করোনাকালেও অভিবাসী সন্তানদের যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া করছেন ট্রাম্প

|| বার্তা সারাবেলা ||

খোঁজ মিলছে না বাবার। মাও ক্রোশ দূরে যুক্তরাষ্ট্রের হাউসটন শহরে। দুই বোন, একজন আট বছরের। আর আরেক জন ১১ বছর পার করেছে সদ্য। শুধু যৌন হেনস্থার শিকার হয়েই রেহাই মেলেনি এদের। এখন বিতাড়িত হওয়ার ঝুঁকিতে এই দুই বোন।

গোটা দেশ যখন কোভিড-১৯ অসুখে আক্রান্ত, বিপর্যস্ত। ঠিক সে সময়ই আশ্রয়প্রার্থি এমন অনেক অভিবাসী সন্তানকে বিতাড়িত করার কাজে উঠপেড়ে নেমেছেন ট্রাম্পপ্রশাসন।

বাবা-মা ছাড়া দুইবোনের বাস এখন টেক্সাস সীমান্তের কাছের মেক্সিকোর বিপজ্জনক এক শহরের ভাড়াকরা বাসায়। দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হয়ে বাবা পড়েছিলেন শহরের রাস্তার ধারে। এর পর বাবার কি হয়েছে বাবা কোথায় আছে জানে না ওরা।

এরআগের সাতমাস ধরে বাবার সঙ্গেই ওরা থাকতো ব্রাউনভিলের মাতামরোসে। অপেক্ষা করছিল যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় আবেদনের ‘হ্যাঁ’ জবাবটি শুনবার জন্য। স্থানীয় দুর্বৃত্তদের দিক থেকে প্রাণে মারার হুমকিতে পুলিশের কোন সহায়তা না পেয়ে বাবার সঙ্গে পালিয়ে বেঁচেছিল ওরা। প্রাণে বাঁচলেও দুর্বৃত্তদের যৌন হেনস্থা থেকে রেহাই মেলেনি ওদের।

দিনটি ছিল গেল মার্চের কোন একদিন। হঠাৎ করেই বাবা আর ফিরলো না তার কাজের জায়গা থেকে। দিনশেষে ছোট্ট দুইবোনকে জানানো হলো ওদের বাবাকে শহরের রাস্তার পাশে পড়ে থাকতে দেখেছে কেউ কেউ। এরপর আর খোঁজ মেলেনি বাবার। প্রতিবেশী কেউ একজন ওদেরকে জানায়, তাদের এখন যেতে হবে মার্কিন অভিবাসন কর্তৃপক্ষের দফতরে। তারাই ওদেরকে পেঁছে দেবে হাউসটনে মায়ের কাছে। মা যে আগেই পাড়ি জমিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রে।

অভিবাসন দফতরে গেলে এক কর্মকর্তা বড় বোনটিকে ফোনে ধরিয়ে দেন ওদের মাকে। “মাম্মি” বলে চিৎকার করে ডেকে উঠেই মাকে জানায়, “বাবার আর আসেনি।” দু:সংবাদটি শোনা মাত্রই অনেকটাই বিমর্ষ হয়ে পড়েন মা।

করোনাভাইরাস সংক্রমণে সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাওয়ার আগের কয়েক সপ্তাহ দুইবোনের জায়গা হয় মার্কিন আশ্রয়কেন্দ্রে। মায়ের কাছে না যাওয়া অবধি এই আশ্রয়কেন্দ্রেই থাকতে হয় তাদের।

কিন্তু বিধিবাম! এ মাসের মাঝামাঝিতে জানানো হয়, কর্তৃপক্ষ ওদের মায়ের কাছে পৌঁছে না দিয়ে বরং দু’একদিনের মধ্যেই এল সালভাদরে রেখে আসবে। যেখানে নেই কোন থাকার জায়গা। নেই কোন স্বজন। আছে শুধুই দুর্বৃত্তদের হুমকি ধামকি।
তবে ওদের বিতাড়নের বিরুদ্ধে জরুরি এক কেন্দ্রীয় আবেদনে স্থগিত হয়ে যায় এসব সিদ্ধান্ত। শেষমুহূর্তে গেল সপ্তাহের শেষের দিকে ওরা দেখা পায় মায়ের।

এসব শিশুদের যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয়ের পাইয়ে দিতে আইনী লড়াই করছেন এমন এ্যাটর্নি, কোর্টের নথিপত্র আর কংগ্রেস কর্মচারীদের দেওয়া তথ্য বলছে, গোটা যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ যখন করোনা সংক্রমণের বিপর্যস্ত, ঠিক তথনই ট্রা্ম্প প্রশাসনের এমন কাজকে অমানবিক ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। বাবা-মা থেকে আলাদা অভিবাসী এসব শিশুকে এমন সব দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে যেখানে ওদের হতে হয়েছে ধর্ষিত, সইতে হয়েছে নির্যাতন, এমনকি খুন জখমের শিকার হয়েছে ওদের বাবা-মা।

অভিবাসন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আইনী লড়াই করছেন এমন অনেক প্রখ্যাত আইনজীবীরাও ট্রাম্প প্রশাসনের এহেন কাজে যারপর নাই বিস্মিত! তারা বলছেন, এমনতর বিতাড়ন বা ফেরত পাঠানো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে নতুন কিছু নয়। কিন্তু বৈশ্বিক মহামারির এই সময়ে ফেডারেল আইনের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেভাবে তড়িঘরি করে বিপর্যস্ত এসব শিশুদের বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিচ্ছে তা সভ্যতাবিরুদ্ধ অন্যায় ছাড়া আর কিছুই নয়।

আন্তর্জাতিক শরণার্থী সংস্থাগুলো বলছে, গেল কয়েক সপ্তাহে কমপক্ষে দুটি শিশুকে আশ্রয় কেন্দ্র থেকে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদের নিজ দেশে। যেখানে তারা পড়তে পারে বিপজ্জনক এক পরিস্থিতিতে। এদের মধ্যে একজন হন্ডুরাসের এক কিশোরী। যার ভয় দেশে ফিরলে তাকে হতে হবে ধর্ষনের শিকার।

আরেক কিশোর আটকে আছে হন্ডুরাসে তার আত্মীয়ের বাড়িতে। সে জানিয়েছে, বাসার বাইরে যেতে তার ভয় হয়। ওর মা যুক্তরাস্ট্রে আশ্রয়প্রার্থি হিসেবে মামলায় লড়ছেন মেক্সিকোতে থেকে। করোনা সময়ের লকডাউনে সেও আটকে পড়েছেন তিনিও।

অভিবাসন বিচারক মামলা আমলে নিতে সম্মতি দেওয়ার সত্বেও আরেক কিশোরকে ফেরত পাঠানো হয়েছে তার নিজ দেশে। তবে শেষমুহূর্তে ফেডারেল আদালতে মামলা নেওয়ায় এমন ফেরত পাঠানো থেকে বেঁচে গেছে কমপক্ষে সাতটি শিশু। ওদের আইনজীবী জানান, ট্রাম্প প্রশাসন তড়িঘরি করে ওদের ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা প্রায় ঘুছিয়ে এনেছিল।

আমেরিকান সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়নের হয়ে কাজ করছেন আইনজীবী স্টিফেন ক্যাং। তিনি জানিয়েছেন, এ ধরণের খুব কম ঘটনাই আমরা জানতে পারছি। কিন্তু আমাদের জানার বাইরে এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে ট্রাম্প প্রশাসন।

করোনা সংক্রমণের শুরুতেই প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সীমান্ত বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই আশ্রয়প্রার্থি অভিবাসী ছেলেমেয়েকে তড়িঘরি করে নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর কাজে উঠেপড়ে লেগেছেন সংশ্লিষ্টকেন্দ্রগুলো। কাস্টমস এন্ড বর্ডার প্রকেটশন কমিশনার মার্ক মরগান গেল মাসে এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, করোনার এই সময়ে এসব ছেলেমেয়েদেরকে দেশে ঢুকতে দিলে তারা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে।

মার্কিন ফেডারেল পরিসংখ্যান বলছে, গেল মার্চ ও এপ্রিল এই দুইমাসে বাবা-মা ছাড়া আরো ৯শ শিশুকে মার্কিন সীমান্তের আশ্রয়কেন্দ্রে এনে রেখেছে। যাদের বাবা-মা সীমান্তবর্তি দেশগুলোতে থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের জন্য আবেদন করেছেন।

সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা বলছেন, গেল মার্চ থেকে এ পর্যন্ত সময়ে হোমল্যান্ড সিকিউরিটি ডিপার্টমেন্ট কম করে হলেও এমন ১৫টি ছেলেমেয়েকে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা করেছে। এবং ১০ বছরের একটি শিশুসহ ছয়জনকে ইতোমধ্যে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে। এই গেল সোমবারেই গুয়েতেমালার এক কিশোরিকে ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নিয়েছিল হোমল্যান্ড ডিপার্টমেন্ট।

এসব বাবা-মা কিংবা স্বজনহীন ছেলেমেয়েদেরকে মেক্সিকোতে থাকতে বাধ্য করা হচ্ছে যুক্তরাস্ট্রের মাইগ্রেন্ট প্রটেকশন প্রটোকলস এর অধীনে। এই প্রটোকলটি ট্রাম্প জারি করেন ২০১৯ সালে। এই প্রটোকলের কারনে এসব ছেলেমেয়েরা তাদের পক্ষে কোন আইনজীবী নিয়োগ কিংবা চাইলেও কোন আইনজীবী তাদের পক্ষে আইনী লড়াই চালাতে পারেন না। গেল কয়েকমাসে এমন ছেলেমেয়েদের প্রতি দুইজনে একজনকে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। যাদেরকে কোন ধরণের আইনী সহায়তা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি।

গেল অক্টোবর থেকে এমনসব ছেলেমেয়েদের খুঁজে বের করতে কাজে করছে দ্য অফিস অব রিফিউজি রিসেটেলমেন্ট।যাদের বাবা-মা আশ্রয়প্রার্থিতার জন্য অপেক্ষা করছেন মেক্সিকো-যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্ত শহরগুলোতে। এ পর্যন্ত এই সংস্থাটি ৫১৭ জন ছেলেমেয়ের খোঁজ পেয়েছে, যাদের মধ্যে ১২ বছরের নিচে বয়স, এমন শিশুর সংখ্যা ৩শ’র বেশী।

সংস্থার এক মুখপাত্র জানান, তাদের আইনী লড়াইয়ে জয়ী হয়ে এসব শিশুর মধ্যে ৪৭৬ জনই যুক্তরাষ্ট্রে থাকা তাদের বাবা-মা কিংবা স্বজনদের সঙ্গে মিলতে পেরেছে। তবে চারজনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে তাদের নিজদেশে।

সংস্থাটি বলছে, তাদের কাছে এই মুহূর্তে এমন ১৪৫০টি ছেলেমেয়ে রয়েছেন, যারা মেক্সিকোতে বাবা-মায়ের সঙ্গে ছিলেন এবং একা কিংবা স্বজনদের সঙ্গে সীমান্তে এসেছেন।

সংবাদসূত্র : প্রোপাবলিকা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন