|| বার্তা সারাবেলা ||
করোনা সংক্রমণ নিয়ে যখন কি না বেসামাল বিশ্বমানুষ তখন আরো বেশী জনবিরুদ্ধ হয়ে উঠছে ধনবাদী রাষ্ট্রগুলোর নির্বাহীরা। জনবিরুদ্ধতার পথপদ্ধতি বাস্তবায়নে সবথেকে আগে খড়গ বসানো হচ্ছে গণমাধ্যমের ওপর। বিশেষ করে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণের অনেকটা বাইরে থাক সামাজিক মাধ্যম বা স্যোশাল মিডিয়ার তৎপরতা সীমিত ও নিয়ন্ত্রণ করতে উঠে পড়ে লেগেছে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতির মোড়ল খ্যাত যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সরকার প্রধানরা।
শুধু উন্নত ধনবাদী রাষ্ট্রগুলোই নয়, এই পথে পা বাড়িয়েছেন উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানরাও। ভারত ও বাংলাদেশের মত অনেক রাষ্ট্রেই সাইবার ও ডিজিটাল নিরাপত্তা বিধানে প্রণীত আইনের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে বিরুদ্ধমত দমনে। যে আইনে সবচে বেশী ভোগান্তিতে পড়ছেন সংবাদকর্মীরা।
ট্রাম্প কেন ক্ষেপেছেন
বিশ্বজুড়ে করোনা সংক্রমণের এই মহামারিতেও নিজেদের মানুষবিরুদ্ধতার উৎকট প্রকাশ দেখাতে শুরু করেছে ধনবাধী রাষ্ট্রগুলো। যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার (!) ধারাবাহিকতায় এতোদিন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে দেয়া বেশকিছু আইনি সুরক্ষা থাকলেও দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আদেশের মধ্য দিয়ে সেগুলো বাতিল হতে চলেছে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর মার্কিন অধিপতির এমন গোস্বার কারণটা তৈরি হয় তাঁর প্রথম নির্বাচনী প্রচারণার সময় থেকেই। তখন থেকেই নানা রকম ‘মিথ্যা’ ‘সত্যি’ ‘আধাসত্যি’ তথ্য নিজের পক্ষের প্রচারনায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে আসছিলেন মার্কিন অধিপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কর্তাব্যক্তিরা মাঝে মধ্যেই নানা রকম পদক্ষেপ ও সতর্কবার্তা দিলেও তাতে গা করেননি তিনি।
তবে সম্প্রতি টুইটার কর্তৃপক্ষ ট্রাম্পের দুটি টুইটে ‘তথ্যের সত্যতা যাচাই’ সংক্রান্ত ট্যাগ লাগিয়ে দেয়ার পর বেশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট। আর তারই ফলস্বরূপ বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইনী সুরক্ষা বাতিলের লক্ষ্যে নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেন ক্ষুব্ধ মার্কিন অধিপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। স্বাক্ষরের সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্মগুলো ‘অবারিত ক্ষমতা’ ভোগ করছে বলেও অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প।
এদিকে বিবিসি জানিয়েছে, ট্রাম্পের এই আদেশের ফলে ফেইসবুক ও টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেভাবে নিজেদের প্লাটফর্মে তদারকি বজায় রাখে, তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রিয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে আইনী ব্যবস্থা নেয়ার বৈধতা ও সুযোগ পাবে।
বিবিসি বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের কমিউনিকেশনস ডিসেন্সি অ্যাক্টের অনুচ্ছেদ ২৩০ এর কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে সাধারণত তাদের প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীদের দেয়া পোস্ট বা কমেন্টের জন্য দায়ী করা হয় না।
ওই অনুচ্ছেদে প্রাপ্ত সুবিধায় স্যোশাল মিডিয়াগুলোও তাদের দৃষ্টিতে অশ্লীল, হয়রানিমূলক কিংবা সহিংস কন্টেন্ট সরিয়ে নেয়া অথবা ব্লক করারও সুযোগ পেত।সেই কমিউনিকেশনস ডিসেন্সি অ্যাক্টের ধারা ২৩০ এর সংশোধন কিংবা একেবারে বাতিলে কংগ্রেসে বিল আনতেও বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
যেসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তাদের প্ল্যাটফর্মে ব্যবহারকারীর কন্টেন্ট সম্পাদনা করবে, তাদের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনী সুরক্ষা তুলে নিতে সুপারিশও করা হয়েছে ট্রাম্পের আদেশে। বলা হয়েছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো তাদের ওয়েবসাইটে থাকা শর্তের বাইরেও বিভিন্ন পোস্টকে যেভাবে ‘বিভ্রান্তিকর’ অ্যাখ্যা দিয়ে ব্লক করছে, তার আইনী সুরক্ষা থাকা উচিত নয়।
টুইটারসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিরুদ্ধে লাগাতার পক্ষপাতদুষ্টতার অভিযোগ করে আসা মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুধবারই স্যোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মকে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছিলেন।
ট্রাম্পের অভিযোগ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো নিয়মিতভাবে রাষ্ট্রের রক্ষণশীল মতের উপর কাঁচি চালিয়ে আসছিল। তার দুটি টুইটে ‘ফ্যাক্ট চেক’ লিংক সংযুক্ত হওয়ার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট বুধবার টুইটারের বিরুদ্ধে আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হস্তক্ষেপেরও অভিযোগে তুলেছেন।
অবশ্য কেবল ট্রাম্পের টুইটেই নয়, বৃহস্পতিবার টুইটার কর্তৃপক্ষ নতুন করোনাভাইরাসের উৎপত্তি যুক্তরাষ্ট্রে বলে দাবি করা চীনের এক সরকারি মুখপাত্রের দুটি টুইটেও ‘কোভিড-১৯ সংক্রান্ত তথ্য জানুন’ সংক্রান্ত ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে।
এদিকে ট্রাম্পের আদেশের পরপরই দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার বলেছেন, আদেশটি কংগ্রেসে ভোটের জন্য তুলতে শিগগিরই এ সংক্রান্ত বিলের খসড়া লেখার কাজ শুরু করবেন তিনি।
আইনী বাধায় পড়তে পারে ট্রাম্পের আদেশ
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্টের নির্বাহী এই আদেশ আইনী বাধার মুখে পড়তে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট বিশেসজ্ঞরা বলছেন, স্যোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এখন যেসব আইনী সুরক্ষা পাচ্ছে, তা পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মার্কিন কংগ্রেস কিংবা আদালতকে অবশ্যেই হস্তক্ষেপ করতে হবে।
রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টের টুইটে ‘ফ্যাক্ট চেকিং’ ট্যাগ লাগিয়ে হইচই বাঁধিয়ে দেয়া টুইটার বলেছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থেকে উৎসারিত কমিউনিকেশন্স ডিসেন্সি অ্যাক্টের ধারা ২৩০ মার্কিন উদ্ভাবন ও বাকস্বাধীনতাকে সুরক্ষা দিয়ে আসছে। ইউটিউবের স্বত্বাধিকারী গুগল বলছে, কমিউনিকেশন্স ডিসেন্সি অ্যাক্টের ধারা ২৩০এর পরিবর্তন মার্কিন অর্থনীতি ও ইন্টারনেট স্বাধীনতায় যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
বুধবার ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ফেইসবুক প্রধান মার্ক জাকারবার্গ বলেন, সেন্সরশিপের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন কোনো সরকারের জন্য সামাজিক মাধ্যমকে সেন্সর করা “ঠিক হবে না”।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে ট্রাম্পের এ নির্বাহী আদেশ বাক স্বাধীনতার উপর ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে বলে রক্ষণশীলদের একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্কও সতর্ক করেছে। থিঙ্ক ট্যাংকটির কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, আইনী সুরক্ষা তুলে নিলে স্যোশাল মিডিয়াগুলো তাদের প্ল্যাটফর্ম থেকে পর্নোগ্রাফি, বর্ণবাদী বিষয়বস্তু কিংবা হিংসাত্মক ছবি সরাতে সমস্যায় পড়তে পারে।
বাড়ছে রাষ্ট্রসমর্থিত ‘ভাড়ায় খাটা’ হ্যাকার
শুধু রাষ্ট্রপ্রধানদের এমন উদ্যোগেই থেমে থাকছে না তথ্য সংকোচন ও নিয়ন্ত্রণের এমন রাষ্ট্রিক তৎপরতা। বেড়েছে বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার অ্যাকাউন্ট লক্ষ্য করে রাষ্ট্র সমর্থিত হ্যাকিংও। গুগল বলছে, কোভিড-১৯ সংক্রমণসময়ে রাষ্ট্রসমর্থিত হ্যাকিং বা সাইবার হামলা আগের থেকে অনেক বেড়েছে।
গেল বুধবার গুগল জানায়, মারসেনারি তথা ‘ভাড়ায় খাটে এমন’ হ্যাকার প্রতিষ্ঠানগুলো এমন নতুন কার্যক্রমে নেমেছে বলে দেখতে পেয়েছে তাদের ‘থ্রেট অ্যানালিসিস গ্রুপ’। বিশেষ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় আড়িপাতার জন্য হ্যাকার প্রতিষ্ঠানবগুলো বেশ কিছু জিমেইল অ্যাকাউন্ট তৈরি করেছে। যার মধ্যে অনেকগুলোই ভারতের বলে প্রতিবেদনে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
চলতি বছর এপ্রিলেই হ্যাকারদের বানানো এমন ১৭৫৫টি অ্যাকাউন্টে সতর্ক বার্তা পাঠিয়েছেন গুগল বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই অ্যাকাউন্টগুলোর মাধ্যমে আর্থিক সেবা, পরামর্শক এবং স্বাস্থ্যসেবার মতো সংস্থাগুলোর নেতাদেরকে লক্ষ্য বানানো হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, স্লোভেনিয়া, কানাডা, ভারত, বাহরাইন, সাইপ্রাস এবং যুক্তরাজ্যসহ বেশ কিছু দেশের সংস্থাকে লক্ষ্য করে হ্যাকিং চেষ্টা চালানো হয়েছে বলে জানিয়েছে গুগল।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বৈশ্বিক প্রচেষ্টার কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং অন্যান্য সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান। মহামারীর তথ্য হাতিয়ে নিতে এই সংস্থাগুলোর ওপর সাইবার হামলাও বেড়েছে অনেকখানি।
সংবাদসূত্র : বয়টার্স ও বিবিসিসহ অন্যান্য বার্তা সংস্থা