|| আবুল হোসেন সবুজ, গাজীপুর থেকে ||
প্রথমবারের মতো গাজীপুর জেলার লাল ও ধসূর বর্ণের উঁচু জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ শুরু হয়েছে। ফলনও অনেক বেশী হবে বলে আশা করছেন চাষীরা। তাই কৃষকের মুখে ফুটেছে সূর্যমুখা হাসি।
দক্ষিণাঞ্চলের মতো গাজীপুর জেলার মাটি ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় জেলাজুড়েই চাষ হয়েছে সূর্যমুখী। ইতোমধ্যেই ফসল ঘরে তোলার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন চাষীরা। দামও ভালো মিলবে বলেও মনে করছেন তারা।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সার ও বীজ প্রণোদনার মাধ্যমে জেলার ৫ উপজেলায় প্রদর্শনী আকারে এ বছর মোট ৩৮ হেক্টর জমিতে সূর্যমুখী ফুলের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে গাজীপুর সদর উপজেলায় ১২ হেক্টর,কালিয়াকৈর উপজেলায় ৯ হেক্টর, কালীগঞ্জ উপজেলায় ৯ হেক্টর, কাপাসিয়া উপজেলায় ৬ হেক্টর ও শ্রীপুর উপজেলায় ২ হেক্টর।
গাজীপুর সদর উপজেলার বাসন গ্রামের চাষী চিত্তরঞ্জণ সরকার জানান, আমি আমার ৬৫ শতাংশ জমিতে এবার উপজেলা কৃষি অফিসের মাধ্যমে নতুন এই ফসলের চাষ করি। ঈশ্বরের কৃপায় আমার জমিতে আশানুরুপ ফলন হয়েছে। এদিকে প্রতিদিন বিকেল হলেই আমার বাগানে অনেক লোকের সমাগম হয়। তারা এই বাগানের সৌন্দর্য দেখতে আসে এবং ছবি তুলতে আসে।
তিনি আরো বলেন, আমি আগে এই জমিতে ধান চাষ করতাম। কিন্তু উৎপাদন খরচ হিসাব করলে সেই পরিমাণ লাভ হতো না। কিন্তু এবার সূর্যমুখীর চাষ করার কারণে মনে হচ্ছে লাভের মুখ দেখতে পারবো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাবিনা সুলতানা জানান, এ বছর আমার উপজেলার ৪৪টা ব্লকে সূর্যমুখীর আবাদ করা হয়েছে। তার মধ্যে সরকারের প্রনোদনা প্রকল্পের আওতাধীন ব্লকও রয়েছে। যারা এবছর চাষ করেছেন, তাদের প্রত্যেককে সকল ধরণের সহযোগিতা করা হচ্ছে। শুধু জমির চাষ বাবদ খরচ ছাড়া।
তিনি আরো বলেন, প্রতিনিয়তই কৃষকদের খোঁজ-খবর নিচ্ছি। সেই সাথে প্রদর্শনী মাঠ পরিদর্শনে যাচ্ছি। তবে এবছর যে সব কৃষক সূর্যমুখীর চাষ করেছেন তারা সবাই ভীষণ খুশি। কারণ, তাদের বাগানে ফুল এসেছে, গুটিও ধরছে । বাম্পার ফলনে কৃষকরা যেমন খুশি, ঠিক তেমনিভাবে আমরাও খুশি। আশা করছি আগামী বছর সূর্যমুখীর চাষির সংখ্যা বাড়বে এবং সবার মাঝে এই তেলবীজ ফসল উৎপাদনে আগ্রহ বাড়বে।
সদর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কার্যালয়ের উপ-সহকারী কর্মকর্তা মো. ওসমান সোহেল বলেন, এ বছর আমার ব্লক বাসন ইউনিয়নের চিত্তরঞ্জণ সরকারের প্রায় ৬৫ শতাংশ জমিতে বারি সূর্যমুখী-৩ জাতের চাষ করা হয়েছে। সঠিক পরিচর্যার ফলে আশানুরুপ ভালো ফলন হয়েছে। এতে চাষীও ভীষণ খুশি।
কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামের চাষী মো. আব্দুস সালাম ও বেলায়েত হোসেন সংবাদ সারাবেলাকে জানান, আমরা এই বছর আমাদের দুই ভাইয়ের ৬০ শতাংশ জমিতে সূর্যমূখী চাষ করেছি। আগে কখনো করি নাই। আমরা তো সব সময়ই ধান চাষ করি। কিন্তু ধান চাষ করতে যে পরিমাণ খরচ হয় সেই তুলনায় ধান আমরা উৎপাদন করতে পারিনা। তবে উৎপাদন করতে পারলেও ন্যায্য মূল্যে তা বিক্রি করতে পারিনা। কিন্তু এবার ধান চাষ না করে তৈলবীজ জাতীয় ফসল সূর্যমুখীর চাষ করেছি। আশানুরুপ ফলন হয়েছে।
তারা এও জানান, যেহেতু বাজারে বর্তমানে খাবার তেলের দাম বেশি এবং সূর্যমুখীর তেলের দাম আরো বেশি, তাই অন্যান্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখী চাষে বেশি লাভের আশা করছেন তারা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে কাপাসিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুমন কুমার বসাক জানান, এবছর আমার উপজেলায় ৬ হেক্টর জমিতে চাষ করা হয়েছে। বিশেষ করে এটাতো নতুন ফসল তাই শুরুতে অনেক কৃষকের অনিহা ছিলো। কিন্তু পরবর্তিতে আমরা তাদেরকে ভালো ভাবে বুঝিয়ে চাষ করাই। চাষ করার পরবর্তী দৃশ্য দেখে সত্যিই সূর্যমুখী চাষীরা আনন্দিত। এসব কৃষক আগামী বছর তাদের আবাদের পরিমাণ বাড়াবে।
তিনি আরো বলেন, সূর্যমুখীর বীজ যেমন দামী, ঠিক তেমনি এর তেলও দামী। কোন কৃষক যদি এর বীজ এবং তেল বাজারজাত করতে না পারে তাহলে আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে এগুলো বাজারজাত করার ব্যবস্থা করবো। যাতে করে কৃষকের উৎপাদিত বীজ এবং তেল বাজারজাত করা নিয়ে কোন ধরণের টেনশন না করতে হয়। আমি আরো আশা করছি যে, আগামী বছর কাপাসিয়ার প্রতিটি ব্লকে নতুন ফসল সূর্যমুখীর চাষাবাদ শতভাগ বাড়বে।
সূর্যমুখী ফুলের চাষ করলে ফুল থেকে তৈল, খৈল ও জ্বালানী পাওয়া যায়। প্রতি কেজি বীজ থেকে কমপক্ষে ৩৮ থেকে ৪০% তেল আহরণ সম্ভব। অন্যদিকে ফলন ভালো হলে প্রতি বিঘায় ৭ মণ থেকে ১০ মণ বীজ উৎপাদন এবং সেই বীজ থেকে প্রায় ১৪০ থেকে ২০০ লিটার তেল উৎপাদন সম্ভব। বর্তমানে প্রতি লিটার তেলের দাম ২৫০ টাকা। আর প্রতি বিঘা জমিতে খরচ হয় সর্বোচ্চ ৩ থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।
এ ব্যাপারে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. মাহবুব আলম জানান, জেলার ৫ উপজেলায় এবার ৩৮ হেক্টর জমিতে হাইব্রিড আরএসএম-২৭৫ ও বারি সূর্যমুখী-৩ এই দুই জাতের চাষ করা হয়েছে। অন্যান্য ফসলের চেয়ে সূর্যমুখীর চাষ লাভজনক। তবে জেলায় গত বছরও সীমিত আকারে সূর্যমুখীর চাষ হয়েছিলো কিন্তু এবার প্রত্যেক উপজেলায় অনেক বেশি চাষ হয়েছে। এবার সরকারের রাজস্ব কর্মসূচীর আওতায় কৃষকদেরকে কৃষি বিজ্ঞানীদের মাধ্যমে সরাসরি হাতে কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। যাতে করে তারা নতুন এই ফসল আবাদে কোন রকমের সমস্যায় না পড়েন। প্রনোদনা খাতের আওতায় জেলার প্রতি উপজেলায় প্রদর্শনী আকারে সূর্যমুখী চাষের জন্য কৃষকদের সার ও বীজ প্রনোদনা দেওয়া হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, যেহেতু খাবার তেল এখনো আমদানিনির্ভর। তাই আমাদের দেশের এই বিশাল জনগোষ্ঠির তেলের চাহিদা মেটাতে হলে সূর্যমুখীর বানিজ্যিক চাষাবাদ করতে হবে। যেহেতু এটা তেলবীজ ফসল, আর এই বীজে তেলের পরিমাণও বেশি থাকে। তাই আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছি যে, দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য বাজারে যে ভোজ্যতেল পাওয়া যায় তার থেকে বেশি স্বাস্থ্যসম্মত ও মানসম্মত এই সূর্যমুখীর তেল।
তিনি আরো বলেন, আগামীতে এ জেলাতে ব্যাপকভাবে সূর্যমুখী ফুলের চাষ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হবে।