|| সারাবেলা প্রতিনিধি, মেহেরপুর ||
অর্থ বাণিজ্য আর দাফতরিক হয়রানির বিস্তর অভিযোগ উঠেছে মেহেরপুরের বিভাগীয় কাষ্টমস কর্মকর্তা তপন চন্দ্র দে’র বিরুদ্ধে। বিশেষ করে স্থানীয় ইটভাটা, মিষ্টির দোকানিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, ভ্যাট আদায় সহ নানা কারণে তাদের জিম্মি করে অর্থবানিজ্য অসদাচরণ ও হয়রানি করা হচ্ছে তাদেরকে।
ইটভাটার মালিকরা জানান, প্রতিবাদ করলেই ট্রলি আটক করে দিনের পর দিন হয়রানি করা হচ্ছে। অন্যদিকে ‘খুশি’ করেই ভ্যাট বকেয়া রেখেও দিনের পর দিন ব্যবসা করছেন অনেকেই। প্রতিকার পেতে মানববন্ধনসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে লিখিত অভিযোগ জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন ইটভাটা মালিকরা। মিষ্টি দোকানিদের অভিযোগ, এই কর্মকর্তা ও তার নিয়োজিত ভ্যাটসংগ্রহকারীদের অত্যাচারে ব্যবসা করাই দায় হয়ে পড়েছে।
![](https://i0.wp.com/sangbadsarabela.com/wp-content/uploads/2021/03/received_761420938116291.jpeg?resize=960%2C500&ssl=1)
মেহেরপুর সদর উপজেলার খোকসা এলাকার ফোর এসবি ইটভাটা মালিক জুয়েল রানা অভিযোগ করে বলেন, চলতি বছরের সাড়ে ৪ লাখ টাকা ভ্যাট পরিশোধ করেছি। তারপরও ট্রলি ধরে হয়রানি করছে কাষ্টমস কর্মকর্তা তপন চন্দ্র দে। দিনের পর দিন ঘুরলেও ট্রলি ফেরত দিচ্ছেন না। ট্রলি ফেরত না পাওয়ায় শ্রমিকদের কাজ বন্ধ থাকছে।
মেহেরপুর জেলা পরিষদ সদস্য ও গাংনী উপজেলা যুবলীগের যুগ্ন সাধারন সম্পাদক ঠিকাদার মজিরুল ইসলাম বলেন, অন্যান্য ঠিকাদারের মত তিনিও ইটের দাম কম থাকতে বিভিন্ন ইটভাটা থেকে ইট কিনে তার বাড়ি পাশে স্তুপ করে রেখেছেন। পরে তার ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন মত ইট নিজস্ব পরিবহনে করে সরকারী রাস্তা, স্কুল কলেজ ভবন ও ব্রিজ নির্মান কাজে ব্যবহার করেন। কিন্তু গত বৃহস্পতিবার কাষ্টমস কর্মকর্তা তপন চন্দ্র দে চোখতোলা এলাকায় ট্রলি আটকে গাংনী থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, এসব ইট ও ট্রলি তার ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কোন ইটভাটার সাথে সম্পর্ক না থাকলেও ঠিক কোন কারনে তার ট্রলি আটক করা হয়েছে তিনি তা বুঝতে পারছেন না।
মজিরুল ইসলাম বলেন, কোন ইটভাটা যদি ভ্যাট পরিশোধ না করে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু ব্যক্তিগত ট্রলি আটক করে হয়রানি করা হচ্ছে।
কোমরপুর গ্রামের ইটভাটা মালিক সোনা গাইন বলেন, কাষ্টমস কর্মকর্তারা ইটভাটা মালিকদের হয়রানি করছেন। তাদের অত্যাচারে ব্যবসা বানিজ্য পথে বসেছে। ইট ভাটার ভ্যাট পরিশোধ করা হলেও নানা অজুহাতে বাইরে থেকে ট্রলিতে ইট নিতে আসলে তাদের আটকে হয়রানি করা হয়।
পিরোজপুর গ্রামের ইটভাটা মালিক আব্দুর রাজ্জাক জানান, ভ্যাটের ১ম কিস্তি দেয়া হলেও তাদের ট্রলি আটক করা হয়েছে। ২য় কিস্তি দিলে ট্রলি ছেড়ে দেবে এমন আশ্বাস দিলেও ট্রলি ফেরত দেয়নি। পরে পূর্নাঙ্গ ভ্যাট পরিশোধ করেও দিনের পর দিন ঘুরেও ট্রলি ফেরত পাচ্ছেন না তিনি।
মৌসুমি ইটভাটা বিধি মালা ২০০৪ সালের ১১ই মার্চ বৃহস্পতিবার রাজস্ব বোর্ড গেজেটে ইটভাটা মালিকদের ৩১শে ডিসেম্বর প্রথম কিস্তির ৩৫ শতাংশ, ২য় কিস্তি ১৫ই ফেব্রুয়ারি ৩৫ শতাংশ এবং ৩১শে মার্চের মধ্যে বাকি ৩০ শতাংশ ভ্যাট পরিশোধের নিয়ম থাকলেও সে নিয়ম না মেনে ট্রলি আটক করে পূর্নাঙ্গ ভ্যাট আদায় করছেন কাষ্টমস কর্মকর্তা তপন চন্দ্র দে। আবার তাকে ‘খুশি’ করলেই ছাড় পাচ্ছেন অনেকেই। সেক্ষেত্রে নিয়ম নীতির কোন তোয়াক্কাই করছেন না তিনি।
ইটভাটা আইনের ৯ ধারায় মোতাবেক ভ্যাট না দিলে সংশ্লিষ্ট ইটভাটা কর্তৃপক্ষ,যানবাহন ও ইট জব্দের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হলেও রাস্তা থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি ধরে নিয়ে ব্রিটিশ বেনিয়ারদের মত জোর করে ভ্যাট আদায়ের কোন নির্দেশনা দেয়া নেই। অথচ কাষ্টমস কর্মকর্তা তপন চন্দ্র দে ইচ্ছামত ভ্যাট আদায়ের নামে রাস্তা থেকে ব্যক্তি মালিকানা ট্রলি ধরে নিয়ে অর্থ বানিজ্য করছেন।
জানা গেছে, মেহেরপুর জেলায় সর্বমোট ১শ’ ৪টি ইটভাটা রয়েছে। এর মধ্যে সার্কেল ১ মেহেরপুর ও মুজিবনগরে ৪৮টি ও গাংনী সার্কেলে ৫৬টি।
একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি মাসের এ পর্যন্ত ৩ কোটি টাকার কিছু বেশি ভ্যাট আদায় করা হলেও কাষ্টমস কর্মকর্তার অর্থবানিজ্যের কারনে গত ২০১৯/২০ অর্থ বছরের ভ্যাট বাকি রয়েছে অন্তত কোটি টাকারও বেশি। গত অর্থ বছরের এসব ভ্যাট আদায়ে বিপুল পরিমান টাকা অর্থবানিজ্য করছেন বলে অভিযোগ করেছে ইটভাটা মালিকরা। ট্রলি জব্দ ও ইটভাটা বন্ধের হুমকি দিয়ে মালিকদের জিম্মি করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ তাদের।
বামুন্দী ইউনিয়নের রামনগর গ্রামের সততা ইটভাটা মালিক ইছার উদ্দীন জানান, তার ইটভাটা ২০১৮/১৯,২০১৯/২০ ও ২০২০/২১ এই তিন অর্থ বছরের জন্য নিশিপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে দোলেয়ার হোসেনের কাছে লিজ দেয়া হয়। তিন বছর ইটভাটা চললেও ২০১৯/২০ অর্থ বছরে ইটভাটা বন্ধ রয়েছে মর্মে কাষ্টমস অফিস প্রত্যয়ন দিয়েছে। ইটভাটা বন্ধের প্রত্যয়ন দিয়ে লাখ লাখ টাকা অর্থবানিজ্য করেছে কাষ্টমস। টাকার বিনিময়ে চালু ইটভাটা বন্ধ দেখিয়ে প্রত্যয়ন দেওয়ার ঘটনায় বিচারের দাবিতে মেহেরপুর জেলা প্রশাসক, দূর্নীতি দমন কমিশন সহ কাষ্টমসের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত দেয়া হয়েছে। কাষ্টমসের এসব দূর্নীতি পরায়ন কর্মকর্তার কারনে সরকার প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে দাবি অভিযোগকারীদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন রড সিমেন্টের দোকানির অভিযোগ, কাষ্টমস কর্মকর্তাদের অত্যাচারে ব্যবসা বন্ধের পথে। তাদের চাহিদা মত টাকা না দিলে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। গাংনী ও মেহেরপুরের দুইজন মিষ্টির দোকান মালিক বলেন, রাজস্ব আদায়ের নামে ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে লুটপাট শুরু করেছে মেহেরপুরের কাষ্টমস কর্মকর্তা তপন চন্দ্র দে সহ তার নিয়োগ দেয়া দালালরা। সরকার যতটা রাজস্ব পায় তার কয়েকগুন কাষ্টমস কর্মকতার পকেটে ভর্তি হয়।
দূর্নীতি দমন কমিশনের উর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ঘুষবানিজ্যের অভিযোগ লিখিত দিলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া গোপনে কেউ কোন তথ্য দিলে নাম প্রকাশ করা হবে না। বরং তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। তবে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অসৎ কাষ্টমস কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে রাজস্ব বোর্ড প্রশাসন সদস্য।
গাংনী উপজেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি এনামুল হক বলেন, গত বছরে গাংনী উপজেলায় ৫৪টি ইটভাটা চললেও মাত্র ২৭টির কাছে ভ্যাট আদায় করেছে। বাকী ইটভাটায় ভ্যাট না নিয়ে প্রত্যয়ন দিয়েছেন স্থানীয় কাস্টমস অফিস।