প্রবাসী দম্পতি রুচিরা-আজিমের করোনা জয়ের সতেরো দিন

|| সাগর চৌধুরী, সৌদি আরব থেকে ||

করোনা সংক্রমণের সতেরো দিন পার করলাম! আমার অবশ্য পনেরো দিন, আজিমের দুই দিন পর আমার শুরু হয়। এই সতেরোটা দিন জীবনের অনেক হিসাব বুঝিয়ে দিল। জীবনের হিসাব নতুন করে বুঝে পাওয়ার এসব কথা সৌদি প্রবাসী রুচিরা সুইটি আর আজিমের।

রুচিরা বলছেন, ‍“বৃহস্পতিবার অফিস থেকে ফিরে আজিমের জ্বর শুরু, সবসময়ের মতো আমার ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে আজিম বলল, ফ্যানটা আমি তার দিকে সরাসরি ঘুরিয়ে দিয়েছি বলেই তার জ্বর জ্বর লাগছে। আমি ও অপরাধী হয়ে মাথা টিপে দিচ্ছি, ওষুধ দিচ্ছি। দুজনেরই আশা তেমন কোন সমস্যা নেই। একদিন পার হয়ে যখন জ্বর চেপে বসে আর আমাকেও আক্রমণ করে তখনই দুজনের মনে আশঙ্কা জাগে ভয়াবহ কিছুর।

যুদ্ধটা কঠিন ছিল, বাসায় দুইটা ছোট বাচ্চা আমাদের। সরকারি বেসরকারি দুই হাসপাতালের ডাক্তারই করোনা সন্দেহ করে সবরকম সতর্কতা নেওয়ার পরামর্শ দেয়। বাচ্চাদের আলাদা করে দিতে বলে। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হলাম আমরা।

ছবি : গেটি ইমেজের সৌজন্যে

কীভাবে যুদ্ধ করেছি শুনবেন?

গরম পানিতে লবন দিয়ে টক দই এর শরবত, আর লবংগ দিয়ে পাতলা আতপ চালের জাউ..এই দুইটা খাবার গলা ও পেট দুইই ঠান্ডা রেখেছে..গরম পানির ভাপ আর ইস্ত্রী করে তোয়ালে গরম করে গলা, বুকে হালকা হালকা সেক নিয়েছি।

অনেক অনেক কষ্ট করে ব্যায়াম করেছি, ব্যায়াম করার পরেই জ্বর চলে আসতো, কিন্তু পরদিন অনেক ভালো লাগতো। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এর “দম নিন দম ছাড়ুন” মেডিটেশনটা কি যে প্রশান্তি দিয়েছে। প্রচন্ড শরীর খারাপের সময় শুধু কোরান তেলাওয়াত শুনেছি।

একটু ভালো লাগলে শুনেছি শচীন দেব বর্মন এর গান। দেখেছি কুইন, ওয়েক আপ সিড, থ্রি ইডিয়টস.. বালিশে হেলান দিয়ে শুধু তাকিয়ে থাকতেও এতো কষ্ট হতো। মনটা কে ব্যস্ত রাখতে অনেক কিছু লিখেছি, হাত কাঁপত, চোখ ঝাপসা লাগতো, তবু অসুখ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে চেয়েছি।

আমার সেই লেখা গুলো প্রিয় ফেইসবুক গ্রুপ “পেন্সিল”.. প্রকাশ করে অনেক সাহায্য করেছে। পেন্সিল পাঠকের কমেন্টের জবাব দিতে দিতে অনেক সময় পার হয়ে গেছে। বন্ধু আশা, আঁখি ভাবি আর দেবতা তুল্য মামা মামি এই সময়ে যা করেছে তা সারা জীবন মনে রাখব।

ওষুধ খেতে হয়েছে অনেক, প্যানাডল, এজিথ্রোমাইসিন, ফ্লাজিল, গ্যাস এর ওষুধ, বমির ওষুধ কত কি। দিনে অনেক অনেক বার বাথরুম পরিস্কার করতে হয়েছে খুবই কষ্ট করে, যেহেতু আমাদের আর বাচ্চাদের একটা বাথরুম।

দেশে দুই পরিবারের বাবা মা ভাই বোনের যথেষ্ট চোখের পানি ঝরিয়েছি, দোয়াও পেয়েছি অনেক। হাসপাতালে যাবার পর যখন বাচ্চা দুইটা বাসা থেকে এস এম এস করলো, বাবা মা তোমরা ভয় পেও না, আমরা আছি.. তখন দুই জামাই বৌ গলা জড়াজড়ি করে কেঁদেছি।

ঈদের দিন সরকারি হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলল, আমি এবং আজিম দুজনেরই করোনা পজিটিভ । জ্বর শুরু সাতই মে, হাসপাতালে টেস্ট এর জন্য গেলাম ১১ই মে, টেস্ট করার ডেট পেলাম ১৭ই মে, আর টেস্ট এর রেজাল্ট পেলাম ২৪শে মে।

এতোদিন পরে জেনে কী করব বলতে পারেন?

ঈদের দিন থেকেই সুস্থ বোধ করছিলাম আমরা।

করোনা আক্রান্ত হয়েছেন কিংবা আক্রান্ত হতে পারেন তাদের জন্য

আমি মূলত সৌদি প্রবাসী ব্যাচেলর ভাইদের কথাই বলছি। একটা কথা ভালো করে জেনে নিন, করোনা ভাইরাস এর সরাসরি কোন চিকিৎসা আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি, এই ভাইরাস এ আক্রান্ত হয়ে শতকরা আশি ভাগ মানুষ ঘরে বসেই সুস্থ হচ্ছেন। তাই হাসপাতালে যাবার জন্য ব্যস্ত হবার কিছু নেই। কেবল শ্বাস কষ্ট না হলে আপনার হাসপাতালে যাবার কোন দরকার নেই।

আর শ্বাস কষ্ট হচ্ছে কিনা সেটা বুঝতে হলে, আপনি খেয়াল করুন আপনার নাভি মিনিটে কতবার ওঠানামা করছে, পঁচিশ বা তার বেশী বার ওঠানামা করলে শ্বাস কষ্ট ধরতে হবে। একজন সুস্থ মানুষের সেটা হবে পনেরো থেকে বিশ বার। নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম করুন।

তবে সবচেয়ে বড় কথা, আপনাকে মানসিকভাবে শক্ত হতেই হবে। মনের জোরে আশি বছরের বৃদ্ধকেও এই রোগে সুস্থ হতে দেখছি আর মনের দূর্বলতায় বিশ বছরের যুবকও কাবু হয়ে যাচ্ছে। কাজেই মনের জোর খুবই প্রয়োজন।

উপসর্গ দেখা দিলে কী করবেন

লক্ষন প্রকাশ পাওয়া মাত্রই প্রতিরোধের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। ব্যাচেলর মেসে যারা থাকেন সেখানে কেউ আক্রান্ত হলে সবাইকে একযোগে সেটা মোকাবেলা করতে হবে। যিনি অসুস্থ তাকে একটা রুমে আলাদা করে দিন, যারা সুস্থ তারা দরকার হলে একরুমে কয়েকজন বেশি থাকবেন। তাই বলে তো অসুস্থ মানুষকে বের করে দিতে পারেন না। যিনি অসুস্থ তার খাবার রুমের সামনে রেখে আসতে হবে, বাথরুম ব্যবহারের পর ডেটল দিয়ে পরিস্কার করতে হবে। যিনি অসুস্থ তার দায়িত্ব এটা খেয়াল করা যেন তার কাছ থেকে একজন মানুষও আক্রান্ত না হন। আর যিনি সুস্থ তার দায়িত্ব সাধ্যমত অসুস্থ মানুষটিকে সাহায্য করা। সবাই মিলে চেষ্টা করলে তবেই তো আমরা এই যুদ্ধে জয়ী হতে পারবো।

ওষুধ কী নেবেন

শুধু জ্বর হলেেই প্যানাডল খাবেন তিন বা চার বেলা, একটু বেশি জ্বর সাথে ঠান্ডা বা কানে গলায় ব্যথা, অথবা পেট খারাপ হলে এজিথ্রোমাইসিন এন্টিবায়োটিকটি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী খান। পেটের সমস্যা বেশি হলে সাথে ফ্লাজিল, বা ইমোডিয়াম খেতে পারেন। গ্রাষ্ট্রিক ইরিটেশনের ওষুধ নিজের কাছে যেটা ভালো লাগে খান।

পথ্য কি খাবেন

দিনে দুই থেকে আড়াই লিটার পানি বা তরল খাবার নিন। যে খাবার আপনার পেট ঠান্ডা রাখে সেগুলোই খেতে চেষ্টা করুন।

ব্যায়াম করুন

নিয়মিত শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়ামসহ অন্য শারীরিক ব্যায়াম অবশ্যই করবেন। নিয়মিত দুইবেলা গোসল করবেন। গরম পানির ভাপ নিন। প্রথম এগারো দিন পার করতে পারলে সাধারণত ভয়ের কিছু আর থাকে না। যদিও প্রায় মাসখানেক লাগে সম্পূর্ণ ঠিক হতে। তবে মনের জোর নিয়ে চেষ্টা করলে আপনি সুস্থ হয়ে উঠবেন।

আরও একটি কথা না বললেই নয়, যে ডাক্তার, যে বন্ধু বা যেই আত্মীয় স্বজন আপনি করোনা আক্রান্ত জেনেও আপনাকে ভয় দেখাবে, কয়জন করোনায় মারা গেছে, কে দুই দিনের জ্বরে হার্ট এ্যাটাক করেছে এইসব খবর দেবে তাদের সাথে এই সময়ে যোগাযোগ সম্পূর্ন বন্ধ রাখবেন। একমাত্র তাদের সাথেই যোগাযোগ রাখতে হবে যারা আপনাকে মনের জোর দেবে। ফেসবুক থেকেও দূরে থাকুন। নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি এগুলো আপনাকে শুধু মানসিক অস্থিরতা দেবে আর কিছুই নয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন