|| আনন্দ সারাবলো ||
শরীরে রক্তরোগ নিয়ে বেশ অনেক দিন ধরেই অপেক্ষায় ছিলেন দয়ালের ডাকের। জীবনের অল্প স্বল্প কিছু গল্প শেষ করে নটে গাছটি মুড়েই দিলেন গানের মানুষ এন্ড্রু কিশোর।
এন্ড্রুর জন্ম উত্তরের বিভাগীয় শহর রাজশাহীতে ১৯৫৫ সালে। সেখানেই কেটেছে তার শৈশব ও কৈশোর। গানটাকে ভাল বেসেছিলেন সেই ছোট্টটি থাকতেই। প্রাথমিকভাবে সংগীতের পাঠ শুরু করেন রাজশাহীর আবদুল আজিজ বাচ্চুর কাছে। পড়াশুনা রাজশাহীতেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। এরপর গানের নেশায় ছুটে আসেন রাজধানীতে।
মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সঙ্গীত, আধুনিক গান, লোকগান ও দেশাত্মবোধক গানে নিজেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জড়িয়ে ফেলেন বাংলাদেশ বেতারের সঙ্গে। এর আগে রাজশাহীতে থাকতে কাজ করেন রাজশাহী বেতারে।
প্রথম চলচ্চিত্রে গান গাওয়া শুরু ১৯৭৭ সালে। আলম খানের সুরে মেইল ট্রেন সিনেমাতে ‘অচিনপুরের রাজকুমারী নেই যে তার কেউ’ গানে কন্ঠ দিয়ে। এর দু’বছরের মাথায় প্রতিজ্ঞা চলচ্চিত্রের গান ‘এক চোর যায় চলে’। মানুষের কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে এন্ড্রুর কণ্ঠ। এর পরথেকে শুধুই সামনে এগিয়ে যাওয়া।
গত শতকের ৮০ দশক থেকে শুরু করে টানা এক যুগের বেশি সময় ধরে একে একে ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘আমার সারা দেহ খেয়ো গো মাটি’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়েছেন দয়াল আমারে’, ‘সবাই তো ভালবাসা চায়’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’, ‘আমার বাবার মুখে প্রথম যেদিন শুনেছিলাম গান’, ‘ভেঙেছে পিঞ্জর মেলেছে ডানা’- এমন অনেক গান দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে গানকে ঋদ্ধ করেছেন এন্ড্রু কিশোর। এই গান গেয়েই জিতেছেন আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।
৯০ এর দশকের শেষ দিক পর্যন্ত দাপিয়ে বেড়িয়েছেন গানের জগতে। এই দশকে তাঁর অনেক গান মানুষের মুখে মুখে ফিরলেও ‘পড়ে না চোখের পলক গানটি হয়ে উঠেছিল তুমুল জনপ্রিয়।
গেল বছরের প্রথম দিকে হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন এই শিল্পী। অসুস্থতার এক পর্যায়ে জানা যায় তার শরীরে বাসা বেধেছে অপ্রতিরোধ্য অসুখ ক্যান্সার। চলে যান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিতে। গেল অক্টোবর থেকেই সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নেন এন্ড্রু কিশোর। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর গেল ১১ই জুন রাতে বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন তিনি। পরের দিন ১২ই জুন তিনি চলে জন্মশহর রাজশাহীতে। সেখানে বোন শিখা বিশ্বাসের ক্লিনিকে ভগ্নিপতি ও চিকিৎসক প্যাট্রিক বিপুল বিশ্বাসের চিকিৎসা পরিচর্যায় ছিলেন তিনি।
চিকিৎসা পরিচর্যাতেই ফিরে আসে ক্যান্সার জীবানু। ভগ্নিপতি প্যাট্রিক বিশ্বাস কয়েকদিন আগে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছিলেন, এন্ড্রু কিশোরের শারীরিক অবস্থা ভাল না। লিম্ফোমা ফিরে আসায় তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। তার জন্য সবাইকে প্রার্থনা করবার অনুরোধও জানান তিনি।
রোববার রাত ১০টার দিকে এন্ড্রু কিশোরের ফেসবুক পেজ থেকে তার স্ত্রী একটি স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি এন্ড্রু কিশোরের শারীরিক অবস্থার কথা জানাতে গিয়ে লেখেন, ”এখন কিশোর কোনো কথা বলে না। চুপচাপ চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। আমি বলি কি ভাবো, সে বলে কিছু না, পুরানো কথা মনে পড়ে আর ঈশ্বরকে বলি আমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাও, বেশি কষ্ট দিও না।”
তিনি সেখানে লেখেন, ক্যান্সার এর লাস্ট স্টেজ খুব যন্ত্রণাদায়ক ও কষ্টের হয়। এন্ড্রু কিশোরের জন্য সবাই প্রাণ খুলে দোয়া করবেন, যেন কম কষ্ট পায় এবং একটু শান্তিতে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে যেতে পারে।
”আমার মনে হলো, কিশোর শুধু আমার বা আমাদের সন্তানের বা আমাদের পরিবারের নয় বরং দেশের মানুষের একটা অংশ বা সম্পদ। তাই এই কথাগুলো দেশের ভক্ত শ্রোতাদের বলা বা জানানো আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। এটাই শেষ পোস্ট, এর পর আর কিছু বলা বা লেখার মত আমার মানসিক অবস্থা থাকবে না। এখনও মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন মনে হয়, কিশোর থাকবে না অথচ আমি থাকবো, মেনে নিতে পারছি না।”
স্ত্রী, দুই সন্তান, স্বজন আর অসংখ্য শ্রোতাভক্তকে বিদায় জানিয়ে অবশেষ সেই দয়ালের ডাকেই সাড়া দিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় রাজশাহীতে বোনের বাড়িতে চিরনিদ্র্রার শয়ানে চলে যান গানের পাখি এন্ড্রু কিশোর। তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৪ বছর। তাঁর ইচ্ছাপূরণে মায়ের পাশেই সমাহিত করা হবে তাকে।