে পড়ে আল্লারদর্গা এলাকায় দফাদার ফিলিং স্টেশনের কাছে এক দোকানে আশ্রয় নেন। এ সময় ঝড়ের তোড়ে পাশের দোকানের চালা থেকে টিন উড়ে রবিউলের ঘাড়ের আঘাত করলে তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন।

স্থানীয়রা রক্তাক্ত অবস্থায় রবিউলকে উদ্ধার করে কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

রাজশাহীতে ঝড়ে ফলশস্যের বিস্তর ক্ষতি

রাজশাহীর ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া চলতি মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী ঝড়ে আমের গুটি, বরজের পান ও ক্ষেতের ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। দুই দফায় ঝড় বয়ে যায় বিকেল তিনটা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এসময় শহরে বৃষ্টি না হলেও রাজশাহীর বাঘা ও পুঠিয়াসহ আশপাশের উপজেলা এলাকায় বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। মহানগরেও ধূলিঝড়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এরমধ্যে রাজশাহীর বিলসিমলা রেলক্রসিং থেকে কাশিয়াডাঙ্গা বাইপাস পর্যন্ত সড়কে লাগানো দৃষ্টিনন্দন বাতির অনেকগুলো পোলই উপড়ে গেছে। মহানগরীর শিরোইল বাস টার্মিনাল এলাকার মূল সড়কের ওপর একটি বিশালাকৃতির বিলবোর্ড উল্টে পড়ে যায়।

এতে প্রায় তিন ঘণ্টারও বেশি সময় ওই সড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ ছিল। পরে খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উদ্ধারকর্মীরা ঘটনাস্থলে যায়। রাত পৌনে ৮টার দিকে ওই সড়কে আবারও যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক হয়।

রোববার ৪ঠা এপ্রিল বিকেল ৩টার দিকে হঠাৎ করেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করে। এরপর পৌনে ৪টার দিকে শুরু হয় ধূলিঝড়। ঝড়ের স্থায়িত্ব ছিল প্রায় দুই ঘণ্টা। শহরে বৃষ্টি না হলেও রাজশাহীর বাঘা ও পুঠিয়াসহ আশপাশের উপজেলায় ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি ও শিলাবৃষ্টির খবর পাওয়া গেছে। এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া না গেলেও আমের গুটি, পান ও ধানসহ উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। ঝড় শুরুর আগেই মহানগরীসহ আশপাশের উপজেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত গোটা রাজশাহী শহর অন্ধকারাচ্ছন্ন ছিল।

রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ পর্যবেক্ষক রেজায়ানুল হক বলেন, ৬৫ কিলোমিটার বেগে রাজশাহীর ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে। সাধারণত বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০ কিলোমিটার পার হলেই তাকে কালবৈশাখী বলা হয়। তাই রাজশাহীর ওপর দিয়ে মৌসুমের প্রথম কালবৈশাখী বয়ে গেছে। আর মহানগরীতে না হলেও আশপাশের এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে। আবার কোথাও কোথাও শিলাবৃষ্টিও হয়েছে।

জানতে চাইলে রাজশাহী আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ আবহাওয়াবিদ রহিদুল ইসলাম বলেন, এটি মৌসুমী ঝড়-বৃষ্টি। ফাল্গুন ও চৈত্র-বৈশাখ মাসে এটা স্বাভাবিক। এজন্য এই মৌসুমকে ঝড়-বৃষ্টির মৌসুমও বলা হয়। রাজশাহীর তাপমাত্রা এখন বাড়ছেই।

রোববার দুপুরে রাজশাহীতে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ২২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিকেল ৩টা ৫০ মিনিটে কালবৈশাখী শুরু হয়। কয়েক দফায় সেই ঝড় চলে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত।

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মোছা. উম্মে ছালমা বলেন, এই ঝড়ে আমের গুটির তেমন ক্ষতি হবে না। তবে পান ও ধানের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। খোঁজ-খবর নিয়ে পরে ক্ষতির পরিমাণ নিরুপণ করা যাবে।

সংবাদ সারাদিন