|| সারাবেলা প্রতিনিধি, কুমিল্লা ||
নদীর নাম কালাডুমুর। বয়ে গেছে জেলার দাউদকান্দি উপজেলার আদমপুর গ্রামের ভেতর দিয়ে। এক সময়ের খরস্রোতা এই নদীর পানিতে গেলো ৫০ বছর ধরে চাষ হচ্ছে আশপাশের জমি। কৃষক আলী আশরাফ বললেন, এক সময়ে পর্যাপ্ত পানি আর স্রোত থাকলেও গেলো বিশ বছর ধরে বোরো মৌসুমে জমিতে সেচ দেয়ার মতো পর্যাপ্ত পানি মেলেনা এই নদীতে। ধীরেই তীব্র হচ্ছে এই সমস্যা।
চলতি মৌসুমের শুরুতেই অনেক স্থানে নদীটি একেবারেই পানিশূণ্য হয়ে পড়েছে। শুধু কৃষক আলী আশরাফই নন, তার মতো প্রায় ৩০ হাজার কৃষক পড়েছেন সংকটে। যারা সেচের জন্য কালাডুমুরের ওপর।
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/FB_IMG_1586074125650.jpg?resize=1059%2C662&ssl=1)
কৃষক আলী আশরাফ জানান, এখন বোরো আবাদ শুরু হয়েছে। নদীতে সামান্য যা পানি রয়েছে, তা ধানের চারা রোপণ করতেই শেষ হয়ে যাবে। এরপর পুরো মৌসুমে তাদের থাকতে হবে চিন্তার মধ্যে। এ বছর চার বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন তিনি। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে পানির সংকট।
কালাডুমুর গোমতী নদীর একটি শাখা। দাউদকান্দি উপজেলার গৌরীপুর বাজার সংলগ্ন গোমতী থেকে এর উৎপত্তি। গৌরীপুর, জিংলাতলি, ইলিয়টগঞ্জ উত্তর ও দক্ষিণ ইউনিয়ন অতিক্রম করে সংযুক্ত খালের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী মুরাদনগর, চান্দিনা, দ্বেবিদার ও কচুয়া উপজেলায় প্রবাহিত হয়েছে। ক্ষিরাই নদীর মাধ্যমে কচুয়া উপজেলা হয়ে কালাডুমুর মিশেছে মেঘনা নদীতে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বেশিরভাগ স্থানেই নদীর পানি হাঁটুর নিচে নেমে গেছে। দখল-দূষণ আর নাব্য হারিয়ে এক সময়ের খরস্রোতা নদীটি পরিণত হয়েছে মরা খালে। নদীর শাখা খালগুলোও রয়েছে অস্তিত্ব সংকটে। অনেক স্থানে হয়ে গেছে দখল।
কয়েক দশক আগেও কালাডুমুরের বুকে পাল তোলা নৌকা, লঞ্চ এবং মালবাহী ট্রলার চলাচল করত। শুস্ক মৌসুমেও কৃষকরা ফসল আবাদের সময় নদী থেকে পর্যাপ্ত পানি পেতেন। এই নদীতে ছিল দেশি মাছের প্রাচুর্য। নদীকে কেন্দ্র করে ওই উপজেলাগুলোর কৃষিতে আসে সমৃদ্ধি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কুমিল্লার প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী আবদুল লতিফ জানান, এই নদীটি প্রায় ২৩ কিলোমিটার দীর্ঘ। সম্প্রতি আমরা নদীর দাউদকান্দি অংশের ১১ কিলোমিটার এলাকায় খননকাজ শুরু করেছি। চলতি মৌসুমে এই খনন শেষ হবে। পর্যায়ক্রমে পুরো নদীটি খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এতে কৃষকরা উপকৃত হবেন।
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/images-1.jpg?resize=1056%2C658&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/images-1.jpg?resize=1056%2C658&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/images-1.jpg?resize=1056%2C658&ssl=1)
কালাডুমুর নদী রক্ষায় দুই দশক ধরে কাজ করছেন স্থানীয় শিক্ষক ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত পরিবেশ সংগঠক মতিন সৈকত। পুরো নদীটি পুনর্খননের জন্য এই শিক্ষক নিজ উদ্যোগে মানববন্ধন, সংবাদ সম্মেলন, কোদাল মিছিল, প্রতীকী অনশন, নদী মেলা ও নদী অলিম্পিয়াড করেছেন। আরও বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে মানুষকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করছেন।
মতিন সৈকত জানান, কালাডুমুর নদীর পানি দিয়ে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বিঘা কৃষিজমি থেকে অন্তত ১২ লাখ ৫০ হাজার মণ বোরো ধান উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া শুস্ক মৌসুমে প্লাবন ভূমির মৎস্য প্রকল্পগুলোতে পানি সরবরাহ করা হয় এই নদী থেকে। তবে বর্তমানে নদীটি বালু আর পলি জমে প্রায় ভরাট হয়ে গেছে। শুস্ক মৌসুমে নদীটি শুকিয়ে যায়। এতে বোরো আবাদে বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। কৃষকরা পানির জন্য হাহাকার করেন। নৌপথের নাব্য সৃষ্টি, প্রাকৃতিক মাছের অভয়ারণ্য, জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও পরিবেশ সুরক্ষায় পুরো নদীটি পুনর্খনন অপরিহার্য। বিচ্ছিন্নভাবে খনন হলে বর্ষা মৌসুমে আবার খনন হওয়া স্থান পলি ও বালুতে ভরে যাবে।
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/Kaladumur-1.jpg?resize=1051%2C596&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/Kaladumur-1.jpg?resize=1051%2C596&ssl=1)
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/Kaladumur-1.jpg?resize=1051%2C596&ssl=1)
দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জ এলাকার কৃষক ময়নাল হোসেন, চান্দিনার কৃষক সামিউল ইসলামসহ একাধিক কৃষক জানায়, এই নদীর মাধ্যমে একসময়ে এসব অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। নদীতে ছিল দেশীয় মাছের প্রাচুর্য। শত শত জেলে এই নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আগে এই নদীর পানি দিয়ে কৃষকরা তাদের সব কৃষিজমি আবাদ করার পরও নদীতে প্রচুর পানি থাকত, যার কারণে সারাবছরই নৌ-চলাচলের সুবিধা ছিল। এখন বোরো মৌসুমে কালাডুমুর ও এর শাখা খালগুলো পানিশূন্য হয়ে পড়ে। পানির অভাবে অনেক জমি ফেটে যায়।
দাউদকান্দি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সারওয়ার জামান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে পুনঃখনন না হওয়াতে পলি জমে নদীটি ভরাট হয়ে গেছে। আবার অনেক স্থানে হয়ে গেছে দখল। নদীতে বালু ও পলি জমে পানি ধারণক্ষমতা একেবারেই কমে গেছে। যার কারণে বোরো আবাদে সমস্যা হচ্ছে কৃষকদের। এজন্য অনেক কৃষক আবাদে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছেন। এই সমস্যা থেকে বাঁচতে হলে দ্রুত পুরো নদী ও শাখা খালগুলো দখলমুক্ত করে পুনঃখনন করতে হবে। খনন হলে নদীর পানিতেই কৃষকরা সারাবছর আবাদ করতে পারবেন। এতে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করতে হবে না।