|| গোবিন্দ শীল ||
করোনাভাইরাস নয়, বিষন্নতাই এখন শাসন করছে আমাদের মনোজগৎ। মানুষ কেন বিষন্ন হয়, কেন তার মন খারাপ হয় অথবা কেনই বা সে রেগে যায়? ঘরে বসে এগুলো থেকে কি নিস্তার পাওয়া সম্ভব?
মানুষ যা কিছু চিন্তা করে সেটা তার স্মৃতি (memory) বড় জোর তার বুদ্ধি (intellect) থেকে নেওয়া। বুদ্ধিটা আসলে piled up memory ছাড়া কিছ নয়। বেশিরভাগ মানুষ প্রায় ৯০ ভাগ সময় জুড়ে হয় অতীতের কথা, না হয় ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায় মধ্যে ঘোরাঘুরি করেন। বর্তমান সময়ে কেউই থাকতে চান না। আর স্বভাবতই আমাদের অতীতে না পাওয়ার বেদনা অনেক বেশি, আর ভবিষ্যতের দূর্ভাবনাতো নেহায়েৎ কম নয়।
ফলে সারাক্ষণ একটা কষ্ট, চাপা ক্ষোভ, দু:খ আমাদের তিলে তিলে শেষ করে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা এরকম কষ্ট, দু:খ মনের মধ্যে পোষন করেন, তাঁর শরীর ও মন অন্য কিছুতে আর আনন্দ খুঁজে পায়না। এমন মানুষ অন্যদের দোষ ধরা, অনের কারণে নিজে সুখী হতে পারেন নি বলে মনে করেন। এই দু:খের চক্র থেকে তিনি বের হতে পারেন না।
আমরা যাই কিছু চিন্তা করি, সেটা আমাদের memory’s reshuffle বা স্মৃতি হাতড়ে বেড়ানো ছাড়া অন্য কিছু নয়। কথা হচ্ছে কষ্ট কিংবা রাগ তৈরী হয় কেন? এগুলো তৈরী হয় কামনা (desire) থেকে। যখন আমরা ভাবি আমার একটা ভালো (subjective concept) কিছু হবে, কিন্তু সেটা হয়তো হলো না, তখনই দু:খ আমাদের গ্রাস করে।
একইভাবে, যা কিছু কামনা করেছিলাম, তা হয়তো শতভাগ মেলেনি। তখন মনে অনেক রাগ হয়। আরেকভাবে বলা যায়, আমার দু:খের জন্য আমি অন্যকে দোষী সাব্যস্ত করি অথবা অন্য কোন external factor কে দায়ী করি। কিন্তু আমরা যদি কামনাকে বাস্তবতার নিরিখে মেপে নেই, তাহলে আমরা desire কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবো।
আমার আপনার চেয়ে দু:খী লোকও যে সংসারে আছে তাদের কথাও ভাবা যেতে পারে। ভালো উপায় হচ্ছে, অতীতের বিষয়গুলোকে চিরতরে বিদায় দেয়া, (বাস্তবিক পক্ষে সেটা হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু সেগুলো যেন ঘুরে ঘুরে না আসে সে ব্যবস্থা করা যেতে পারে) যাতে করে সেগুলো যেন আর আমাদের বিরক্ত না করে।
প্রত্যেকদিন, দিনের শেষে যাবতীয় যা কিছু খারাপ ঘটে গেছে, সেগুলোর একটা closure টানতে হয়। আমি ভুল করে থাকলে মনকে বলবো এরকম ভুল আর করবো না, অন্যেরা করলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবো।
মূল কথা হলো দুটো —প্রথমত: জীবন সম্পর্কে একটা positive attitude বা হ্যাঁবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সব সময় পোষন করা যে আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করে যাবো, তবে সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রনে নেই। এটা মেনে নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, নিজের মনকে আরো প্রসারিত করা। দ্বিতীয় বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। মন বা চেতনা (consciousness) একটা elastic এর মত। নিজেকে ভালবাসতে শেখা এবং এই ভালবাসা জগৎ-সংসার সকলের দিকে প্রসারিত করতে পারাটা একটা বিশাল আনন্দের বিষয়।
আমাদের আশে পাশে যা কিছু আছে, হতে পারে কিছু গাছ-পালা, হতে পারে কোন প্রাণী অথবা নিরেট একখন্ড পাথর। মনকে যতই প্রসারিত করবেন, মন ততই স্বল্পতে তুষ্ট থাকবে, সুন্দর একগুচ্ছ সবুজ ঘাস দেখেও মনে অনেক আনন্দ আসবে।
আমাদের মনের সহ্য ক্ষমতার যে elasticity, করোনার কারণে তা প্রায় ছিঁড়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। এরকম পরিস্থিতিতে, লোভ, ক্রোধ, হিংসা ভুলে গিয়ে ভালোবাসা, স্নেহ, সহানুভূতি ইত্যাদি গুণাবলী অনুশীলন করতে হবে। নিজের জন্য এবং অন্য সকলের জন্য ভালবাসা তৈরী করতে পারলে মন অনেকটাই হাল্কা হয়ে যায়। মনে গভীর প্রশান্তি আসে। এগুলোর পাশাপাশি দুবেলা নিয়ম করে মেডিটেশন করা যেতে পারে। মেডিটেশন মন থেকে সকল negative বিষয় দূর করে positive বিষয় প্রতিস্থাপন করে।
করোনাকালীন সময়ে বাড়িতে বসে ইউটিউবে প্রিয় গান শোনা, ভবিষ্যতের করনীয়গুলো আরো গভীরভাবে ঠিক করে নেয়া, ভালবাসার মানুষগুলোকে দেখতে যাবার পরিকল্পনা করা, নিজেকে আরো গুছিয়ে আনার কাজগুলো করা যেতে পারে। পাশাপাশি প্রিয় মানুষ ও আত্মীয়দের খোঁজ খবর নেয়া, টবে ফুলগাছ লাগানো, বই পড়ার অভ্যাস তৈরী করা যেতে পারে।
এই ভাইরাস আরো অনেকদিন আমাদের কষ্ট দিবে বলে মনে হচ্ছে। ফলে, নিজের চেতনাকে প্রসারিত করা, অন্যদেরকে ভালাবাসা আর সর্বোপরি নিজেকে চেনার (Who am I?) চেষ্টা করে যাবার মধ্য দিয়ে এই কঠিন সময় আমরা পার করতে পারি।