মানুষ খুন আর মারমুখি আচরণে মার্কিন পুলিশ বিশ্বসেরা

|| বার্তা সারাবেলা ||

অন্য অনেক কিছুর মতই পুলিশ দিয়ে মানুষ খুন, পুলিশের মারমুখি আচরণ আর কারাবন্দী করায় বিশ্বসেরা যুক্তরাষ্ট্র সরকার। বিশেষ করে বিশ্বের উন্নত দেশ হিসেবে পরিচিত জি-সাতভূক্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মানুষের ওপর পুলিশের নির্যাতন তথা পুলিশিংযে যুক্তরাস্ট্রের অবস্থান এক নম্বরে। বৈশ্বিক সম্পদ, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সূচকে এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যখন মানুষের সঙ্গে পুলিশের আচরণ এবং অপরাধ দমন ও তার বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে তুলনা করা হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের পুলিশীয় পথপদ্ধতি অনেকটাই হিংস্র। বিশেষ করে কালো বা আফ্রো-আমেরিকানদের ক্ষেত্রে।

যু্ক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর কত সংখ্যক মানুষ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়, মারা যায় কিংবা কারাবন্দী হয় তার সঠিক তথ্য পাওয়া প্রায় অসম্ভব। এরইমধ্যে কোন কোন সংস্থা আইন শৃংখলা রক্ষার নামে এই হত্যাকান্ডের পরিসংখ্যান রাখার চেস্টা করে থাকে। তেমনি একটি সংস্থা স্ট্যাটিস্টা’র তথ্যমতে চলতি বছরের ৪ঠা জুন পর্যন্ত পুলিশের নির্যাতনে ৪২৯ জন মানুষ খুন হয়েছেন। এদের মধ্যে ৯৮ জনই কালো আমেরিকান। ২০১৯ সালে এই সংখ্যা ছিল ১০০৪ জন। ১৮ সালে ৯৯৬ জন।

বিশেষ করে কালো আমেরিাকানদের এভাবে পাকড়াও করার দৃশ্য যুক্তরাষ্ট্রের শহরগুলোতে নিত্য চোখে পড়ে। ছবি : সংগৃহিত

রাষ্ট্রীয় তথ্য সংকোচন বিশেষ করে পুলিশী কার্যক্রমের তথ্য সীমিতকরণ প্রসঙ্গে এফবিআইয়ের সাবেক পরিচালক জেমস কমি ২০১৫ সালে হাউজ জুডিশিয়ারি কমিটিকে বলেছিলেন, “রাষ্ট্রিয় এমন নিপীড়ন নিয়ে আমরা কোনও ধরনের তথ্যনির্ভর ও বিশ্লেষনাত্মক আলোচনা করতে পারি না। কারণ আমাদের কাছে কোনও তথ্য-উপাত্ত নেই। গত সপ্তাহে কেউ একজন মুভি দেখতে গেলে সে তথ্য থাকছে সরকারের কাছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ গত মাসে, গত বছর বা ডেমোগ্রাফির হিসাবে কত মানুষকে গুলি করেছে সেটির তথ্য আমাদের কাছে নেই। তাই এক্ষেত্রে আমাদের অনুমান নির্ভর হওয়া ছাড়া উপায় নেই কিন্তু এর মধ্য দিয়েও নির্মম চিত্র উঠে এসেছে।

ব্যুরো অব জাস্টিস স্ট্যাটিসটিক্স (বিজেএস) এর একটি মিডিয়া রিভিউয়ে দেখা যায়, ২০১৫ সালের জুন থেকে ২০১৬ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এই ১০ মাসে গ্রেপ্তার-সম্পর্কিত সম্ভাব্য এক হাজার ৩৪৮টি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ প্রতি মাসে ১৩৫ জন বা প্রতিদিন ৪ জনের বেশি মানুষ খুন হয়েছে পুলিশের হাতে। যদিও ফেডারেল এবং ট্রাইব্যুনাল আইন প্রয়োগকারী সংস্থার খাতায় মৃত্যুর হিসাব রিভিউ পর্যায়ে বাদ দেয়া হয়েছে এবং বিজেএস স্বীকার করেছে যে এটা পুরো চিত্র নয়।

যুক্তরাজ্যের পুলিশের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করে এমন একটি সংস্থা জানিয়েছে, কাছাকাছি সময়ের মধ্যে যুক্তরাজ্যে এ ধরনের ১৩টি হত্যার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৫-১৬ সালে অস্ট্রেলিয়াতে একই ধরনের ঘটনায় মরতে হয়েছে ২১ জনকে।

অন্য অনেক উন্নত দেশের চেয়ে বেশি গুলি চালায় আমেরিকান পুলিশ

এফবিআইয়ের পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে একজন পুলিশ অফিসার জাস্টিফাইঅ্যাবল হোমোসাইডের সময় ৪০৭ জন মানুষকে গুলি করেছে। যা আগের বছরগুলোর তুলনায় কিছুটা কম। তবে হোমোসাইডের সময় পুলিশের প্রতিটি হত্যাই রেকর্ড করা হয় না এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাবে এই সংখ্যাটা আরও অনেক বেশি। যেমন ওয়াশিংটন পোস্টের হিসাবে ২০১৯ সালে মার্কিন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে দেশটির এক হাজার চারজন। তবে ম্যাপিং পুলিশ ভায়োলেন্স বলছে, এই সংখ্যাটা এক হাজার ৯৯। হাউস জুডিশিয়ারি কমিটিতে কমির মন্তব্যে এটাও পরিস্কার হয়েছে যে, এফবিআই যে সংখ্যা প্রকাশ করে তাতে সবটা জানানো হয় না।

অনেক উন্নত দেশে পুলিশের গুলি করার ঘটনা খুবই বিচ্ছিন্ন বিষয়। যেমন নিউজিল্যান্ড এবং যুক্তরাজ্যে (উত্তর আয়ারল্যান্ড বাদে) পুলিশ নিয়মিতভাবে বন্দুক বহন করে না। তবে পুলিশের গুলির শিকার হওয়ার ঘটনার দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সম্ভবত বেশি অনুসরণ করে জি সেভেনভুক্ত দেশ কানাডা। কোনও অফিসার অভিযুক্ত হলেই কেবল আনুষ্ঠানিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু সিএনএন অ্যাফ্লিয়েট সিবিসি বলছে যে, ২০০০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত কানাডায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে ৪৬১ জন।

যুক্তরাষ্ট্রে কারাবন্দির সংখ্যাও বেশি

সাধারণভাবে, অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ বেশি ক্রিমিনাল জাস্টিস সিস্টেমের মুখোমুখি হয় এবং অনেকে কারাবন্দিও হয়। ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফের হিসাবে, মাথাপিছু সংখ্যার দিক থেকেও সবচেয়ে এগিয়ে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বজুড়ে কত মানুষ কারাবন্দি রয়েছে সেটি বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করে লন্ডন ভিত্তিক এই সংস্থাটি।

যুক্তরাষ্ট্রে মাত্র চারটি শহরের বাসিন্দার সংখ্যা দেশটির কারাগারে থাকা জনগোষ্ঠীর চেয়ে বেশি। দেশটিতে ২২ লাখের বেশি মানুষ কারাবন্দি, যা ওয়াশিংটন ডিসি, বোস্টন ও মিয়ামির সম্মিলিত বাসিন্দার সংখ্যার চেয়ে বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন রাজ্যের কারাগারগুলোতে এমনি গাদাগাদি করে রাখা হয় কারাবন্দিদের। ছবি : সংগৃহিত

কারাবন্দির এই সংখ্যাটা পুরো দেশজুড়েই অনেক বেশি। প্রিজন পলিসি ইনিশিয়েটিভ জানিয়েছে, যদি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিটি রাজ্যকে একটি দেশ হিসেবে গণনা করা হতো, তাহলে দেশটির ৩১টি রাজ্যের প্রত্যেকটিই বিশ্বে মাথাপিছু কারাবন্দির হিসাবে এগিয়ে থাকতো। ওকলাহোমা, লুইজিয়ানা ও মিসিসিপিতে মাথাপিছু কারাবন্দির সংখ্যা এক হাজারের বেশি, অর্থাৎ ২০১৮ সালে ওই রাজ্যগুলোতে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে একজনের বেশি মানুষ কারাবন্দি ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে মাথাপিছু কারাবন্দির হিসাবে এত বেশি সংখ্যক প্রিজন পপুলেশন শুধু এল সালভাদরেই আছে, সেখানে প্রতি এক লাখের মধ্যে ৬১৪ জন কারাবন্দি রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের জনসংখ্যার মাত্র আটভাগ হচ্ছে কালো আমেরিকান বা আফ্রো-আমেরিকান অথচ দেশটির কারা জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশই হচ্ছে এই আফ্রো-আমেরিকান। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ১০ লাখ ৩১ হাজার ৯৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়, অর্থাৎ প্রতি ৩২ জন মার্কিনির মধ্যে একজন গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন। এই সংখ্যা যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ার চেয়ে অনেক বেশি।

পুলিশের মুখোমুখি হওয়া বা গ্রেফতারের শিকার হওয়াদের মধ্যে কালো আমেরিকানদের সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগের ঘটনা ঘটে, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে চলমান প্রতিবাদে এটি বিক্ষোভকারীদের অন্যতম একটি অভিযোগ।

পুলিশ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কালো আমেরিকানদের ওপর শক্তি প্রয়োগ করে এবং ২০১৬ সালে আমেরিকান জার্নাল অব হেলথে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, পুলিশি হস্তক্ষেপের সময় সাদা আমেরিকানদের চেয়ে কালো আমেরিকানদের খুন হওয়ার সম্ভাবনা তিন গুণ বেশি।

কালো আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডকে এভাবেই শ্বাসরোধ করে খুন করে যুক্তরাষ্ট্রের পুলিশ। ছবি : সংগৃহিত

যুক্তরাষ্ট্রে পুলিশী নির্যাতন ও খুনের রাষ্ট্রিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া বেশ কঠিন। তারপরও বিভিন্ন উদ্যোগে যেসব তথ্য মেলে তাতে উদ্বেগজনক চিত্রই ফুটে ওঠে। যা থেকে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে চলমান আন্দোলনের তীব্রতা থেকেই বোঝা যায়। যেখানে দাবি উঠেছে পুলিশিং ও বিচারিক সংস্কারের।

কালৈা আমেরিকান জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার বিচার এবং পুলিশের হাতে আফ্রো-আমেরিকানদের খুন বন্ধের দাবিতে গেল দুই সপ্তাহ ধরে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ চলছে। যাতে অংশ নিচ্ছে কালো সাদা হিস্পানিক বাদামি ও অন্য বর্ণের মানুষ। শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, এই বিক্ষোভের রেশ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বজুড়ে; এই আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে রাস্তায় নেমে এসেছে মানবাধিকার কর্মীরাও।

সংবাদসূত্র : সিএনএন ও অন্যান্য বার্তা সংস্থা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন