জনগনের কাছে ক্ষমা চেয়ে পদত্যাগ করলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে

তিনি চান না তার অসুস্থতা জাপান সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করুক। তবে নতুন প্রধানমন্ত্রী আসার আগ পর্যন্ত তিনি দপ্তরে থাকবেন। আগামী মঙ্গলবার পার্লামেন্টে ভোটের মাধ্যমে জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়া হবে। যিনি আবের মেয়াদ, ‍অর্থাৎ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন।

|| সারাবেলা ডেস্ক ||

শারীরিক অসুস্থতার কথা জানিয়ে পদত্যাগ করেছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। মেয়াদ পূরণ করতে অপারগ হওয়ায় তিনি জনগণের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। ৬৫ বছরের আবে গত কয়েক বছর ধরে ‘আলসারেটিভ কোলাইটিস’ রোগে ভুগছেন। গত জুলাইয়ে তার রক্তবমি হয়। তারপর থেকে তিনি নিয়মিত চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু গত এক সপ্তাহে তাকে দুইবার হাসপাতালে যেতে হয়। সম্প্রতি তার শারীরিক অবস্থার বেশ অবনতি হয়েছে।

পদত্যাগের ঘোষণায় আবে বলেন, তিনি চান না তার অসুস্থতা জাপান সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণের পথে কোনও ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করুক। তবে নতুন প্রধানমন্ত্রী আসার আগ পর্যন্ত তিনি দপ্তরে থাকবেন। আগামী মঙ্গলবার পার্লামেন্টে ভোটের মাধ্যমে জাপানের নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়া হবে। যিনি আবের মেয়াদ, ‍অর্থাৎ ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন।

শুক্রবার স্থানীয় সময় বিকাল ৫টায় এক সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে আবে বলেন, ‘‘আমরা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় সর্বোচ্চ দক্ষতার পরিচয় দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের দেশে মৃত্যুহার ০.১ শতাংশ, তাদেরও অর্ধেকের বয়স ৮০ উপর। কোভিড-১৯ চিকিৎসায় সরকার সর্বদা কাজ করে যাচ্ছে। এরপরও আমি মনে করি, কোভিড মোকাবেলায় আরো বেশি শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন, যা আমার পক্ষে করা সম্ভব হচ্ছে না। আমার ২০ বছরের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ছিল। অনেক কিছু করার থাকলেও না করতে পারার এই দুঃখ নিয়েই আমাকে পদত্যাগ করতে হচ্ছে। করোনাভাইরাস সংক্রমণ আমার পদত্যাগের পথ সহজ করেছে। আমি দুঃখিত উত্তর কোরিয়ার বিষয়ে সফল হতে পারিনি। আমি মনে করি, এই পরিস্থিতে আমাদের নতুন শক্তিশালী নেতৃত্ব প্রয়োজন।”

দুই হাজার ৭৯৮ দিন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা শিনজো আবে বলেন, ‘‘১৩ বছর আগে আলসারাটিভ কোলাইটিস ধরা পড়েছিল। ওই সময় নতুন উদ্ভাবিত এক ঔষধ সেবন করে আমি কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠি। এরপর গত আট বছর ধরে আমি অসুস্থতা ভালভাবে মোকাবেলা করে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলাম। কিন্তু গত জুনে আমার আমার শারীরিক অবস্থা বেশ অবনতি হয়। আমি মনোবল হারিয়ে ফেলি। যদিও নতুন ঔষধ আমি সেবন করছি। এ সপ্তাহের শুরুতে আমি ফের চিকিৎসকদের কাছে গিয়েছিলাম। এই নতুন ঔষধের কার্যকারিতা চিকিৎসকরা পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে।”

এ রোগের কারণে ২০০৭ সালেও তিনি একবার পদত্যাগে বাধ্য হয়েছিলেন। ২০০৬ সালে ৫২ বছর বয়সে প্রথমবার জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন আবে। তিনি ছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের সবচেয়ে তরুণ প্রধানমন্ত্রী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জন্ম নেওয়া জাপানের প্রথম প্রধানমন্ত্রীও বটে।

জাপানের সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করা আবে দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থতার বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। কিন্তু দুর্বল স্বাস্থ্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মত এত বড় দায়িত্ব পালন করা যায় না বলে মনে করেন তিনি। আবে বলেন, ‘‘বলতে গেলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনের আত্মবিশ্বাসও আমি হারিয়ে ফেলছি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী থাকা সমিচীন হবে না। তাই আমি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়াচ্ছি। সামনে আমাদের অনেক চ্যালেঞ্জ। এ পরিস্থিতিতে রাজনীতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যদিও আমার আরও এক বছর প্রধানমন্ত্রীত্ব ছিল। তবে করোনাভাইরাসের মত কঠিন সমস্যা সমাধান করতে নতুন করে আরো বেশি দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন।”

জঙ্গিবাদ ও বহিঃশক্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য ২০১৫ সালে সংবিধান সংশোধন করে নিরাপত্তা বিল পাশ করে শিনজো আবের প্রশাসন। এই প্রসঙ্গে আবে বলেন, ‘‘আমি মনে করি দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় এ বিল অতি জরুরি ছিল। আমার বিশ্বাস জাপানিরা এই বিলের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে। আশা করি, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব এই বিলটির কার্যকরভাবে অনুসরণ করে যাবে।”

এরপর কী

আবে পদত্যাগের ঘোষণা দিলেও এখনই তা কার্যকর হচ্ছে কিনা বা উত্তরসূরি বেছে নেওয়ার আগ পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন চালিয়ে যাবেন কিনা সে বিষয়ে স্পষ্ট কোনও তথ্য এখনও পাওয়া যায়নি বলে বিবিসি জানিয়েছে।

জাপানের আইনানুযায়ী, প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিতে অপারগ হয়ে পদত্যাগ করলে একজন ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী আস্থায়ীভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। সেক্ষেত্রে উপ প্রধানমন্ত্রী তারো আসো দৌড়ে সবার আগে আছেন বলে জানায় বিবিসি। তিনি একই সঙ্গে জাপানের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বও পালন করছেন। তারপর আছেন চিফ কেবিনেট সেক্রেটারি ইওশিহিদা সুগা।

দলের নতুন সভাপতি এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে না নেওয়া পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী দায়িত্ব পালন করে যাবেন। সব কাজ চালিয়ে নিতে পারলেও তিনি নতুন নির্বাচনের ডাক দিতে পারবেন না।

পার্লামেন্টে ভোটের মাধ্যমে নতুন প্রধানমন্ত্রী বেছে নেওয়া হবে। বিজয়ী ব্যক্তি আবের মেয়াদ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন। তারপর নতুন নির্বাচন হবে।

আগামী মাসে আবের দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির নতুন নেতা (সভাপতি) নির্বাচন করার কথা। নতুন নেতা নির্বাচনের আগ পর্যন্ত দলের হাল ধরে থাকবেন বলেও জানিয়েছেন আবে।

তিনি বলেন, ‘‘ আমি ওষুধ খাচ্ছি। আমি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব ছাড়ছি। এই পরিস্থিতে এ বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য করা সঠিক হবে বলে মনে হয় না। তবে রাজনীতি থেকে আমি সম্পূর্ণ সরে যাচ্ছি না। একজন সাধারণ সদস্য হিসেবে এলডিপি-তে থাকব।”

টোকিও অলিম্পিক গেইমসের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘‘আগামী বছর যথা সময়ে অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হবে বলে আশা করছি। আগামী নেতৃত্ব এই বিষয়ে আলোচনা চালিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী থাকা কালে দেশের জনগণ যেভাবে আমাকে সমর্থন করেছে তাতে আমি তাদের সবার কাছে কৃতজ্ঞ।”

আবের রাজনীতি

আবে ১৯৯৩ সালে প্রথমবারের মতো এলডিপি’র টিকিটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কোবে স্টিল কোম্পানির এক সময়ের কর্মকর্তা আবে ২০০৬ সালে দলীয় সভাপতির দায়িত্ব পান এবং প্রথমবার জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু এক বছর পর স্বাস্থ্যগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগ করেন।

২০১২ সালের ডিসেম্বরের জাতীয় নির্বাচনে আবের দল জয়ী হয়ার পর আবারও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান তিনি। দুই বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ‘আবেনোমিক্স’ বা ‘আবেতত্ত্ব’ দেশটির অর্থনীতিকে আরও বেশি চাঙ্গা করবে বলে ফের দ্বিতীয় মেয়াদে তিনি ক্ষমতায় আসেন।

তারপর উত্তর কোরিয়ার ক্রমাগত আগ্রাসী ভাব, দেশের অর্থনৈতিতে ধস, মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট নিয়ে জনগণের অসন্তোষে আবের জনপ্রিয়তা নিম্নমুখী হয়ে পড়লে ২০১৭ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর তিনি নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দেন এবং আবারও বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ক্ষমতায় ফেরেন।

বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া

দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকার রেকর্ড গড়া এই প্রধানমন্ত্রীর আকস্মিক পদত্যাগে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিশ্বনেতাদের অনেকেই দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

অনেকে দেশে-বিদেশে আবের নানা অর্জনের প্রশংসা করে তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং সর্বোপরি সবাই তার দ্রুত আরোগ্য কামনা করেছেন।

যুক্তরাজ্য:

আবের পদত্যাগে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন টুইটারে বলেছেন,“জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে দেশ এবং বিশ্বের জন্য আবের অর্জন অসামান্য।”

“তার নেতৃত্বের আমলে বাণিজ্য, প্রতিরক্ষা এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্য-জাপান সম্পর্ক মজবুত থেকে আরও মজবুত হয়েছে। এতগুলো বছরে এই সেবার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। আমি আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করছি।”

রাশিয়া:

শিনজো আবের সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সম্পর্ক চমৎকার ছিল বলে বর্ণনা করেছেন পুতিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ। আবের পদত্যাগে ক্রেমলিন দুঃখিত বলে জানিয়েছেন তিনি।

তাইওয়ান:

তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইং ওয়েন বলেছেন, “জাপানের প্রধানমন্ত্রী আবে তাইওয়ানের প্রতি সবসময়ই বন্ধুত্বভাবাপন্ন ছিলেন। তাইওয়ানের নীতি, অধিকার কিংবা জনগণের স্বার্থ যাকিছুই হোক না কেন –সেসব ক্ষেত্রেই তিনি ছিলেন খুবই ইতিবাচক। তাইওয়ানের প্রতি তার এই বন্ধুবাৎসল্যকে আমরা মূল্য দেই; তার সুস্বাস্থ্যও কামনা করি।”

দক্ষিণ কোরিয়া:

দীর্ঘমেয়াদে ক্ষমতায় থাকা শিনজো আবের গুরুত্বপূর্ণ অনেক অবদানের কথা স্মরণ করে তার হঠাৎ পদত্যাগের ঘোষণায় দুঃখ প্রকাশ করেছে দক্ষিণ কোরিয়া।

দক্ষিণ কোরিয়া-জাপান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়নে আবের বড় ধরনের ভূমিকা থাকার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করা হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার পক্ষ থেকে দেওয়া বিবৃতিতে।

আবের দ্রুত আরোগ্যও কামনা করা হয়েছে বিবৃতিতে। সেইসঙ্গে জাপানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে দেশটির নতুন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সঙ্গে সহযোগিতার ভিত্তিতে দক্ষিণ কোরিয়া সরকার কাজ করে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন