|| সারাবেলা ডেস্ক ||
অচিন্ত্য আর বিশ্বজিৎ। একই গাঁয়ের দুইবন্ধু। দু’জনই রাধুনি। বাড়ি পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুরার ইন্দাসে। গত জানুয়ারিতে কাজের খোঁজে পাড়ি জমিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের গাজিয়াবাদে। সেখানে একটি মেসে রাঁধুনির কাজে যোগ দেন। মাসখানেকের বেতন জুটেছিল। এরইমধ্যে করোনার আবির্ভাব। প্রথম দিকে তেমন একটা গা করেননি। তারপর সংক্রমণের মাত্রা বাড়তে থাকায় সহকর্মীরা একে একে বাড়ি ফিরতে শুরু করেন। যাচ্ছি যাই করে সারাদেশে শুরু হয় লকডাউন।
টাকা পয়সা যা ছিল সবশেষ। সিদ্ধান্ত নিলেন বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু কীভাবে। দু’জনের দুটো সাইকেল ছাড়াতো আর কিছুই নেই। কোনভাবে যোগাড় করলেন একটি গুগল ম্যাপ। তাই নিয়েই শুরু হলো বাড়ি ফেরার অভিযাত্রা। পেরতে হবে বারোশো কিমি পথ। পথ জানা নেই। গুগল ম্যাপে খুঁজে খুঁজে পথ বের করা আর এগিয়ে চলা। টানা ১২ দিন সাইকেলে। পেরিয়ে এসেছেন একের পরে এক জনপদ। পথে বিপদ-ও এসেছিল। তবে থমকে যাননি তাঁরা। অবশেষে বাড়ি ফিরে এখন তাঁরা রয়েছেন গৃহ পর্যবেক্ষণে। ঝুলিতে পুরেছেন বিরল সব অভিজ্ঞতা।
গত ১৩ই এপ্রিল গাজিয়াবাদ থেকে রওনা দিয়েছিলেন দুই বন্ধু। নিজের বাড়ি পশ্চিমবঙ্গে বাঁকুরা জেলায় পৌঁছন ২৪শে এপ্রিল। ১২শ’ কিলোমিটার অভিযাত্রার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে দুই তরুণ বললেন, ‘‘কাজে যোগ দেওয়ার পরেই আমরা সাইকেল কিনেছিলাম’’, শুরু করলেন অচিন্ত্য। তারপর বললেন, ‘‘অজানা পথ। মোবাইলে গুগল ম্যাপ খুঁজে-খুঁজে পথ বার করি। কত বার যে কুকুরের তাড়া খেয়েছি গুনে শেষ করতে পারব না।’’
বিশ্বজিৎ বলেন, ‘‘এক মাস বেতন পেয়েছিলাম। ঠিকাদারকে বার বার ফোন করে ও যোগাযোগ করা যায়নি। নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার টাকা ফুরিয়ে আসছিল। তখনই সিদ্ধান্ত নিই। সাইকেল চালিয়েই বাড়ি ফিরব। আমাদের পকেটে তখন মাত্র শ’পাঁচেক টাকা।’’
দুই বন্ধু বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম ১৩ই এপ্রিল রাতে। অচিন্ত্যর কথায়, ‘‘কিছুটা যাওয়ার পরেই তাড়া করেছিল এক দল কুকুর। একটি মন্দির খোলা দেখে সেখানে ঢুকে পড়ি। সে রাত্রে খাবার জোটেনি।’’ ভোরের আলো ফুটতেই ফের যাত্রা শুরু হয়েছিল। বিশ্বজিতের কথায়, ‘‘ঠিক করেছিলাম, দিনের বেলা যতটা বেশি পথ যাওয়া যায়, তা যাব। সন্ধ্যা নামলে হাইরোড ধরে সাইকেল চালানো নিরাপদ হবে না।’’ মাঝে মধ্যেই সাইকেলের চাকা ফেটেছে। কখনও টিউব ‘লিক’ হয়েছে। কখনও আবার ১৫-১৬ কিলোমিটার হাঁটতে হয়েছে সাইকেল সারানোর দোকান খুঁজে পেতে।
বিশ্বজিতের কথায়, ‘‘লিক সারাতে কখনও লেগেছে ১৫০ টাকা। তবে বিহারে ঢোকার পরে কেউ কেউ আমাদের অবস্থা দেখে বিনা পয়সায় ‘লিক’ সারিয়ে দিয়েছিলেন। সাইকেল সারাতেই অনেক টাকা গিয়েছে। যেহেতু সাইকেলটাই একমাত্র সঙ্গী, তাই ওকে ঠিক রাখা সব থেকে বেশি প্রয়োজন ছিল। অনেক দিন অভুক্ত থেকেছি। যখন পারিনি, তখন এর-ওর দরজার কড়া নেড়েছি। কেউ যত্ন করে খাইয়েছেন। কেউ আবার তাড়িয়ে দিয়েছে।’’
রাতে অজানা লোক দেখে তাঁদের অনেক জায়গা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। তখন লুকিয়ে স্কুলে আশ্রয় নিতে হয়েছিল দুই বন্ধুকে। পকেটে যে টুকু টাকা ছিল, তা-ও শেষ হয়ে যায় বিহারে ঢোকার পরে। দুপুর হলে পথের ধারে কোনও হোটেলে খাবার চাইতেন তাঁরা। কখনওবা গ্রামে ঢুকতেন খাবারের সন্ধানে।
অচিন্ত্যর কথায়, ‘‘সকলেই যে খাবার দিতেন তা নয়। অনেকেই তাড়িয়ে দিয়েছেন। ঝাড়খণ্ডে ঢোকার পরে চিত্রটা অনেকটাই বদলে যায়। যাঁদের কাছে খাবার চেয়েছি, তাঁরাই দিয়েছেন। গোটা যাত্রাপথে বেশ কয়েক বার পুলিশ আটকেছিল। কিন্তু আমাদের কথা শুনে তাঁরা ছেড়ে দেন।’’
অচিন্ত্য বলেন, ‘‘এক দিন শরীরে এমন ব্যথা হয়েছিল যে, মনে হয়েছিল, আর বোধ হয় বাড়ি ফিরতে পারব না। কিন্তু মনে জেদ ছিল। সব সয়ে গিয়েছিল। ২৪শে এপ্রিল বাড়ি ফিরে মনে হয়েছিল যুদ্ধে জিতলাম। গোটা রাস্তায় দেখেছি, কত মানুষ কত রকম ভাবে লড়ছেন এই করোনার বিরুদ্ধে।’’
গ্রামে পৌঁছনোর পরে দুই তরুণের প্রাথমিক চিকিৎসা হয়। পরে তাঁদের গৃহ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ইন্দাস থানার কর্মকর্তা বিদ্যুৎ পাল। এখন তাঁরা সম্পূর্ণ সুস্থ।#