|| বিপ্লব শাহনেওয়াজ, সুইডেন থেকে ||
উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা, স্বাস্হ্যকর জীবনযাপন পদ্ধতি, সামাজিক নিরাপত্তা, কল্যানমুখী রাষ্ট্র ব্যবস্থার সুফলে স্কান্ডেনেভিয়ান দেশগুলিতে মানুষ দীর্ঘজীবনের অধিকারী হয়। ক্ষেত্র বিশেষে ৭৫-৮৫ বছরের কাউকে বৃদ্ধ বলা যেমন অভদ্রতা; তেমনি তাদের তাঁদের শারীরিক ভাষার সাথে বেমানানও বটে। মানুষ ৬৫ বছর বয়সে পেনশনে যায় এবং পেনশনের পরেও অনেকে ৩০-৩৫ বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকে। একা একা বাজার করে, ঔষুধ কেনে, দৈনিক হাটাচলা করে। সাবলম্বী থাকার চেষ্টা করে জীবনের শেষ শক্তি দিয়েও। কল্যানময় রাষ্ট্র বয়স্ক প্রধান জনগনের সেবায় নিয়োজিত- কারন এই মানুষগুলির আয়করের উপড় ভিত্তি করেই আজ নরডিক দেশগুলি কল্যানময় রাষ্ট্রের সুনাম ধারন করে আছে। আমাদের দেশে বৃদ্ধাশ্রমকে নেতিবাচক দৃষ্টিকোন থেকে দেখা হয়। পুরাতন নরডিক ইতিহাসেও বৃদ্ধাশ্রম ছিলো না- যৌথ পরিবার ছিলো। কিন্তু শিল্পবিপ্লবের সময় নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কঠোর পরিশ্রমের বাস্তবতায় যৌথ সামাজিক ব্যবস্থায় গড়ে ওঠে দিনের বেলায় শিশুদের জন্য শিশুসদন / কিন্ডারগার্টেন এবং বৃদ্ধাশ্রম। বয়স্ক, অক্ষম বা রোগের কারনে শয্যাশায়ী বাবা-মা অথবা শিশু সন্তানকে বাসায় রেখে সারাদিন কাজ করা অসম্ভব। এই বাস্তবতায় শিশু এবং বয়স্কদের দেখাশোনাটাও একটা পেশাদার কর্মক্ষেত্র হিসাবে উন্নত হতে থাকে।
এরপর সময়ের সাথে সাথে সাধারন শিশুদের সাথে সাথে প্রতিবন্ধী বিবেচনায়ও শিশুসদন হয়। বিকাশ লাভ করে প্রয়োজন অনুসারে বৃদ্ধাশ্রম- ডিমেনসিয়া রোগীদের জন্য, পক্ষাঘাত রোগীদের জন্য, সাধারন কিন্তু অক্ষম বয়স্কদের জন্য বিভিন্ন বৃদ্ধাশ্রমে পেশাদার স্বাস্হ্যকর্মী যেমন- নার্স, আন্ডারনার্স এবং ডাক্তার দ্বারা সেবা দেয়া হয়। আবেগতারিত হয়ে সন্তানদের পক্ষে হয়তো এতো পেশাদার সেবা দেয়া সম্ভব নয়- শুধু ভালোবাসায় আর আবেগে বয়স্ক অক্ষম বাবামায়ের পরিপূর্ন সেবা নিশ্চিত করা যায় না- সম্ভব নয় একজন কর্মজীবী ছেলেমেয়েদের জন্যও। পেশাদারিত্ব এখানে কর্মসংস্হান ও দিচ্ছে। হয়তো ছেলেমেয়েরা অন্য কোন শিশুসদন বা বৃদ্ধাশ্রমে কাজ করে অন্যের সেবা দিচ্ছে। হসপিটালের জরুরী বিভাগের করিডোরে এইসব ৮০-৯০-১০০ বছরের মানুষের ভীড়। কেউ পাঁজরের হাড় ভেঙ্গে, কেউবা স্ট্রোকে, শ্বাসকষ্টে অথবা ইনফেকশন নিয়ে। স্মৃতিভ্রম রোগ ডিমেনসিয়ার রোগীরা হয়তো চিৎকার করে বার বার একই প্রশ্ন করছে। অনেকে আবার শুধুই বেঁচে আছে – শারীরিক জড় বস্তু হয়েই। অনেককেই চিকিৎসার ক্ষেত্রে ডাক্তার সীমাবদ্ধতা দিয়ে দেয় – যেমন এই রোগীর অন্যান্য শারীরিক অসুখের জন্য CPR করা হবে না, ICU, ITU তে ভর্তি করা হবে না, ইনটিউবেসন করা হবে না, শুধু নন ইনভেসিভ রেসপিরেটোরী সাপোর্ট দেয়া হবে। আবার PCI বা Trombolysis পাচ্ছে ৯৫ বছর বয়সেও। অনেকেই হাসপাতাল থেকে শীতলরুমে যাচ্ছে। আবার অনেকেই হাসপাতাল থেকে বাড়ী ফিরে যাচ্ছে – hip prosthesis, pacemaker, ICD, brain stimulation prosthesis নিয়ে। রিজার্ভ পার্স দিয়ে পুরোনো গাড়ী যেমন অনেক দিন চলে – মানুষেরাও তেমনি অনেক দিন বাঁচে। মৃত্যু কালে শরীরের মাঝে থাকে কতো ধরনের রিজার্ভ পার্স- আধুনিক চিকিৎসার ইতিবাচক কিংবা ক্ষেত্রবিশেষে নেতিবাচক দিক এইটাই।
করোনা ভাইরাসে সুইডেন স্বভাবগত ভাবে বরাবরের মতোই মধ্যপন্থার নীতি নিয়েছে। যেখানে রাষ্ট্র এবং জনগণ পারস্পরিক বিশ্বাস এবং দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে – জোর করে, নিষেধ করে লকডাউন না করে – নাগরিকদের করোনা প্রতিরোধে তথ্য দিচ্ছে, উপদেশ দিচ্ছে, চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে। হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশী দেবার নিয়ম শিশুসনদের শিশুরাও জানে। সামাজিক দূরত্বের জন্য সুইডিসদের দুর্নাম আগে থেকেই। এবং কথা বলার সময় যতটুকু দূরত্ব ভদ্রতার জন্য রাখতে হয় তাও তাদের জানা। অসুস্থ হলে ঘরে থাকার জন্য বলছে – অসুস্থতার জন্য সনদের বাধ্যবাধকতা শিথিল করেছে। ৫০ জনের বেশী লোকের সমাগম নিষেধ করেছে। একমাত্র মানবিক কারন ছাড়া ভ্রমন না করতে বলেছে – কিন্তু সীমান্ত বন্ধ বা ভ্রমনের জন্য ছাড়পত্রের প্রয়োজন নেই। তেমনি বিমানবন্দরে নেই বাড়তি কন্ট্রোল। নিজ দায়িত্ব কর্তব্য বলে একটা ব্যাপার আছে। সমাজ, পরিবার এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতা আছে প্রতিটি নাগরিকের। তা হলে পুলিশ-আর্মি দিয়ে শাটডাউন প্রয়োজন তো নেই। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং কলেজের ছাত্রছাত্রীরা অনলাইনে ক্লাস করছে। কর্মজীবী যারা স্কাইপি (সুইডিস আবিষ্কার) বা অনলাইনে কাজ করতে পারে তারা অনলাইনে করছে। শিল্পকারখানায় অনেক ক্ষেত্রে উৎপাদন কমিয়ে আনা হয়েছে। ভলভো, স্কানিয়া এবং এরিকসনের মতো সুইডিস প্রতিষ্ঠান মেডিকেল যন্ত্র তৈরীর (এই মুহূর্তে ভেন্টিলেটর) প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। ভলভো গাড়ী না বানিয়ে এখন করোনা ভাইরাসের প্রতিরক্ষামূলক চোখ মুখের মাস্ক বানাচ্ছে।
কিন্ডারগার্টেনে আর স্কুলে শিশুরা না গেলে উৎপাদন কি ভাবে হবে? স্বাস্হ্য সেবাখাত কি ভাবে চলবে? তাই স্কুলে শিশুরা যাচ্ছে। রাস্তায় বাস চলছে- তবে কি ভাবে দাঁড়াতে হবে, বসতে হবে সে সব মেনেই। সুপারমলের ক্যাশের মেয়েটির সামনে এই কয়েকদিনের মধ্যেই কাচের বর্ম তৈরী হয়ে গেছে- ইনফেকশন কমিয়ে আনার জন্য। রাস্তা ঘাটে, অফিস, দোকানে মাস্ক পরা, নভোচারীর পোষাক পরা কেউ নাই। সবকিছু স্বাভাবিক তবে সাবধানে, সতর্কতা মেনে চলছে।
গন হারে করোনার পরীক্ষা চলছে না- শুধুমাত্র হসপিটালে ভর্তি হবার মতো পরিস্থিতি হলেই টেষ্ট করা হচ্ছে। তাই পজিটিভ রোগী মাত্র ৫০০০, আইসিইউতে ৪০০ এবং মৃত রোগীর সংখ্যা ৩০০। যেভাবেই হোক বৃদ্ধাশ্রমগুলিতে করোনার সংক্রমন ঘটেছে। মৃতের সংখ্যা তাই বেশী। গতকাল রাষ্ট্রীয় এপিডেমিওলজিষ্ট Anders Tegnell বলেছে একটা ট্রাজ্ডির জন্য প্রস্তুত হতে- কারন বয়স্ক জনগোষ্ঠির দেশে অনেক মানুষ মারা যাবে। কাউকে ইনটিবেশন করতে হলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ৮০ বছরের কাউকে না করে ৬০ বছরের একজনকে করতে হবে। এটাই বাস্তবতা।
অনেক মানুষ মারা যাবে- জাতিও তার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত। ৮০-৯০ বছরের জীবন তো পরিপূর্ণ একটা জীবন – আক্ষেপের কিছু নেই যখন একবার মরতেই হবে। এরজন্যই আমি যখনই কোন রোগীকে ক্যান্সার বা খারাপ কোন শারীরিক পরিস্থিতির কথা প্রথম ভাবে জানিয়েছি – তারা নীরবে শুনেছে। বাস্তবতা মেনে নিয়েছে। বৈশ্বিক এই দূর্যোগ কেটে গেলে বৃদ্ধাশ্রমগুলি হয়তো ফাঁকা হয়ে যাবে। ওখানে কর্মরত মানুষগুলি কর্মহীন হয়ে পরবে। হসপিটালের করিডোরে শোনা যাবে না স্মৃতিভ্রমের রোগীর বারবার করা প্রশ্নগুলি। কল্যানময় রাষ্ট্রের কল্যানখাতের কিছুটা হলেও কৃচ্ছ সাধন হবে।
বিপ্লব শাহনেওয়াজ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক,
ইমারজেন্সি মেডিসিন বিভাগ; উপসালা ইউনিভার্সিটি, সুইডেন।
এই সম্পর্কিত আরও সংবাদ
শোকের মাসে সৌদি প্রবাসীদের দূতাবাসের বিশেষ সেবা ঘোষণা
আগস্ট ২, ২০২১
১০ই আগষ্ট চালু হচ্ছে ওমরাহ, নিষেধাজ্ঞা ৯ দেশে
জুলাই ২৬, ২০২১
কাশ্মীরে ঈদে পশু জবাই নিষিদ্ধ করলো মোদি সরকার
জুলাই ২০, ২০২১
এই বিভাগের সর্বশেষ
কাবুলে আইএসের বোমায় নিহতের সংখ্যা এ পর্যন্ত ৯০ জন
আগস্ট ২৭, ২০২১
শোকের মাসে সৌদি প্রবাসীদের দূতাবাসের বিশেষ সেবা ঘোষণা
আগস্ট ২, ২০২১
১০ই আগষ্ট চালু হচ্ছে ওমরাহ, নিষেধাজ্ঞা ৯ দেশে
জুলাই ২৬, ২০২১