অপরাধের প্রমাণ মেলায় এমপি পাপুল কারাগারে বরখাস্ত কুয়েতি সহযোগিরা

|| বার্তা সারাবেলা ||

বাংলাদেশি আইনপ্রণেতা তথা সংসদ সদস্য মোহাম্মদ কাজি শহিদ ইসলাম পাপুলের বিরুদ্ধে মানুষ পাচার, অর্থ পাচার, এবং প্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতারণা ও তাদেরকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবার মত অপরাধের প্রমাণ মিলেছে। তাকে নেওয়া হয়েছে কারাগারে।

এই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে গঠিত কুয়েতি বিচারবিভাগীয় তদন্তের বরাত দিয়ে উপসাগরীয় সংবাদপত্র গালফ নিউজ বলছে, গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে তার এসব অপরাধের সঙ্গে কুয়েতের এমপি, সরকারি কর্মকর্তা ও পুলিশ কর্মকর্তাসহ বেশ অনেকজনের সংশ্লিষ্টতার কথা জানিয়েছেন এমপি পাপুল।

এদিকে কাজি শহিদ পাপুল কুয়েতের যেসব বড় কর্মকর্তাকে বিলাশবহুল গাড়ী ও মোটা টাকা ঘুষ দিয়ে কাজ বাগাতেন তাদেরকে বরখাস্ত ও বিচারের আওতায় নেওয়ার কথা জানিয়ে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস আল সালেহ বলেছেন, তারা ইতোমধ্যেই ভিসা জালিয়াতি ও মানুষ পাচারের সঙ্গে বাংলাদেশের আইন প্রণেতা কাজি শহিদ পাপুলের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছেন।

এই জালিয়াত কাজে কুয়েতের বেশ কয়েকজন ‘সরকারি কর্মকর্তা’ও জড়িত বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি তাঁর টুইটে লেখেন, “এশিয়ান এক প্রবাসী ব্যবসায়ির নেতৃত্বে মানুষ পাচারের বড় এই জালিয়াতির প্রমাণ মেলাতে গেল কয়েক সপ্তাহ ধরে ‘ব্যাপক অনুসন্ধান’ চালিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।”

তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের অনুসন্ধানে বেশ কিছু সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনের খোঁজ মিলেছে, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর হয়ে যা করে দিয়েছে সরকারি কর্মকর্তাদের একটি নেটওয়ার্ক। কুয়েতের সরকারি কর্মর্কর্তাদের এই নেটওয়ার্ক ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজস করে এসব আর্থিক লেনদেন, ভিসা জালিয়াতি ও মানুষ পাচারের অন্যতম প্রধান কাজি শহিদ পাপুলকে ইতোমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এবং তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “এই জালিয়াতির সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা কিংবা প্রভাবশালী মানুষ যাদেরই সংশ্লিষ্টতা মিলবে তাদেরকেই জিজ্ঞাসাবাদ এবং আইনিপ্রক্রিয়া শেষ করার সুবিধার্থে তাদেরকে বিচার প্রক্রিয়ায় আনা হবে। তবে ঠিক কতজন বা কারা এই জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানাননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আনাস আল সালেহ।

এদিকে এই জালিয়াতি ও মানুষ পাচারের সঙ্গে কুয়েতি সরকারি কর্মকর্তা, আইন প্রণেতা, পুলিশ কর্মকর্তাসহ জড়িত সবার নাম প্রকাশের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন দেশটির আইনপ্রণেতা ও নাগরিক সমাজ।

স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এই জালিয়াতি করতে গিয়ে বাংলাদেশী সংসদ সদস্য কাজি শহিদ পাপুল কমপক্ষে তিনজন কুয়েতি এমপির সঙ্গে আর্থিক লেনদেন করেছেন। এই তিন এমপির মধ্যে দুইজন বর্তমান সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন।

তবে অভিযুক্ত তিন কুয়েতি আইনপ্রণেতার মধ্যে দুইজন এই জালিয়াতির সঙ্গে তাদের কোন ধরণের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করেছেন। এমপি মোহাম্মদ হায়েফ নিজের কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে বলেছেন, তাকে নিয়ে যদি কোন প্রামাণিক তথ্য বা দলিলাদি থেকে থাকলে তা যেনো আদালতে দাখিল করা হয়।

নিজের মক্কেলকে জড়িয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা লেখালেখি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে মামলা করার হুমকি দিয়েছেন আরেক এমপির আইনজীবী।

দেশটির স্থানীয় সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত খবর বলছে, গ্রেফতার বাংলাদেশী আইনপ্রণেতার(?)নেতৃত্বাধীন নেটওয়ার্ক বাংলাদেশীদের কাছে চড়া দামে ভিসা বিক্রি করতো। অনেক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বলছে, এই জালিয়াতি ও ভিসা ব্যবসা করতে গিয়ে বাংলাদেশী এমপি কুয়েতের একশ সরকারসংশ্লিষ্ট ও প্রভাবশালী নাগরিককে বিলাসবহুল গাড়ি ও লক্ষ লক্ষ কুয়েতি দিনার ঘুষ দিয়েছেন। এমন কি অনেক কুয়েতিকে নিজের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের অংশীদারও করেছেন বাংলাদেশী ঐ এমপি।

বিচারবিভাগীয় তদন্তদলের কাছে এমপি পাপুলের স্বীকারোক্তি

এসব অপরাধ করতে গিয়ে এমপি পাপুল কুয়েত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তাকে চেকের মাধ্যমে ১১ লাখ কুয়েতি দিনারের সমপরিমান তিন লাখ ৫৮ হাজার মার্কিন ডলার দিয়েছেন। এই চেকের একটি ফটোকপিও তদন্ত কর্মকর্তাদের কাছে দাখিল করেছেন এমপি পাপুল। আর এই অর্থের বিনিময়ে ঐ কর্মকর্তা পাপুলের অফিসে গিয়ে অবৈধ লেনেদেনের অফিসিয়াল ডকুমেন্টে সই করেছেন বলেও স্বীকার করেছেন পাপুল।

এমপি পাপুল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঐ পরিচালকের সংশ্লিষ্টতার কথা জানিয়ে গোয়েন্দাদেরকে এও বলেছেন, ঐ কর্মকর্তা তাঁর ক্লিনিং কোম্পানিতেও গিয়েছিলেন। এবং যাওয়ার আগে কোম্পানিতে কর্মরত সব কুয়েতি কর্মীকে চাকরি থেকে বাদ দিতে বলেন, যাতে কেউ তাকে(কর্মকর্তা)চিনতে না পারে।

বাংলাদেশি শ্রমিকদের কুয়েতে আসার পথ করে দেওয়ার বিনিময়ে আরেক কর্মকর্তাকে দশ লাখ দিনারের সমপরিমাণ সোয়া তিন লাখ মার্কিন ডলার নগদ দিয়েছেন। এছাড়া আরেকজন কর্মকর্তাদের কয়েক লাখ দিনার ঘুষ দিয়েছেন। এমপি পাপুল জিজ্ঞাসাবাদে এসব তথ্য স্বীকার করে বলেছেন, এদের বাইরেও কাজ বাগিয়ে নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন পরিচালক ও তার সহকর্মীকেও বিপুল পরিমাণ অর্থ দিতে হয়েছে তাকে।

শুধু নগদ অর্থই নয়, কুয়েতের বেশ কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তাকে পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়িও উপহার দিয়েছেন এমপি পাপুল। যার বিনিময়ে তিনি কুয়েতে তার কোম্পানির পক্ষে বিভিন্ন ব্যবসায়িক চুক্তি করিয়ে নিয়েছেন।

পাপুলের সঙ্গে আর যারা জড়িত

দেশের একজন আইনপ্রণেতা (?) পাপুলের মানুষবিরুদ্ধ এমন কাজে শুধু তিনি একাই নন, তাঁর সঙ্গে আরো একজন বাংলাদেশি সংসদ সদস্য এবং তাঁর স্ত্রী আরেক (সংরক্ষিত নারী আসন) সংসদ সদস্য সেলিনা ইসলামও জড়িত রয়েছেন। কুয়েতের সংবাদপত্র আল কাবাস এ তথ্য প্রকাশ করে জানিয়েছে, কুয়েতে তিনটি কোম্পানির মালিকানা রয়েছে এই তিন জনের নামে। যে সব কোম্পানিতে কাজ করানোর নামে বিশ হাজারেরও বেশী শ্রমিককে বাংলাদেশ থেকে আনা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে এদের কাছ থেকে পঞ্চাশ মিলিয়ন কুয়েতি দিনারের সমপরিমান ১৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নিয়েছেন এই তিনজন।

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে আরো বলা হচ্ছে, কুয়েতে নিবন্ধিত কোম্পানি মারাফি কুয়েতিয়ার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও কাজি মোহাম্মদ শহিদ ইসলাম পাপুল যুক্তরাষ্ট্রেও এক মার্কিন নাগরিকের সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে একটি কোম্পানি খুলেছেন। এবং কুয়েতে মানুষ পাচার থেকে পাওয়া সব অর্থ সেখানে বিনিয়োগ করেছেন।

বাংলাদেশি শ্রমিকদের সাক্ষ্য

বিচারবিভাগীয় এই তদন্ত কাজে ইতোমধ্যেই ১২ জন বাংলাদেশি শ্রমিক সাক্ষ্য দিয়েছেন, যারা বিপুল পরিমান অর্থের বিনিময়ে পাপুলের মাধ্যমে কুয়েতে এসেছেন।

বিচারবিভাগীয় তদন্ত প্রক্রিয়ার ঘনিষ্ট সূত্রের বরাতে স্থানীয় সংবাদপত্র আল রাই জানিয়েছে, গোয়েন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদে বাংলাদেশী এমপি পাপুল তাঁর বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ স্বীকার করেছেন। এসব শ্রমিক জানিয়েছেন, কুয়েতে আনার জন্য পাপুল ও তার লোকজন তাদের কাছে থেকে জনপ্রতি তিন হাজার কুয়েতি দিনার করে নিয়েছেন। এবং চাকরি ও ভিসা নবায়নের জন্য প্রতি বছর একটা বড় অঙ্কের টাকাও দিতে হতো পাপুলকে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন