ছিয়াশিতে জীবনের শেষ টানলেন সৌমিত্র

‘সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজের সুবাদে সবচেয়ে বেশি পরিচিত সৌমিত্র। লিজিয়ঁ অব অনার, দাদাসাহেব ফালকে, বঙ্গভূষণ, পদ্মভূষণ এবং জাতীয় স্তরে আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ওঁর পরিবার, চলচ্চিত্র জগতের কলাকুশলী এবং অনুরাগীদের সমবেদনা জানাই’।

|| বার্তা সারাবেলা ||

হাসপাতালে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর চলে গেলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মহাতারকা, অভিনেতা-নাট্যকার-বাচিকশিল্পী-কবি-চিত্রকর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। গতকাল রোববার দুপুর সওয়া ১২টায় মধ্য কলকাতার বেলভিউ নার্সিংহোমে মারা যান তিনি।
নোভেল করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে গেলো সেপ্টেম্বের বেলভিউতে ভর্তি হন সৌমিত্র। তিনি একটা সময়ে ক্যানসারেও আক্রান্ত হয়েছিলেন। সেই অসুস্থতা স্বভাবতই তাঁকে পুরোপুরি ছেড়ে যায়নি। ফলে কখনও উন্নতি কখনও অবনতি, এই দোলাচলেই চলছিল হাসপাতাল-বন্দি সৌমিত্রর জীবন। এ ছাড়াও একাধিক কোমর্বিডিটি ছিল তাঁর। তার জেরে সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতির অবনতি হতে শুরু করে তাঁর। তবুও প্লাজমা থেরাপি, শ্বাসনালিতে অস্ত্রপচার-সহ নানা ভাবে অভিনেতাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন চিকিৎসকেরা।

কিন্তু শুক্রবার সৌমিত্রর শারীরিক অবস্থার আশঙ্কাজনক অবনতি ঘটে। হৃদযন্ত্র আর কিডনির জটিলতা অনেকটা বেড়ে যায়। বেড়ে যায় ‘হার্ট রেট’। সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। চিকিৎসকরা জানিয়ে দেন, অলৌকিক কিছু না ঘটলে সৌমিত্রের সুস্থ হয়ে ওঠা অসম্ভব। তার পরই দুশ্চিন্তার ছায়া নেমে আসে অনুরাগীদের মধ্যে। রাতভর সেই নিয়ে টানাপড়েনের পর এ দিন সকাল হতেই হাসপাতালে পৌঁছে যান সৌমিত্রর পরিবারের লোকজন। কিছুক্ষণ পর হাসপাতাল থেকে বেরিয়েও যান তাঁরা। কিন্তু পরক্ষণেই হাসপাতালের তরফে ফের ডেকে পাঠানো হয় তাঁদের। তবে সেইসময় বাবার পরিস্থিতি নিয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি সৌমিত্র-কন্যা পৌলমী। পরে কলকাতার সংবাদমাধ্যমকে ফোনে বলেন, ‘‘বাবার স্বাস্থ্য নিয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হবে। তার পর এ নিয়ে কোনও মন্তব্য করব আমরা। চিকিৎসকেরা ওখানে থাকতে বলেছেন আমাদের।’’

এর কিছুক্ষণ পরেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দেন, অশীতিপর অভিনেতার মৃত্যু হয়েছে। ইতিমধ্যেই বেলভিউ পৌঁছে যান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। পৌলমীকে সঙ্গে নিয়ে সেখানে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন তিনি। পৌলমী বলেন, ‘‘দুপুর ২টোয় প্রথমে গলফগ্রিনের বাড়িতে নিয়ে যাবো বাবাকে। তার পর টেকনিশিয়ান স্টুডিও হয়ে রবীন্দ্র সদনে নিয়ে যাওয়া হবে। সেখান থেকে কেওড়াতলা শ্মশানের উদ্দেশে রওনা দেব আমরা। দিদি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ আমরা। এত যত্ন করে, ভালবেসে, সম্মানের সঙ্গে বাবাকে আগলে রেখেছিলেন সকলে। বাবা চিরকাল আমাদের মনে রয়ে যাবেন।’’

আপ্রাণ চেষ্টা সত্তে¡ও সৌমিত্রকে ধরে রাখতে পারলেন না বলে বেলভিউয়ে দাঁড়িয়ে আক্ষেপ করেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। টুইটারে তিনি লেখেন, ‘ফেলুদা আর নেই। অপু আমাদের বিদায় জানিয়েছেন। বিদায় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। উনি এক জন কিংবদন্তী। বাংলা, ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র একজন মহান অভিনেতাকে হারালো। ওঁকে খুব মিস করবো আমরা। বাংলা চলচ্চিত্র জগৎ অভিভাবকহীন হয়ে গেল’।

মুখ্যমন্ত্রী আরও লেখেন, ‘সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজের সুবাদে সবচেয়ে বেশি পরিচিত সৌমিত্র। লিজিয়ঁ অব অনার, দাদাসাহেব ফালকে, বঙ্গভূষণ, পদ্মভূষণ এবং জাতীয় স্তরে আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। অনেক বড় ক্ষতি হয়ে গেল। অত্যন্ত বেদনাদায়ক। ওঁর পরিবার, চলচ্চিত্র জগতের কলাকুশলী এবং অনুরাগীদের সমবেদনা জানাই’।

১৯৩৫ সালে ১৯শে জানুয়ারি নদীয়ার কৃষ্ণনগরে এক সাংস্কৃতিক পরিবাওে সৌমিত্রর জন্ম। বাবা মোহিত কুমার চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আইনজীবী ও মঞ্চঅভিনেতা। মা আশালতা চট্টোপাধ্যায়ও যুক্ত ছিলেন মঞ্চনাটকে; তিনি স্থানীয় নাটকের দল ‘প্রতিকৃতি’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন।

সৌমিত্রর স্কুলজীবন কেটেছে কৃষ্ণনগরের সেন্ট জোনস বিদ্যালয়ে। কলকাতা সিটি কলেজ থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করার ফাঁকেই নির্দেশক অহীন্দ্র চৌধুরীর হাত ধরে মঞ্চনাটকে তার অভিষেক।
উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘কিং লেয়ার’ অবলম্বনে সুমন মুখোপাধ্যায়ের ‘রাজা লিয়র’ নাটকে নামভূমিকায় অভিনয় করে দারুণ প্রশংসিত হন সৌমিত্র। অনেকের বিচারে সেটাই ছিল মঞ্চে তার সেরা অভিনয়।
শুরুতে আবৃত্তি ও মঞ্চনাটকে ব্যস্ত সৌমিত্র চলচ্চিত্র নিয়ে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। তবে সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ তার মন বদলে দেয়। অপু ট্রিলজির দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘অপরাজিত’র অপু চরিত্রের জন্য অভিনয়শিল্পী খুঁজছিলেন সত্যজিৎ রায়। আর সত্যজিতের সহকারী নিত্যানন্দ দত্তের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল সৌমিত্রর।

সেই সূত্রে অডিশন দিতে গেলেও চরিত্রের সঙ্গে বয়সের তারতম্যের কারণে সেবার সুযোগ মেলেনি তার। তবে সৌমিত্রকে মনে ধরেছিল সত্যজিতের। ১৯৫৯ সালে অপু ট্রিলজির শেষ চলচ্চিত্র ‘অপুর সংসার’ এ তরুণ অপুর চরিত্রে সৌমিত্রকেই তিনি বেছে নেন। সেই সিনেমায় সৌমিত্রের সঙ্গে অভিষেক ঘটে ১৩ বছর বয়সী শর্মিলা ঠাকুরের। সিগারেটের প্যাকেটে লেখা ‘খাওয়ার পর একটা করে, কথা দিয়েছ’র মতো দৃশ্য আর সৌমিত্র-শর্মিলা জুটির সেই রসায়ন দর্শকের মনে এখনও অমলিন।
সত্যজিতের ৩৪টি সিনেমার মধ্যে ১৪টিতেই অভিনয় করেছেন সৌমিত্র। অপুর পর সত্যজিতের সৃষ্টি আরেক চরিত্র ফেলুদাকে সিনেমার পর্দায় সৌমিত্র নিয়ে গেছেন অন্য মাত্রায়।

ছয় দশকের ক্যারিয়ারে তিনশর বেশি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন এই শিল্পী। মৃণাল সেন, তপন সিনহা, তরুণ মজুমদার, গৌতম ঘোষ, ঋতুপর্ণ ঘোষ, অপর্ণা সেনদের সঙ্গেও কাজ করেছেন। সাত পাকে বাঁধা, চারুলতা, বাক্স বদল, আকাশ কুসুম, মণিহার, কাঁচ কাটা হীরে, ঝিন্দের বন্ধী, অরণ্যের দিনরাত্রি, সোনার কেল্লা, জয় বাবা ফেলুনাথ, হীরক রাজার দেশে, ঘরে বাইরে, আবার অরণ্যের মত সিনেমার মধ্য দিয়ে সৌমিত্র স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন দর্শকের হৃদয়ে।
অভিনয় ছাড়াও নাটক ও কবিতা লিখেছেন তিনি, যুক্ত হয়েছেন মঞ্চ নাটকের নির্দেশনায়, দ্যুতি ছড়িয়েছেন আবৃত্তির মঞ্চেও।

চলচ্চিত্রে ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার ছাড়াও ফ্রান্স সরকারের ‘লিজিয়ন অব দ্য অনার’ পদকে ভূষিত হয়েছেন এই অভিনেতা। ২০০৪ সালে তাকে ‘পদ্মভূষণ’ খেতাবে ভূষিত করে ভারত সরকার। ধর্মের নামে গোঁড়ামি ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ভারতের প্রাচীন রাজনৈতিক দল কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (মাক্সবাদী) সমর্থক ছিলেন, তিনি ছিলেন বিজেপি সরকারের কড়া সমালোচকদের একজন। দুর্গা পূজার সময় তিনি হাসপাতালে থাকা অবস্থায় সিপিএম এর মুখপত্রের শারদ সংখ্যায় তার শেষ লেখাটি প্রকাশিত হয়। সেখানে সৌমিত্র লেখেন, বামপন্থীদের নিয়ে সংশয় থাকলেও এখনও বামপন্থাকেই বিকল্প হিসেবে দেখেন তিনি।

সিপিআইএম-এর নেতা, ভারতের ইতিহাসের দীর্ঘমেয়াদে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব সামলানো জ্যোতি বসুর সঙ্গেও সখ্যতা ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের; ছেলেবেলায় কাকার হাত ধরে জ্যোতি বসুর বিভিন্ন সভায় হাজির হওয়ার স্মৃতি বিভিন্ন লেখায় তিনি তুলে ধরেছেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের স্ত্রী দীপা চট্টোপাধ্যায়ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে জড়িয়ে আছেন। তাদের ছেলে সৌগত চট্টোপাধ্যায় একজন কবি; আর মেয়ে পৌলমী বসুর ছেলে রণদীপ বসু টালিগঞ্জের উদীয়মান অভিনেতাদের একজন।

সংবাদসূত্র: আনন্দবাজার ও বিডিনিউজ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন