|| ডা. শামীম তালুকদার ||
নীরব এক ঘাতকের নাম ‘হাইপারটেনশন’ বা উচ্চ রক্তচাপ। এই একটি কারণে হার্ট অ্যাটাক, ডায়াবেটিস, হার্ট ফেইলিওর ও দৃষ্টিহীনতার মতো মারাত্মক সমস্যা দেখা দেয়। বর্তমানে এমন একটি পরিবার খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যে সেখানে উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন এমন কোন রোগী নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রোগটির ভয়াবহতার মাত্রা অন্যান্য রোগের তুলনায় অনেক বেশি হলেও মানুষের মধ্যে এটি নিয়ে তেমন কোনো সচেতনা দেখা যায় না । উচ্চ রক্তচাপ নিজে যেমন মারাত্মক তেমনি অনেক নন-কমিউনিকেবল ডিজিজ বা অসংক্রামক রোগের পথ প্রসারিত করে দেয়। যার ফলে, একই সাথে উচ্চ রক্তচাপ ও অসংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সারাজীবন ভুগতে হয়। ওষুধ খাওয়া চালিয়ে যেতে হয় মৃত্যু অবধি।
করোনা কালে ‘হাইপারটেনশন’ নিয়ে আমাদের টেনশন করার সময় না থাকলেও করোনা আমাদের প্রত্যাহিক জীবনকে যারপর নাই বিপর্যস্ত করে তুলেছে। অভাব, অনটন, লকডাউন, কর্মহীনতা, স্বাভাবিক চলাফেরায় বাঁধা ইত্যাদি কারণেদুশ্চিন্তা বেড়ে গিয়ে উচ্চ রক্তচাপের পরিসর আশঙ্কাজনক হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে কমবয়সীরা। সবচেয়ে বেশি জটিলতায় পড়ে গরীব ও মধ্যবিত্তরা। দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতি সবচেয়ে ভয়াবহ অবস্থায় বিরাজ করছে। অতিমারি এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার নামে লকডাউন থেকে কঠোরতর শাটডাউনে অভাবী মানুষেরাই বিপদে পড়ছেন। তার উপর উচ্চ রক্তচাপের আধিক্যে বিপর্যয়কে সঙ্গে করেই জীবন টেনে নিচ্ছেন অনেক খেটে খাওয়া মানুষ।
আমীর শিকদার। বয়স ৩৫। পেশায় শ্রমিক। পাঁচ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। হাইপারটেনশনে ভুগছেন দেড় বছর হলো। এর উপর আবার এ বছরের মে মাসে ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে। মাসখানেক আগে থেকে শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। গ্যাস্ট্রিক ইরিটেশনের সমস্যাও প্রকট। বংশে একজন ব্যক্তি মা শুধু ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। প্রথমে শুধু হাইপারটেনশনের সমস্যা থাকলেও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় নাকাল হয়ে পড়েছেন। লিসিনোপ্রিল, ম্যাটেপ্রোলন, লোসারটেনসহ আরো কয়েকটি ওষুধ নিতে হয়। মাসে সাত থেকে আট হাজার টাকার ওষুধ লাগে। ডায়াবেটিস চিকিৎসার অংশ হিসেবে নতুন যুক্ত হয়েছে লেজিনটা, সেক্রিন, সারজেল, ভিন্টা ডি, কার্ডিজেম, ম্যাক্স-ডি, এ্যারেভেন্ট, ডিসোপ্যান সহ নানা রকমের ওষুধ। এর উপর আবার মোহাম্মদপুর সাতমসজিদ এর গলিতে একটি বাসায় পরিবার নিয়ে থাকেন এবং মাসিক ভাড়া টানতে হয় দশ হাজার টাকা। পরিবারের পাঁচ সদস্যের খাবার খরচতো আছেই এছাড়াও অন্যান্য খরচও কম নয়। পরিবারের সদস্যদের খরচ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় স্ত্রী অন্যের বড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়েছেন। পরিবারের উপার্জনের চেয়ে ব্যয় প্রায় দিগুণ হওয়ায় দিন দিন ঋণের মধ্যে ডুবে যাচ্ছেন। ছোট ছেলে মেয়েকে কাজে পাঠিয়েছেন বাধ্য হয়ে। করোনায় যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ আছে তাই সন্তানরাও কাজে যেতে মানা করতে পারছেন না। চিকিৎসা, খাবার ও অন্যান্য খরচ যখন কাটিয়ে উঠতে পারেন না তখন কিস্তির ভিত্তিতে ঋণ নেন। কিন্তু স্বল্প আয়ের কারণে এ কিস্তি দুই থেকে তিন বছর ধরে টানতে হয়। আবার মাঝে যদি টাকা সংকটে পড়েন তাহলে টাকা জোগাড়ের আর কোনো পথ খোলা থাকে না। না খেয়ে থাকতে হয়। আর মাঝে মাঝে টাকার অভাবে ওষুধ বন্ধ করে দিতে হয়।
স্ত্রী সেলিনা খাতুন বলছিলেন, দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিসে ভোগার সাথে সাথে, দীর্ঘস্থায়ী জ্বর, দুর্বলতা অনুভব, শ্বাস নিতে সমস্যাসহ অন্যান্য অনেক রোগের উপসর্গ দেখা দিলে রাজধানীর একটি বে-সরকারি হাসপাতারে চিকিৎসার জন্য যান। সেখানে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এমআরআই পরীক্ষা করান। ধরা পড়ে ফুসফুস সংক্রমণ। ডায়াবেটিসের সাথে যুক্ত হয় বাড়তি রোগ, সাথে ওষুধ ও খরচ।
দৈনন্দিন কার্যক্রমের বিষয়ে জানতে চাইলে আমীর শিকদার বলেন, খাওয়া দাওয়া এখন সময়মতো করেন। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী খাবার খান। মিষ্টি জাতীয় ও অতিরিক্ত শর্করা জাতীয় খাদ্য এড়িয়ে চলেন। শারিরীক দূর্বলতার জন্য সারাদিন কাজ করতে পারেন না, আবার অনেকসময় কাজ করতে করতে মাথা ঘুরে পড়ে যান। প্রতিদিন কাজ করলে ডায়াবেটিস একটু কম থাকে। কিন্তু অসুস্থ শরীরে প্রতিদিন কাজ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। আবার বসে থেকে চিকিৎসাও চালিয়ে যেতে পারেন না।
এমনি আরেকজন সেলিনা বেগম। বয়স ৪৭ পেরিয়েছে। গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। পরিবারের সদস্য ছয় জন। ১৫ বছর আগে জানতে পারেন তার উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে। সাথে ডায়াবেটিসে। মাসে ওষুধ বাবদ খরচ চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা। স্বামী ঢাকার আমিনবাজারের কাছে চায়ের দোকান করেন। বাসা ভাড়া দেন প্রতি মাসে নয় হাজার টাকা। সাথে বিদুৎ, পানি ও গ্যাস বিল দিতে হয়। বড় ছেলে একটি কাপড়ের দোকানে কাজ করতো। করোনায় লোক ছাঁটাইয়ের তালিকায় পড়ে ছেলে চাকরি হারায়। বর্তমানে উপর্জনের একমাত্র পথ চায়ের দোকান। এই ছোট দোকান থেকে যা আয় হয় ভাড়া ও খাওয়া খরচেই তা ফুরিয়ে যায়।
খাদ্যাভ্যাসের কথা উঠলে জানা যায়, চর্বিযুক্ত মাংস খেতেই বেশি পছন্দ করেন তিনি। তবে মিষ্টি জাতীয় খাবার একদমই খেতে পারেন না। সকালে না খেয়েই কাজের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। দিনে ভাত খান একবার বা দুইবার। আর সবসময় কাজের মধ্যেই থাকেন তাই হাঁটাহাঁটিও কম হয় না। এদিকে স্বামীর কিডনি রোগে আক্রান্ত। তার অপারেশনের পর দৈনিক ওষুধ খেতে হয়। নিজে ওষুধ কিনতে না পারলেও স্ত্রীর জন্য ওষুধ কেনার চেষ্টা করেন। হাইপারটেনশনে বেশ কিছু লম্বা সময় পার করছেন সেলিনা বেগমের। প্রথমদিকে তেমন গুরুত্ব দেন নি। কিন্তু পরে যখন এর তীব্রতা বাড়তে থাকে তখন বাধ্য হয়ে চিকিৎসকের কাছে যান। প্রচণ্ড মাথা ব্যথা, শরীরের দূর্বলতা নিয়ে যখন ডাক্তারের কাছে যান, ততোদিনে নতুন অনেক রোগ জেঁকে বসেছিল। বর্তমানে নতুন রোগ ডায়াবেটিসের মাত্রা প্রায় ১৬ (একক)। ‘খেয়ে, না খেয়ে দিন পার করতে হয়। ওষুধ কিনি তো ভাত পাই না, আবার ভাত খাই তো ওষুধ পাই না। কিন্তু কি আর করার, সংসারের টানা পোড়েনের মধ্যেও চিকিৎসা না নিলে বেঁচে থাকতে পারবো না। টাকা না থাকলে ঋণ করি আবার কম দামি যে ওষুধ খাই’, বলছিলেন সেলিনা বেগম।
আমীর শিকদার ও সেলিনা বেগমের মতো নাসরিন বানু, ফাতেমা বেগম, নুরুল ইসলামসহ দেশের এমন লাখো মানুষ হাইপারটেনশন নিয়ে শোচনীয় দিন পার করছেন। হাইপারটেনশন ও একই সাথে ডায়াবেটিস থাকায় শারীরিক দূর্বলতা বেড়ে গেছে তাদের। তাই স্বাভাবিক জীবনের ধারাবাহিকতায় ভাটা পড়েছে রোগ ও শোকের বিস্তারে। অভাব ও রোগ দুটিকেই কাঁধে করে নিয়ে পার করছেন এককেটি দিন। করোনা কালে আয় উপার্জন কমে যাওয়ায় দূর্ভোগটা আরও বেড়েছে। এদের মধ্যে কেউই হাইপারটেনশনের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানেনি না। একই সাথে সরকারি হাসপাতালে এসব রোগের সেবা সম্পর্কেও তারা তেমন খোঁজ জানেন না। আক্রান্তদের মধ্যে ৫০ শতাংশই অসচেতন এ বিষয়ে। সরকারি হাসপাতাল বলতে তারা শুধু বোঝেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। আর এই হাসপাতালগুলোতে গেলে বিনামূল্যে কিছু ওষুধ পাওয়া যায়। তবে তারা এই সরকারি হাসপাতালে যান না, অনেক সিরিয়াল ধরে বসে থাকতে হয় সে ভয়ে।
এদিকে সরকারিভাবে ডায়াবেটিস চিকিৎসা বা ‘নিদের্শনা বই’য়ের ব্যাপারটিও অনেকের কাছে অজানা। স্বাস্থ্যসেবা কর্মীরা মাঝে মাঝে আসেন আর গর্ভবর্তী মায়েদের লিস্ট লিখে নিয়ে যান। ডায়াবেটিস চিকিৎসার জন্য কোনো নির্দেশনা বা পরামর্শ দেওয়ার মতো কেউ আসে না। তাই তাদের বে-সরকারি হাসপাতাল ও ডাক্তারদের উপর নির্ভর করেই চিকিৎসা চালিয়ে যেতে হয়। ওষুধের দাম বেশি হওয়ায় অনেকসময় ওষুধ কিনতে পারেন না, চিকিৎসা বন্ধ রাখতে হয়।
উচ্চ রক্তচাপের ফলাফল স্বরুপ হৃদরোগ ও স্ট্রোক বিশ্বজুড়ে এখন ১ নম্বর ঘাতক ব্যাধি হিসেবে চিহ্নিত। বিশ্বে প্রতিবছর ১ কোটি ৭৯ লাখ মানুষ মারা যান হৃদরোগে, যা মোট মৃত্যুর ৩১ শতাংশ। এসব রোগে যাঁরা মারা যান, তাঁদের অর্ধেকেরই বয়স ১৫ থেকে ৬৯ বছর। কিন্তু করোনার বা কোভিড-১৯ ভাইরাসের কারণে বর্তমান পরিস্থিতিতে আগের সকল পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, উচ্চ রক্তচাপ আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে করোনা জটিলতার ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় দ্বিগুণ।
উচ্চ রক্তচাপ প্রায় স্থায়ী একটি রোগ হিসেবে বিবেচিত। এর জন্য চিকিৎসা ও প্রতিরোধ দুটোই জরুরি। তা না হলে বিভিন্ন জটিলতা, এমনকি হঠাৎ করে মৃত্যুরও ঝুঁকি থাকে। গবেষণা বলছে, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, এজমা বা ফুসফুসের সমস্যা, ডায়াবেটিস এবং ক্যান্সারের রোগীদের করোনায় মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। যা মর্মান্তিক! কারণ, যে বয়সে জীবন সুন্দর ও কর্মব্যস্ত হয়ে ওঠে, একজন মানুষ ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম, সেই বয়সেই হয় মৃত্যু তাঁকে কেড়ে নেয় বা রোগব্যাধি তাঁকে অথর্ব করে দেয়। সাধারণত ৬০ বছর বয়সের চেয়ে বেশি বয়স্ক ব্যক্তিদের এবং হৃদরোগ ও ফুসফুসের রোগ রয়েছে এমন ব্যক্তিদের এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে, তবে এখন মাঝবয়সী এমনকি তরুণরাও অনেক বেশী হাবে আক্রান্ত হচ্ছে। অথচ চাইলে আমরা এসব রোগকে প্রতিহত করতে পারি।
হৃদরোগের অন্যতম কারণ হলো উচ্চ রক্তচাপ। সাধারণত কারও রক্তচাপ ১৪০/৯০ মার্কারি বা এর বেশি হলে তাকে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত হিসেবে গণ্য করা হয়। বিশ্বে ১৫০ কোটির বেশি মানুষ এ রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশেও প্রাপ্তবয়স্ক জনগোষ্ঠীর ২১ শতাংশ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। নানা কারণে উচ্চ রক্তচাপ হতে পারে। উল্লেখযোগ্য কারণগুলো হলো অতিরিক্ত লবণ খাওয়া, ধূমপান, কায়িক পরিশ্রম না করা, দুশ্চিন্তা বা মানসিক চাপ, মদ্যপান, স্থূলতা, এমনকি বংশগত কারণের প্রভাব আছে। অর্থাৎ উচ্চরক্তচাপ প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।
লেখক: জনস্বাস্থ্য গবেষক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, এমিনেন্স এসোসিয়েটস্ ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট, মেইল: shamim@eminence-bd.org