জীবন টানতে মানুষের কাঁধে ঘানির জোয়াল

পরিবারের-সংসারের ঘানি টানার দায়িত্বটি কারো কারো ললাটে ভীষণভাবে লেপ্টে যায়। তাদের ক্ষেত্রেও অনেকে কলুর বলদ শব্দের প্রয়োগ ঘটান। নীলফামারীর ডিমলা ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার এমনি দুই কলু দম্পতির খবর পাঠিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা, যারা বলদ কেনার সামর্থ্য না থাকায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে জীবনের জোয়াল টানছেন নিজেরাই।

|| সারাবেলা প্রতিনিধি, সিরাজগঞ্জ ও ডিমলা ||

অহেতুক বোঝা বয়ে যাওয়া যার অদৃষ্টের লিখন, তার দুর্ভাগ্য বোঝাতে ‘কলুর বলদ’ শব্দটি ব্যবহার হয়। কলু ঘানির মালিক। আর যে বলদ ঘানি টানার কাজটি করে, সেটিই কলুর বলদ। পরিবারের-সংসারের ঘানি টানার দায়িত্বটি কারো কারো ললাটে ভীষণভাবে লেপ্টে যায়। তাদের ক্ষেত্রেও অনেকে কলুর বলদ শব্দের প্রয়োগ ঘটান। নীলফামারীর ডিমলা ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার এমনি দুই কলু দম্পতির খবর পাঠিয়েছেন আমাদের প্রতিনিধিরা, যারা বলদ কেনার সামর্থ্য না থাকায় তিন দশকের বেশি সময় ধরে জীবনের জোয়াল টানছেন নিজেরাই।

ডিমলা (নীলফামারী) প্রতিনিধি জানান

নীলফামারীর ডিমলায় গরু ছাড়া নিজেই তেলের ঘানি টানছেন ৭০ বছরের বৃদ্ধ ও তার স্ত্রী। ঘানি টেনেই ৩৫ বছর ধরে জীবন জিবিকা নির্বাহ করছেন তারা। উপজেলার খালিশা চাপানী ইউনিয়নের সরকার পাড়া গ্রামের মৃত নছাই মামুদের ছেলে সহায় সম্বলহীন সহিমুদ্দিন(৭০) ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী ৩ ছেলে ৩ মেয়ের বাবা। ছেলেরা বিয়ে করে নিজ নিজ সংসার নিয়ে ব্যস্ত। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোট মেয়ে নিলুফা আক্তার (২০) নীলফামারী জেলার জলঢাকা সরকারী ডিগ্রী কলেজে ডিগ্রী ২য় বর্ষের ছাত্রী।

ছবি: সংবাদ সারাবেলা।

বৃদ্ধ সহিমুদ্দিন জানান, অভাব অনাটনের সংসারে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে না নিয়ে ৩৫ বছর আগে অতিকষ্টে ঋন করে একটি গরু কিনে সরিষার তেলের ঘানি চালিয়ে কোন রকমে সংসার চালিয়ে আসছিলাম। কিন্তু ১৫ বছরের মাথায় ঘানি টানা গরুটি হঠাৎ করে মারা যায়। সেই থেকে গরু কেনার সামর্থ না থাকায় গত ২০ বছর ধরে প্রতিদিন ভোর ৩ টায় ৫ কেজি সরিষা ঘানিতে দিয়ে বেলা ১১টায় (৮ঘন্টা) পর্যন্ত ঘানি টানি। আমি ক্লান্ত হলে আমার স্ত্রী নুর নাহার(৫৫) হাল ধরে ঘানি টেনে তেল মাড়াই শেষ করে। মাড়াই করা তেল চাপানি বাজারে বিক্রি করে সেই লাভের সামান্য টাকা দিয়ে খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাই।

অতিকষ্টে ছোট মেয়ে নিলুফা আক্তারের পড়ালেখার খরচ চালাই। এভাবেই বেশ কিছু অতীত অধ্যায়ের সমাপ্তি হলেও সমাপ্তি হয়নি ৭০ বছর বয়সে পা রাখা বৃদ্ধের তেলের ঘানি টানা কাজের। ঘানি টানা বৃদ্ধ সহিমুদ্দিন বলেন, আমার এই চরম দুর্দিনে সরকারী বে-সরকারী, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিরা যদি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় আমি খুবই উপকৃত হব।

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি জানান

৩০-৪০ বছর আগে গরু দিয়ে ঘানি টেনে উৎপাদন করা হতো খাঁটি তেল। তেল তৈরীর আধুনিক যন্ত্রের বিস্তারে সেই আদি পেশা বিলুপ্তির পথে। তারপরও পৈত্রিক পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন কেউ কেউ। সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের বিলধলী গ্রামের বাসিন্দা মোছা. মরিয়ম বেগম (৪৫) তার স্বামী লোকমান হোসেনকে (৫৫) নিয়ে বিয়ের এক মাস পরে থেকেই ৩০ বছর ধরে এ ঘানি টানছেন। দুটি ঘানি থেকে যে টাকা পান তা দিয়েই কোনোরকমে চলে তিন ছেলে আর এক মেয়েকে নিয়ে সংসার। তবে দুইটি ঘানি টানতে দুটি গরুর প্রয়োজন হলেও একটি ঘানি টানার জন্য গরু কেনার টাকা নেই তাদের। তাই গরুর পরিবর্তে ঘানি টানা জোয়াল নিজেরাই টেনে অভাবের সংসার চালাচ্ছেন তারা।

মরিয়ম বেগম জানান, বিয়ের পর থেকেই দেখে আসছি আমার শ্বশুর ও স্বামী এই ঘানি টেনেই সংসার চালাচ্ছেন। আমি এ বাড়িতে আসার পর থেকেই এ কাজে নিয়েজিত। প্রথম অবস্থায় খুব খারাপ লাগতো মাথা ঘুরতো। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতাম আবার ঘানি টানতাম। এই ঘানি টানছি প্রায় ৩০ বছর ধরে। ঘানি টানার কারণে আমার কিডনির সমস্যা হয়েছে। ডাক্তার ভারি কাজ করতে নিষেধ করেছে। তার পরেও বাধ্য হয়ে ঘানি টানছি। ঘানি টেনে যে টাকা পায় তা দিয়েই টেনেটুনে সংসার চালাচ্ছি। আর ঘানি যদি না টানি তাহলে সংসার চলবে না। এদিকে নিজের ওষুধ ও স্বামীর ওষুধও কিনতে পারবো না। কেউ যদি আমাকে অর্থ সহায়তা করতেন অথবা দুটি বলদ বা বড় গরু কিনে দিতেন তাহলে খুব উপকার হতো।

মরিয়মের স্বামী লোকমান হোসেন প্রামাণিক (৫৫) বলেন, অনেক কষ্টে আছি। নিজে অসুস্থ আবার আমার স্ত্রীও অসুস্থ। আমাদের দুটি ঘানি আছে একটি ঘানি গরু দিয়ে টানি অন্যটি আমি আমার স্ত্রী ও ছেলেকে দিয়ে টানাই। ঘানি টেনে সরিষা থেকে যে তেল বের হয় তা বিক্রয় করে যেটা আয় হয় তা দিয়ে নিজের ও স্ত্রীর ওষুধ কিনি আর টেনেটুনে সংসার চালাই। ঘানি না টানলে খাবো কি? ঘানি টানার জন্য ভালোমানের বলদ গরু কেনার প্রয়োজন। কিন্তু আমাদের সে সামর্থ্য নেই। আবার কাজও করতে পারছিনা। যদি কেউ আমাদের প্রতি সদয় হতেন।

তিনি আরও বলেন, এই পেশা আমার বাপ দাদার আমলের। বাবা বলেছে হালাল খাওয়ার জন্য এই পেশায় থাকতে। কোন দিন হারাম খাবি না যার জন্য এই পেশায় এখনো আছি।

এদিকে প্রতিদিন প্রায় এক মণ সরিষা ঘানির মাধ্যমে তেল তৈরি হয় ১০-১৫ কেজি। প্রতি কেজি বিক্রি হয় ২২০-২৫০ টাকা। বিশুদ্ধতার নিশ্চয়তা থাকায় ক্রেতারা এখান থেকেই তেল কেনেন বলেও জানা যায়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন