মনকে বদলে ফেলার সুযোগ এসেছে করোনাকালে

|| গোবিন্দ শীল ||

আমাদের মন কখনও কখনও এতটাই জড় বস্তুর মত আচরণ করে তা ভাবলে অবাক হতে হয়। আর এ কারণে আমরা নতুন বছরে নতুন উ্দ্যমে কিছু করবো বলে প্রতিজ্ঞা করার কিছু দিন পর দেখি যেই লাউ সেই কদু অবস্থা।

মন এত Inertia’য় ভোগে কেন? সচেতন মন কোন নতুন উদ্যম নেয়ার পর কিছুদিন ঐ উদোগের পেছনে লেগে থাকে । কিন্তু এতে অবচেতন মনের সায় না থাকায় রণে ভঙ্গ দিতে হয়। অর্থাৎ মনের আসল অভিভাবক হলো অবচেতন মন।

এখানে আরও দুটি বিষয় মনে রাখতে হবে: এক, আমরা যা চাই আর আমরা যা বিশ্বাস করি এই দুটির মধ্যে মন বেছে নেয় দ্বিতীয়টি। আমরা যা কিছুতে বিশ্বাস করি মন আমাদেরকে সেদিকেই ঠেলে দেয়, আমাদের চা্ওয়াটা মুখ্য নয়। আর দ্বিতীয় বিষয় হলো, material prosperity’র জন্য আমরা মনে করি যত data বা information আমরা সংগ্রহ করবো, আমরা ততই উন্নতি করবো। ভুল।

তাহলে যাঁরা প্রত্যেকদিন মনোযোগ দিয়ে খবরের কাগজ পড়েন, তাঁরাই অনেক ভালো অবস্থানে থাকার কথা। বাস্তবে দেখা যায়, অনেক জাগতিক উন্নতি করেছেন, এমন মানুষ জগত-সংসারের খবরাখবর রাখেন না বললেই চলে (নিজের ব্যবসা ছাড়া)। ফলে জ্ঞান আহরণের সঙ্গে মনের শান্তি বা উন্নতি সরাসরি জড়িত নয়। জড়িত হলো আমাদের আকাংখার ধরণ আর attitude।

এই করোনাকালীন সময়ে আমরা বেশ কিছুটা সময় পেয়েছি বাকি জীবনের সুখ-শান্তি ও লক্ষ্যকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার। সত্যি সত্যিই আমরা যদি মানসিক শান্তিকেই গুরুত্ব দেই (মানসিক শান্তি-ই আসলে আমাদের একমাত্র লক্ষ্য), তাহলে আমাদের অবচেতন মনকে নির্দ্রিষ্ট বা fix করতে হবে।

আমাদের চিন্তাই আমাদেরকে শৃঙ্খলিত করে রাখে। আমাদের মাথার ওপর অনেক বড় বড় চিন্তা-দূর্ভাবনার বোঝা (অনেক বোঝা) নিয়ে আমরা মনের মুক্তি, চিন্তার স্বাধীনতা খুঁজে বেড়াই। এই ওজনদার পোটলাগুলো আমরা সব সময়, ঘুমে-জাগরণে-স্বপ্নে বহন করে চলেছি। এই চিন্তার বোঝা বইতে গিয়ে একসময় ক্লান্ত হয়ে পড়ি। কিন্তু চিন্তার বোঝা কমাতে পারি না। মানব মনের চিন্তন প্রক্রিয়া না বুঝবার কারণে পোটলার সংখ্যা ও ওজন দুটিই বাড়তে থাকে।

অশান্তির মুখোমুখি হলে আমরা নিজেকে নয়, অন্যদেরকে (external factors) এজন্য দায়ী মনে করি। যতরকম চিন্তাই আমরা করি না কেন, সেগুলোর বেশিরভাগই মস্তিষ্ক সংরক্ষণ করে রাখে। দৈনন্দিন কাজকর্ম (বাজারে যাওয়া, অফিসের কাজ করা, আহার করা, পেপার পড়া) বাদ দিলে আমরা আসলে কি নিয়ে চিন্তিত হই?

আমাদের সমাজ, পরিবার, শিক্ষা ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র আমাদেরকে যেসব স্বপ্ন দেখায় অথবা দেখতে উৎসাহিত করে, তা হলো ক্লাসে ফার্স্ট হও, অন্যকে টপকে সামনে এগিয়ে যাও, গুলশানে না পারলে অন্তত উত্তরায় একটি বাড়ি কর, এসব আরকি। এগুলোই আমরা দিনের পর দিন, মাসের পর মাস ও বছরের পর বছর ভাবতে থাকি। একটি অর্জন হলে আরেকটি লক্ষ্য নিয়ে এগুতে থাকি। সেই সাথে যোগ হয়, একটি প্রতিযোগী মনোভাব, কোন বস্তুগত অর্জনে ঢেকুর তোলার প্রবণতা ইত্যাদি।

যেহেতু বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ আমরা এই ধরণের conditioning এর মধ্যে ডুবে থাকি, ফলে এগুলো আমাদের অবচেতন মনের অংশ হয়ে যায়। এগুলোই আমাদের মাথার ওপর ভারী ভারী বোঝা তুলে দেয়। জাগতিক সব কিছু আমরা শেষ বয়সেও মাথা থেকে নামাতে পারি না। তখন নিজেকে বলি শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করাটা আমার করা ঠিক হয়নি অথবা আমার জন্য ডাক্তারি নয়, ওকালতিই ভাল ছিল, ইত্যাদি।

কিন্ত এই কাজগুলো আমরা কেন করি? আমরা মনে করি, অথবা আমাদেরকে মনে করানো হয়, এতে সুখ-শান্তি আসবে। পরে দেখা যায়, অনেক কিছু অর্জনের পরেও, সেই কাঙ্খিত সুখ আসেনি।

যে বিষয়টি আমরা ভুলে যাই তা হলো: মানব মন সততই নিজেকে প্রসারিত করতে চায়। এই বিশ্ব-প্রকৃতিকে বুঝতে চায়, আপন করে নিতে চায়। সে বিষয়টিকে divert করে আমরা কেবল বস্তুগত বিষয়ে মনোনিবেশ করি । ফলে মনের ভেতরের যে সুপ্ত বাসনা, তা অপূর্ণই থেকে যায়।

আমরা যখন প্রাকৃতিক পরিবেশে থাকি, তখন শরীরের অবসাদ-ক্লান্তি দূর হয়ে যায়, দূর্ভাবনার জন্য দায়ী কর্টিসল হরমোন নি:সরণ বন্ধ হয়ে হ্যাপি (ডোপামাইন, সেরোটনিন, অক্সিটোসিন) হরমোন তৈরি হতে থাকে শরীরে। এই কথাটি আরেকদিন বলেছি। সুতরাং প্রাকৃতিক পরিবেশে ঘোরাঘুরি করা, প্রকৃতির সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা ছাড়া শান্তি আসবে না।

চলুন, আগামী দিনগুলোতে আমরা প্রকৃতির কাছাকাছি যাবার চেষ্টা করি। নিজের মনকে reprogram করি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন