|| বার্তা সারাবেলা ||
জম্মু-কাশ্মীরের লাদাখ নিয়ে ভারত ও চীনের মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। ইতোমধ্যে দুই পক্ষের অর্ধ শতের বেশী সেনা নিহত হয়েছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী জানিয়েছে সোমবার দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে তাদের ২০ সেনা নিহত হয়েছে। যদিও প্রথমে ভারতের পক্ষ থেকে তিন সেনা নিহত হওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। পরে এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী বলেছে, “সংঘর্ষে নিহত এক সেনা কর্মকর্তা ও দুই সৈনিকের সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর আহত আরও ১৭ সেনা মারা গেছে।”
কয়েক দশক পর পারমাণবিক শক্তিধর এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে এমন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটল।
এদিকে ভারতীয় বার্তা সংস্থা এশিয়ান নিউজ ইন্টারন্যাশনাল এ এন আই জানিয়েছে, সংঘর্ষে চীনা পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) ৪৩ জন সেনা নিহত হয়েছে। নিজেদের পক্ষে হতাহতের ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু না বললেও চীনের সরকারি সংবাদমাধ্যম ‘গ্লোবাল টাইমস’ বলছে, চীনা বাহিনীতেও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। চীনের দাবি ভারতীয় সেনারা প্রথমে হামলা করলে দু’পক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে।
চীনের পিপলস লিবারেশন আর্মির (পিএলএ) মুখপাত্র ঝ্যাং সুইলি ভারতীয় পক্ষকে তাদের সীমান্তের সেনাদেরকে কড়াভাবে সংযত রাখতে বলেছেন এবং সমস্যা সমাধানে আলোচনার সঠিক পথে ফিরে আসার বার্তা দিয়েছেন। সুইলিও সংঘর্ষের ঘটনার জন্য ভারতীয় পক্ষকে সীমান্তের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা লঙ্ঘনের জন্য দোষারোপ করেছেন এবং ভারত ইচ্ছা করে উস্কানি দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন।
হিমালয় পর্বতের পশ্চিমাংশের লাদাখে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে ভারত ও চীনের সামরিক বাহিনী পরস্পর মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে আছে। এবারের সংঘর্ষের ঘটনাটি লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় সোমবার রাতে ঘটেছে বলে বিবৃতিতে জানিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। দুই পক্ষের জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তারা বৈঠকে বসে উত্তেজনা নিরসনের চেষ্টা করেছেন বলেও জানায় তারা।
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, এর প্রতিক্রিয়ায় ভারতকে একতরফা কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সতর্ক করে ঝামেলা আর না বাড়াতে বলেছে। মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বেইজিংয়ে সাংবাদিকদের বলেন, “গেল ১৫ই জুন ভারতীয় পক্ষ দুবার সীমান্ত লঙ্ঘন করে উস্কানি দিয়েছে এবং চীনা সেনাদের আক্রমণ করেছে। এ থেকেই দুই সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ শুরু হয়।”
এলাকাটিতে উত্তেজনা কেমন?
লাদাখের ‘লাইন অফ অ্যাকচুয়াল কনট্রোল’ (এলএসি) এর সীমানা সঠিকভাবে নির্দেশ করা নেই। তার ওপর সেখানে নদী, হ্রদ এবং বরফে ঢাকা পর্বতের কারণে এই নিয়ন্ত্রণরেখার হেরফেরও ঘটতে পারে। তাই নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অনেক জায়গাতেই ভারত এবং চীনের সেনারা মাঝেমধ্যেই মুখোমুখি অবস্থানে চলে আসে।
দুই পক্ষ জোর দিয়েই একথা বলে আসছে যে চার দশক ধরে সীমান্তে কোনো গুলি চলেনি। ভারতের সেনাবাহিনীও মঙ্গলবারের সংঘর্ষে কোনো গুলি চলেনি বলে জানিয়েছে। তবে সম্প্রতি কয়েক সপ্তাহে সীমান্তে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
ভারত গালওয়ান উপত্যকায় হাজার হাজার সেনা পাঠানোর অভিযোগ করেছে চীনের বিরুদ্ধে। তাছাড়া, ভারতের অংশে ৩৮,০০০ স্কয়ার কিলোমিটার চীন দখল করে আছে বলেও অভিযোগ তাদের। গত তিন দশকে ভারত ও চীনের মধ্যে কয়েক দফা আলোচনাতেও সীমান্ত সমস্যার কোনো সমাধান বেরিয়ে আসেনি।
দু’দেশের মধ্যে এ পর্যন্ত ১৯৬২ সালে একটি যুদ্ধ হয়েছে। তাতে ভারতের শোচনীয় পরাজয় হয়েছিল। ২০১৭ সালে দুই পক্ষ আবার সংঘর্ষে জড়ায়। ওই বছর ডোকলাম বিরোধের পর সীমান্তে দু’দেশের মধ্যে এবারই সবচেয়ে বড় উত্তেজনা দেখা দিয়েছে।
গত মে মাসে লাদাখে দুই পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনায় উত্তেজনা বাড়ে। গালওয়ান উপত্যকায় চীন এবং ভারত উভয়ই বিপুল সেনা সমাবেশ করে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। গালওয়ান অঞ্চলে ভারতের সড়ক ও সেতু বানানো নিয়ে চীনের ধারাবাহিক অসন্তোষকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে দুইপক্ষের মধ্যে নতুন করে এ উত্তেজনার শুরু।
নিজেদের সীমানার ভেতর ওই সড়ক স্থানীয় জনগণের জন্য বানানো হয়েছে বলে দাবি নয়া দিল্লির। অন্যদিকে, চীনের গণমাধ্যমগুলো সীমান্তে উসকানির জন্য ভারতকে দায়ী করে আসছে।
এরই মধ্যে গেল ৫ই মে দু’দেশের সেনাসংঘর্ষের পর থেকে পূর্ব লাদাখ পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে। ওইদিন ভারত ও চীনের সেনারা সংঘর্ষে জড়িয়েছিল লোহার রড, লাঠি নিয়ে। পাথর ছোড়াছুড়িও হয়েছিল। পরে বৈঠকে কিছুটা স্বস্তি ফিরলেও ৯ই মে উত্তর সিকিমে ফের সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে দুপক্ষের সেনারা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত বছর অগাস্টে ভারত জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহারের পরেই ‘পাক অধিকৃত কাশ্মীর ও আকসাই চীনকে ভারত নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে দাবি করলে চীন অনেক বেশি চিন্তিত হয়ে ওঠে। তখন থেকেই ছক কষতে শুরু করে চীন।
সর্বশেষ মঙ্গলবারের সংঘর্ষের পর দুপক্ষ উত্তেজনা নিরসনে কি পদক্ষেপ নিচ্ছে তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ফল যাই হোক সংঘর্ষর এ ঘটনা ভারতে চীন-বিদ্বেষ আরও বাড়াবে বলেই মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
সংবাদ সূত্র : রয়টার্স, এএনআই