|| বার্তা সারাবেলা ||
ভারতে মোদি সরকারের করা নয়া কৃষি আইন বাতিল দাবিতে রাস্তার ওপর তাঁবু গেড়ে, ট্রাক্টর, ট্রাক ও বোল্ডার রেখে দেশজুড়ে সড়ক অবরোধ করেছেন দেশটির কৃষকরা। নতুন আইনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ও বিপণনব্যবস্থাকে উদারিকরণ করা হচ্ছে এই অভিযোগে আইন বাতিল দাবি করে আসছে তারা। সরকারকে এইসব আইন বাতিলে বাধ্য করতে গেলো কয়েক মাস ধরে রাজধানী দিল্লিসহ রাজ্যগুলোতেও আন্দোলন করছে কৃষক ও কৃষকসংগঠনগুলো। ধ্য করার চেষ্টা করছেন তারা। এরইমধ্যে নতুন ৩ কৃষি আইনের বিরোধিতায় যুক্ত হয়েছেন দেশের ৭৫ জন প্রাক্তন শীর্ষস্থানীয় আমলা। পাশাপাশি, কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনকারী কৃষকদের প্রতি কেন্দ্র যে মনোভাব দেখাচ্ছে, খোলা চিঠিতে তার কড়া সমালোচনা করেছেন অবসরপ্রাপ্ত ওই আইএএস-আইপিএস অফিসারেরা।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, উত্তর ভারতের ধান ও গম উৎপাদনকারী কৃষকরা প্রাথমিক প্রতিবাদ শুরু করে দিল্লির প্রান্তে জড়ো হলেও দেশজুড়ে তাদের প্রতি সমর্থন বাড়ছে। বিজেপি শাসিত নয় এমন রাজ্যগুলোতে কৃষকদের এই আন্দোলন দিনকে দিন জোরালো হচ্ছে। বাড়ছে আন্তর্জাতিক সমর্থনও।
মোদি সরকার কৃষকদের অন্য অনেক ক্ষেত্রে ছাড় দিতে রাজি হলেও গত বছর পাস করা তিনটি আইন বাতিল করবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছে। কৃষিখাতে নতুন বিনিয়োগের জন্য এসব আইন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে জানিয়ে আসছে কেন্দ্রীয় সরকারসংশ্লিষ্টরা।
প্রসঙ্গত, ভারতের দুই দশমিক নয় ট্রিলিয়ন অর্থনীতির প্রায় ১৫ শতাংশের যোগান আসে কৃষিখাত থেকে। এবং দেশটির প্রায় অর্ধেক কর্মজীবী মানুষ এই কৃষিখাতে নিয়োজিত। কিন্তু মোদি সরকারের নতুন এই কৃষিআইন কৃষি উৎপাদন ও বিপণনকে বড় বড় কর্পোরেট ক্রেতাদের ইচ্ছানির্ভর করে তুলবে বলে শঙ্কা কৃষকদের। এটি ধান ও গমের মতো খাদ্যশস্যের দাম নির্ধারণের প্রক্রিয়াকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেবে বলে মনে করছেন কৃষকরা।



প্রতিবাদের ধারাবাহিকতায় শনিবার স্থানীয় সময় দুপুর ১২টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত নয়া দিল্লি ও পাশ্ববর্তী কয়েকটি রাজ্য বাদে দেশজুড়ে তিন ঘণ্টা ধরে ‘চাক্কা জ্যাম’ বা সড়ক অবরোধ শুরু করেন আন্দোলনকারী কৃষকরা।
কৃষক আন্দোলনের অন্যতম নেতা যোগেন্দ্র যাদব টুইটারে বলেছেন, “আজ পুরো সমাজের সমর্থন কৃষকদের সাথে রয়েছে। জয় নিশ্চিত।”
রাজধানীর নয়া দিল্লির কাছে একটি সড়কে অবস্থানরত কৃষকরা হুক্কা পান করছিলেন, তখন মাইকে গান বাজছিল।
উড়িষ্যা ও কর্নাটকে সড়ক অবরোধ করে বসে থাকা কৃষকরা ব্যানার ও পতাকা হাতে নিয়ে কৃষি আইন বিরোধী শ্লোগান দেয়। তাদের হাতে থাকা কয়েকটি প্ল্যাকার্ডে তাদের ‘শত্রুজ্ঞান’ না করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে নয়া দিল্লির উপকণ্ঠে অবস্থান নেওয়া প্রায় লাখো কৃষক তীব্র ঠাণ্ডার মধ্যে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে রাত কাটাচ্ছেন। তারা এ পর্যন্ত প্রায় শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করে আসলেও ২৫শে জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লিতে ট্রাক্টর র্যালি কর্মসূচী চলাকালে কিছু কৃষক পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছিলেন।
তারপর থেকে কর্তৃপক্ষ দিল্লির আশপাশে কৃষকদের অবস্থানস্থলগুলো ঘিরে ইন্টারনেট বন্ধ করে রেখেছে এবং তাদের রাজধানীতে প্রবেশ ঠেকাতে প্রবেশপথগুলোতে ব্যাপক সড়ক অবরোধ বসিয়েছে।



ইতোমধ্যে ভারতের কৃষকদের এই আন্দোলন প্রতি বিশ্বের মনোযোগ আকৃষ্ট হয়েছে। পপ তারকা রিয়ানা ও পরিবেশ আন্দোলনকারী গ্রেটা থুনবার্গ কৃষকদের এই আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্র কৃষকদের সঙ্গে ফের আলোচনা শুরুর জন্য নরেন্দ্র মোদী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে।
কৃষক আন্দোলনে মেরুকরণ ঘটাতে চাইছে কেন্দ্র
এবার নরেন্দ্র মোদী সরকারের নয়া ৩ কৃষি আইনের বিরোধিতায় যুক্ত হয়েছেন দেশের ৭৫ জন প্রাক্তন শীর্ষস্থানীয় আমলা। পাশাপাশি, কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে আন্দোলনকারী কৃষকদের প্রতি কেন্দ্র যে মনোভাব দেখাচ্ছে, খোলা চিঠিতে তার কড়া সমালোচনা করেছেন অবসরপ্রাপ্ত ওই আইএএস-আইপিএস অফিসারেরা।
দীর্ঘ সময় ধরে কেন্দ্র ও বিভিন্ন রাজ্য সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদের দায়িত্ব সামলানো ওই প্রাক্তন আমলাদের অভিযোগ, গোড়া থেকেই আন্দোলনকারী কৃষকদের প্রতিপক্ষ ভেবে নিয়ে সঙ্ঘাতের পথে হেঁটেছে সরকার। অবিচার করা হচ্ছে কৃষকদের প্রতি। ওই চিঠিতে সই রয়েছে, প্রাক্তন আইএএস তথা সমাজকর্মী অরুণা রায়, আটের দশকে পাঞ্জাবে সন্ত্রাস দমন অভিযানের অন্যতম কর্তা, প্রাক্তন ডিজি জুলিয়ো রিবেইরো এবং দিল্লির প্রাক্তন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নাজিব জংয়ের।
কনস্টিটিউশনাল কনডাক্ট গ্রুপ (সিসিজি) নামে একটি মঞ্চের তরফে প্রকাশিত খোলা চিঠিতে সরকার ও শাসকদলের প্রতি অভিযোগ করে লেখা হয়েছে, ‘বার বার ব্যর্থ হলেও আঞ্চলিক, সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য বিভেদরেখা টেনে কৃষক আন্দোলনে বিভাজনের চেষ্টা চলছে’। এমনকি, ২৬শে জানুয়ারির ঘটনার পরে কৃষকদের এক তরফা ভাবে দোষারোপের চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
দিল্লি সীমানায় কৃষকদের অবস্থান-আন্দোলনের সূচনা পর্বেই তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছিল সিসিজি। ডিসেম্বরে কেন্দ্রের উদ্দেশে লেখা খোলা চিঠিতে প্রাক্তন সরকারি আধিকারিকরা অভিযোগ করেছিলেন, রাজ্যের এক্তিয়ারে থাকা কৃষি আইনে ব্যাপক রদবদল করে কেন্দ্র যে ভাবে বিতর্কিত ৩টি বিল পাশ করিয়েছে, তাতে সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সরাসরি আঘাত করা হয়েছে। দীর্ঘ দিনের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন ওই আমলারা সরাসরি আশঙ্ক ব্যক্ত করেন, কিছু কর্পোরেট সংস্থার স্বার্থে তিনটি আইন কার্যকর হলে এক দিকে যেমন সরকারি নিয়ন্ত্রণ সরকারি নিয়ন্ত্রণ কমবে, তেমনই বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের মজুতদারি এবং কালোবাজারির আশঙ্কাও বাড়বে।
১১ই ডিসেম্বরে দেয়া তাঁদের ওই চিঠিকে কেন্দ্র কোনও গুরুত্ব দেয়নি এবং কৃষক আন্দোলন সমাধানে প্রয়োজনীয় সক্রিয়তা দেখায়নি বলে অভিযোগ অরুণা-নাজিব-জুলিওদের।