|| অর্থবাজার প্রতিবেদন, ঢাকা ||
করোনার আর্থিক অভিঘাতে শিকার শহুরে মানুষ যে হারে গ্রামে চলে যাচ্ছে, তাতে করে নতুন ধরণের সামাজিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে রাষ্ট্র। শনিবার সাউথ এশিয়ান ইকোনমিক মডেলিং- সানেম আয়োজিত নেটিজেন ফোরাম অষ্টম পর্বের ভার্চুয়াল আলোচনার মূল প্রবন্ধে এমন আশঙ্কা জানিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, “শহর থেকে গ্রামে এক ধরনের উল্টো অভিবাসন বা রিভার্স মাইগ্রেশন হচ্ছে। যে নিম্নআয়ের পরিবারগুলো গ্রামে ফিরে যাচ্ছে, সেখানে গিয়ে তারা কোনো কাজ নাও পেতে পারে এবং এতে করে নতুন সামাজিক চ্যালেঞ্জও তৈরি হতে পারে।”– যা মোকাবিলা করতে তিনি ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের রাষ্ট্রিক অর্থায়নের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে একমাত্র অবলম্বন না ধরে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় করার প্রস্তাব করেন। একইসঙ্গে রাষ্ট্রের বিশাল আকারের প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ সরবরাহে ধীরগতির সমালোচনাও করেন তিনি।
চলমান মহামারী পরিস্থিতির সার্বিক অবস্থা এবং সংশ্লিষ্ট আর্থ-সামাজিক চ্যালেঞ্জগুলোর ওপরে একটি প্রেজেন্টেশন তুলে ধরেন সেলিম রায়হান। বলেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষার সক্ষমতা বাড়লেও পরীক্ষার সংখ্যা সেই অনুপাতে বাড়েনি। বিশেষজ্ঞদের মতে, দৈনিক কমপক্ষে বিশ হাজার পরীক্ষা করা উচিত। কিন্তু সমন্বয়হীনতা ও তথ্য-উপাত্তের অভাবে সেটি হচ্ছে না।
ব্যাংকিং খাতের নানা প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কথা তুলে ধরে সানেম প্রধান বলেন, ব্যাংকিং খাতের দুর্বলতার জন্য প্রণোদনার অর্থ সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। প্রণোদনা বিতরণ ও বাস্তবায়নে একটি মনিটরিং ব্যবস্থা দাঁড় করানোর ওপরও জোর দেন তিনি।
অন্যদিকে ঠিকমত লকডাউন বাস্তবায়ন না করায় মহামারী পরিস্থিতির ক্রমাবনতি ঘটছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভাইরাসের নমুনা পরীক্ষায় দুর্নীতি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। এ ধরনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সংকট নিয়ে সেলিম রায়হান বলেন, নিম্নমুখী আমদানি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। প্রবাসী আয়ের রেকর্ড নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের মতামত তুলে ধরে তিনি বলেন, “আশঙ্কা করা হচ্ছে যে বর্তমানে যে প্রবাসী আয় আসছে সেটি প্রবাসী শ্রমিকদের শেষ সঞ্চয়। প্রবাসী শ্রমিকদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের দেশে ফেরত আসার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থারও উন্নতির কোনো সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে না।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে, বছর কয়েক আগে প্রস্তাবিত সার্বভৌম বন্ডের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এটি একটি সম্ভাবনা হলেও এ ক্ষেত্রে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে।” তিনি বলেন, “নিত্যপণ্যের দাম বাড়া তথা মূল্যস্ফীতির ফলে মানুষের প্রকৃত আয় কমে গেছে। আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিতদের পুঁজি শেষ হয়ে যাচ্ছে। উদ্যোক্তাদের বাজারে টিকে থাকাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য ক্রমাগত সুযোগও সংকুচিত হচ্ছে।”
স্বাস্থ্য খাত, ব্যাংক খাত ও কর আদায়ের মত প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করবার কোনো বিকল্প নেই জানিয়ে তিনি বলেন, “এবারের বাজেটে রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্য ধরা হয়েছে সেটি অবাস্তব, অন্যদিকে কর আদায়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের উদ্যোগ নেই। রাতারাতি প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে ওঠা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু অন্তত সঠিক দিকে পদক্ষেপ নেয়া দরকার।”
সানেমের গবেষণা পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, “বেকার হয়ে যেসব মানুষ গ্রামে চলে যাচ্ছে তাদের সন্তানদের পড়াশুনা বিঘ্নিত হতে পারে। অনেক শিক্ষার্থী ঝরে পড়তে পারে। কমে যেতে পারে গ্রামীণ মজুরি। স্কুল থেকে ঝরে পড়ার হার বাড়তে পারে, বাড়তে পারে বাল্য বিয়ে ও লিঙ্গ বৈষম্য।”
তিনি বলেন, “এক্ষেত্রে মানবসম্পদের ওপর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব মোকাবেলায় গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ ও গ্রামাঞ্চলে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানোর বিকল্প নেই। আর এটি বাড়ানো গেলে তা কৃষি উদ্যোক্তাদের জন্য একটি ভালো সুযোগও হতে পার। তবে ব্যাংকিং খাতের অবস্থা যেহেতু নাজুক ও নিম্নমুখী রফতানির জন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ কমে গেছে। কঠিন হয়ে পড়েছে গ্রামাঞ্চলে নতুন কাজের সংস্থান করা। এক্ষেত্রে তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি বা আইসিটি ডিভিশন স্থানীয় সরকারের সঙ্গে মিলে গ্রামের তরুণদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরির চেষ্টা করতে পারে।”
অন্যদের মধ্যে সানেমের রিসার্চ ইকোনমিস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক মাহতাব উদ্দিনও আলোচনায় অংশ নেন।