করোনা অভিঘাতে ৭২৭৫০ কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণা রাষ্ট্রের

|| সারাবেলা প্রতিবেদক, ঢাকা ||
করোনাভাইরাস বিরুদ্ধ যুদ্ধে দেশের আর্থিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার ঋন ও প্রণোদনা সুবিধা ঘোষনা করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাঁচটি প্যাকেজে এই সহায়তা দেওয়া হবে। ঋণসুবিধার মধ্যে সবথেকে বেশী ৩০ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হবে শিল্পখাতে। ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের জন্য। আর রফতানি উন্নয়ন তহবিলে নতুন করে দেওয়া হবে ১২ হাজার ৬৫০ কোটি টাকা। এই ঋণসুবিধার সুদ হবে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ।
এই সহায়তার অপব্যবহার না করতে সুবিধাভোগিদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, এই আর্থিক সুবিধার সদ্বব্যবহার করা গেলে বৈশ্বিক এই বিপর্যয় সত্তে¡ও দেশের অর্থনীতি স্বাভাবিক রাখা সম্ভব হবে।
রোববার সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে এক সম্প্রচার সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, করোনা অভিঘাতে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন জিডিপি প্রবৃদ্ধি হোচট খেতে পারে। সমুহ এই বিপর্যয় মোকাবিলা করতে সরকার প্রয়োজনীয় অর্থ সহায়তা দেবে বলেও তিনি আশ্বস্ত করেন।
বিশ্বজুড়ে এই সংকটে দেশের অর্থনীতিতে সমুহ যেসব নেতিবাচক প্রভাব তাও উপস্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। এ থেকে উত্তরণে সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বাড়ানোসহ চারটি কার্যক্রম নিয়ে কর্মপরিকল্পনাও তিনি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার এই সম্মেলন সরাসরি সম্প্রচার করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাৎক্ষণিক, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী -এই চার পর্যায়ে বাস্তবায়নের লক্ষে চারটি কার্যক্রম নিয়ে সরকারের কর্মপরিকল্পনা সাজানো হয়েছে।
এরআগে গেল ২৫শে মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রফতানিমুখী শিল্পের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা সহায়তার পাশাপাশি গৃহহীনদের জন্য ঘর ও খাবারের ব্যবস্থা করবার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী।
এবারে নতুন চারটি প্যাকেজে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও পরিসেবা খাত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানের জন্য ঋণ সুবিধা, রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) নতুন বরাদ্দ এবং প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম চালুর ঘোষণা দেওয়া হলো।
শিল্প ও পরিসেবা খাতের ঋণসুবিধা
এসব খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যাংকের মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল হিসেবে দেওয়া হবে ৩০ হাজার কোটি টাকা। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের নিজস্ব তহবিল থেকে সংশ্লিষ্ট শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে এই ঋণ দেবে। এর সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে অর্ধেক, অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পরিশোধ করবে ঋণ গ্রহিতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাকি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ রাষ্ট্র ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্পে ঋণসুবিধা
এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ব্যাংক থেকে স্বল্প সুদে ঋণসুবিধা দিতে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল করা হবে। এক্ষেত্রেও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমেই ৯ শতাংশ সুদে এই ঋণ দেওয়া হবে। এক্ষেত্রেও ঋণ গ্রহিতা শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে সুদের ৪ শতাংশ। বাকি ৫ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে রাষ্ট্র।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সপোর্ট ডেভলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বৃদ্ধি
ব্যাক টু ব্যাক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বাড়াতে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার থেকে বাড়িয়ে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। এজন্য বর্তমান তহবিলের সঙ্গে আরো ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যোগ হবে। ইডিএফের বর্তমান সুদের হার লাইবর + ১ দশমিক ৫ শতাংশ (যা প্রকৃতপক্ষে ২ দশমিক ৭৩ শতাংশ) থেকে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে।
প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম
এই নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন তহবিল চালু করবে, যেখান থেকে ৭ শতাংশ সুদে ঋণ দেওয়া হবে।
এছাড়া প্যাকেজ ৫ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “এর আগে রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন/ভাতা পরিশোধ করার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলাম। নতুন চারটিসহ মোট ৫টি প্যাকেজে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা যা জিডিপির প্রায় ২ দশমিক ৫২ শতাংশ।”
এসব আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ দ্রুত বাস্তবায়িত হলে দেশে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে এবং বাংলাদেশ কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কাছাকাছি পৌঁছতে পারবে বলে আশা করছেন সরকারপ্রধান।
সেই সঙ্গে সবাইকে পণ্যের উৎপাদন ও ব্যবহার বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “সম্ভাব্য এ বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক সঙ্কট হতে উত্তরণের জন্য রপ্তানি খাতের পাশাপাশি দেশীয় পণ্যের প্রতি আমাদের বিশেষ নজর দিতে হবে।”
করোনা পরিস্থিতি রাষ্ট্রের যত উদ্যোগ
বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপ সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহানে করোনার প্রাদুর্ভাব হয়। চীনে করোনা ছড়ানোর পরপরই বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে সতর্কতামূলক নানা পদক্ষেপ নিতে শুরু করে। সরকার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নিয়েছে। জানুয়ারি মাস থেকেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়ার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী দেশে এযাবৎ করোনাভাইরাসে সংক্রমিত ও মৃত্যুর তথ্য তুলে ধরে বলেন, এখন পর্যন্ত ৭০ জন এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। মারা গেছেন আটজন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের রুহের মাগফিরাত কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁদের পরিবারের প্রতি সমবেদনাও জানান।বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ ও মৃত্যুর সবশেষ পরিস্থিত তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটি মৃত্যুও আমাদের কাম্য নয়।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যাঁরা মারা গেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের বয়স ৭০ বছরের ওপরে। এবং তাঁরা অন্যান্য শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন। তবে একটি মৃত্যুও কাম্য নয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশে ১৭ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। জনসাধারণকে ঘরে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুরু থেকে করোনা মোকাবিলায় তিন ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। জাতীয় পর্যায়ে থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।
বাংলাদেশের আর্থিক পরিস্থিতির ওপর করোনার প্রভাব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতিমধ্যে আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয় ১ শতাংশ কমে গেছে। শেয়ারবাজারে ওপর প্রভাব পড়েছে। বিশ্বে জ্বালানি তেলের দাম কমে গেছে। করোনার প্রভাব প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে পড়তে পারে।
শেখ হাসিনা বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা কমে যাওয়ায় জিডিপির প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে।
এই অবস্থা থেকে উত্তরণে সহায়তার পদক্ষেপ হিসেবে তাৎক্ষণিক করণীয়, স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথাও জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সরকারি ব্যয়বৃদ্ধি ও কর্মসৃজনকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা জানান। এর ফল নিম্নবিত্ত মানুষ পাবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী।
শ্রমিক-কর্মচারী বা অন্যান্য কর্মজীবী মানুষ যাতে কর্মহীন না হয়ে পড়েন, সে জন্য প্রধানমন্ত্রী আর্থিক সহায়তা প্যাকেজ, ঋণসুবিধা দেওয়ার কথা জানান। সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের ব্যাপকতা বাড়ানোর কথা জানান শেখ হাসিনা।
বাংলাদেশের মানুষের ‘আশ্চর্য সহনশীলতা’ এবং ‘ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে দ্রুত ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা’ রয়েছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, “১৯৭১ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যে জাতি মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছে – সে জাতিকে কোনো কিছুই দাবিয়ে রাখতে পারবে না, এটা জাতির পিতা নিজেই বলে গেছেন।”
প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর কথা বলেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রী বলেন, ঘোষিত প্যাকেজের সুফল পাওয়া যাবে। একসময় নিশ্চয়ই বিপদ কেটে যাবে। তবে সরকারকে চালকের আসনে বসতে হবে। এছাড়া অর্থসচিব আবদুর রউফ তালুকদার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. ফজলে কবীর নিজ নিজ করনীয় তুলে ধরেন।#

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন