|| আনন্দ সারাবেলা ||
শেষ পর্যন্ত চলেই গেলেন অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার এটিএম শামসুজ্জামান। শুরুটা করেছিলেন সেই ষাটের দশকে। এরপর থেকে থেমে না থাকা এই অভিনেতা কাজ করেছেন চারশ’র বেশী চলচ্চিত্রে। নিজেকে অমরত্ব দিয়েছেন খল ও কমেডি চরিত্রে। আশি বছর বয়সে শনিবার সকালে সূত্রাপুরের বাসায় না ফেরার দেশে চলে যান সবার প্রিয় এটিএম শামসুজ্জামান। তার ছোট ভাই সালেহ জামান জানান, “কিছুক্ষণ আগে ভাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন।”
শনিবার জোহরের পর রাজধানীর নারিন্দার পীর সাহেবের বাড়িতে তার প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। বেঁচে থাকতে তিনি নারিন্দা পীর সাহেবের মুরিদ ছিলেন। বরেন্য এই অভিনেতার দ্বিতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হবে বাদ আসর সূত্রাপুর জামে মসজিদে। এর তাকে জুরাইন কবরস্থানে বড়ভাই কামরুজ্জামান কবি’র কবরের পাশে সমাহিত করা হবে।
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/02/117366167_3032885500151184_1881430432984033548_n-200x300.png?resize=200%2C300&ssl=1)
এটিএম শামসুজ্জামান দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। শ্বাসকষ্টের সমস্যা নিয়ে গত বুধবারও তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছিল। শুক্রবার বিকালে সেখান থেকে বাসায় ফিরেছিলেন তিনি। শনিবার সকালে পরিবারের সদস্যরা নাস্তার জন্য ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারেন, তার ঘুম আর ভাঙবে না।
দীর্ঘ ষাট বছরের অভিনয়পেশায় নিজের দক্ষতা আর গুণে হয় নিজেকে গড়ে তুলেছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তিনি ছিলেন একাধারে পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, সংলাপকার ও গল্পকার। তার লেখা চিত্রনাট্যের সংখ্যা একশ’র বেশী।
আজীবন সম্মাননার পাশাপাশি অভিনয়ের জন্য পেয়েছেন পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ২০১৫ সালে ভূষিত হন একুশে পদকে।
রাষ্ট্রপতির শোক
এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যুতে শোক জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এক বিবৃতিতে বলেছেন, “এটিএম শামসুজ্জামানের মৃত্যু দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিকাশে তার অবদান মানুষ শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।”
শোক প্রধানমন্ত্রীর
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শোকবার্তায় বলেছেন, “জনপ্রিয় এই শিল্পী তার অসাধারণ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে দেশবাসীর হৃদয়ে বেঁচে থাকবেন।”
একজন শিল্পীর অভিযাত্রা
এটিএম শামসুজ্জামানের জন্ম ১৯৪১ সালের ১০ই সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে; বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকায় দেবেন্দ্রনাথ দাস লেইনে। ঢাকার পগোজ স্কুলে তার বন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের আরেক জনপ্রিয় অভিনেতা প্রবীর মিত্র। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল, রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুল ঘুরে ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে ম্যাট্রিক শেষে এটিএম শামসুজ্জামান ভর্তি হয়েছিলেন তখনকার জগন্নাথ কলেজে।
বাবা নুরুজ্জামান ছিলেন নামকরা আইনজীবী। তিনি চাইতেন ছেলেও তার মত আইন পেশায় আসুক। কিন্তু শেষে এটিএম শামসুজ্জামান চেয়েছিলেন লেখক হতে। সাংবাদিক রণেশ দাশগুপ্তকে লেখালেখিতে গুরু মানতেন, দৈনিক সংবাদে নিয়মিত তার লেখাও বের হত।
সেই শামসুজ্জামান অভিনেতা হয়ে উঠলেন কীভাবে? দুই বছর আগে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, সেই শৈশব থেকেই মায়ের সঙ্গে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখতে দেখতে হয়ে উঠেছিলেন সিনেমার পোকা। তখন থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি দুর্বলতা তৈরি হচ্ছিল। সেই তাড়না থেকেই হয়ত অভিনয়ে আসা।
অভিনয় শুরুর পর বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিলেন বাবা। শুরুর দিকে ছিলেন নাটকের প্রমোটার। ২০ টাকা করে পেতেন। সূত্রাপুরের একটি হোটেলে তিন বেলা খেতেন। পরে সিনেমায় যখন নাম করলেন, সেই হোটেলওয়ালা তাকে বলেছিলেন, “আপনাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগে। অনেক কষ্ট করেছেন জীবনে।”
১৯৬১ সালে উদয়ন চৌধুরীর বিষকন্যা সিনেমায় সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজের সুযোগ মিলে যায়। পরে নারায়ণ ঘোষ মিতার জলছবি সিনেমার জন্য লেখেন চিত্রনাট্য। সেই সিনেমাতেই অভিষেক ঘটে নায়ক ফারুকের।
সিনেমার পর্দায় এটিএম শামসুজ্জামানের অভিনেতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ১৯৬৫ সালের দিকে। শুরুর দিকে মূলত কমেডি চরিত্রেই তাকে দেখা যেত। ১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেনের নয়নমণিতে খল চরিত্রে অভিনয় করে তিনি বোদ্ধাদের নজর কাড়েন। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
লাঠিয়াল, অশিক্ষিত, গোলাপী এখন ট্রেনে, পদ্মা মেঘনা যমুনা, স্বপ্নের নায়ক সিনেমার শামসুজ্জামান যেমন খল চরিত্রে ফ্রেমবন্দি হয়ে হয়েছেন, রামের সুমতি, ম্যাডাম ফুলি, যাদুর বাঁশি, চুড়িওয়ালায় তার কমেডি চরিত্রের কথাও মনে রেখেছেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের দর্শকরা।
ওরা ১১ জন, স্লোগান, সংগ্রাম, সূর্য দীঘল বাড়ি, ছুটির ঘণ্টা, রামের সুমতি, রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত, পদ্মা মেঘনা যমুনা এবং গেরিলার মত সিনেমাতেও এটিএম শামসুজ্জামান অভিনয় করেছেন নানা ভূমিকায়। অভিনয়ের জন্য এটিএম শামসুজ্জামানের প্রথম পুরস্কার ছিল বাচসাস পুরস্কার। পরে ১৯৮৭ সালে কাজী হায়াতের দায়ী কে সিনেমার জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি।
এরপর ১৯৯৯ সালের ম্যাডাম ফুলি, ২০০১ সালের চুড়িওয়ালা, ২০০৯ সালের মন বসে না পড়ার টেবিলে সিনেমায় অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান তিনি। ২০১২ সালের চোরাবালি সিনেমার জন্য পান পার্শ্বচরিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেতার জাতীয় পুরস্কার। আর ২০১৭ সালে ৪২তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে তাকে আজীবন সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। চলচ্চিত্রে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার আগে ও পরে টেলিভিশনেও বহু নাটকে দেখা গেছে তাকে। ভবের হাট, রঙের মানুষ, ঘর কুটুম, বউ চুরি ও শতবর্ষে দাদাজান দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছে।