|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
কমিউনিস্ট নেতা আজীবন বিপ্লবী কমরেড মোর্শেদ আলী আর নেই। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র সদস্য এই নেতা দলটির কন্ট্রোল কমিশনের সদস্য, প্রেসিডিয়াম সদস্য, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র (টিইউসি)-এর প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ কৃষক সমিতির সভাপতি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে অংশ নেয়া বীর এই মুক্তিযোদ্ধা বুধবার ৭ই এপ্রিল সকাল সাড়ে ৭টায় বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে মারা যান।
বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি নানানো রোগশোকে ভুগছিলেন। গত ২৬শে মার্চ ব্রেইন স্ট্রোক করলে তাঁকে বারডেম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে তাঁকে বিএসএমএমইউ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। কয়েকদিন তিনি লাইফ সাপোর্টে ছিলেন।
কমরেড মোর্শেদ আলীর মরদেহ বুধবার সকাল ১১টায় হাসপাতাল থেকে সিপিবির কেন্দ্রীয় কার্যালয় মুক্তিভবনে নিয়ে আসা হয়। প্রথমেই সিপিবির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ কাস্তে-হাতুড়ি খচিত কমিউনিস্ট পার্টির লাল পতাকা দিয়ে প্রয়াত কমরেডের মরদেহ আচ্ছাদিত করেন এবং শ্রদ্ধা জানান। এরপর বিভিন্ন দল, সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধা জানান।
সিপিবির বিভিন্ন শাখা ও কমিটি, বাম গণতান্ত্রিক জোট, বাসদ, বাসদ (মার্কসবাদী) বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, ওয়ার্কার্স পার্টি, টিইউসি, কৃষক সমিতি, ক্ষেতমজুর সমিতি, যুব ইউনিয়ন, ছাত্র ইউনিয়ন, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, উদীচী, খেলাঘর, গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতি, সাপ্তাহিক একতা, মুক্তিযুদ্ধে ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনী, মণি সিংহ-ফরহাদ ট্রাস্টসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শ্রদ্ধা জানান।
সেখানে অনুষ্ঠিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশে কমরেড মোর্শেদ আলীর বিপ্লবী স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সিপিবির সভাপতি কমরেড কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, এ দেশের কমিউনিস্ট, প্রগতিশীল আন্দোলনে কমরেড মোর্শেদ আলীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর স্বপ্নের সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইকে অগ্রসর করার অঙ্গীকার করছি।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সিপিবির প্রেসিডিয়াম সদস্য কমরেড আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন। ‘কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ গেয়ে সিপিবি ও বিভিন্ন বামপন্থী দলের নেতা-কর্মীরা কমরেড মোর্শেদ আলীকে শেষ বিদায় জানান।
দুপুরে মুক্তিভবন থেকে কমরেড মোর্শেদ আলীর মরদেহ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেওয়া হয়। সেখানে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় গার্ড অব অনার জানানো হয়। এরপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁর মিরপুরস্থ বাসভবনে।
কমরেড মোর্শেদ আলীর মরদেহ নিয়ে পার্টি নেতা-কর্মীরা ও পরিবারের সদস্যরা পাবনার ঈশ্বরদীর উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছেন। ঈশ্বরদীতে পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হবে।
কমরেড মোর্শেদ আলীর মৃত্যুতে সিপিবির শোক
কমরেড মোর্শেদ আলীর মৃত্যুতে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)’র কেন্দ্রীয় কমিটি গভীর শোক জানিয়েছে। সিপিবির সভাপতি কমরেড মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ও সাধারণ সম্পাদক কমরেড মোহাম্মদ শাহ আলম এক শোক বিবৃতিতে বলেন, কমরেড মোর্শেদ আলী কৈশোরে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট আন্দোলনে যুক্ত হন। তিনি ছিলেন মেধাবী ও জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসুর নেতা হিসেবে ছাত্রসমাজের অধিকার আদায় ও শিক্ষার আন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। ছাত্রজীবনেই তিনি কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন এবং কারাবরণ করেন। ছাত্রআন্দোলন শেষে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির নির্দেশে সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে ডেমরায় বস্তিতে থেকে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তুলতে আত্মনিয়োগ করেন। টিইউসি গড়ে তুলতে তিনি অসামান্য ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কৃষক আন্দোলনে সার্বক্ষণিকভাবে যুক্ত হন এবং নেতৃত্ব দেন। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট সংগঠক। ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা বাহিনীর যোদ্ধা হিসেবে ৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন।
নেতৃবৃন্দ আরো বলেন, কমরেড মোর্শেদ আলী শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের পাশাপাশি নিষ্ঠা ও দক্ষতার সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর থেকে প্রায় ২৮ বছর তিনি ঢাকা মহানগরে পার্টি গড়ে তোলার কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ৯০-এর দশকে কমিউনিস্ট পার্টির অভ্যন্তরে বিলোপবাদী ষড়যন্ত্র শুরু হলে, সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় কমিটির যে কজন নেতা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাঁদের অন্যতম। সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি লেখালেখিতেও সক্রিয় ছিলেন। সহজ-সরল ভাষায় পার্টির বক্তব্য তুলে ধরেছেন।
কমরেড মোর্শেদ আলীর বিপ্লবী স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বিবৃতিতে সিপিবি নেতৃবৃন্দ বলেন, মোর্শেদ আলী এ দেশের শ্রমিক শ্রেণির মুক্তির জন্য আমৃত্যু লড়াই করেছেন। মানুষকে খুব সহজেই কাছে টেনে নিতে পারতেন তিনি। এ দেশের শ্রমিক, কৃষক আন্দোলন তথা কমিউনিস্ট আন্দোলনে কমরেড মোর্শেদ আলীর অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তাঁর মৃত্যুতে দেশ একজন প্রকৃত দেশপ্রেমিক, বিপ্লবী নেতাকে হারালো। তাঁর মৃত্যুতে এ দেশের কমিউনিস্ট, প্রগতিশীল আন্দোলনের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন নিয়ে তিনি সংগ্রাম করেছেন, তাঁর সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে হবে। তাঁর বিপ্লবী জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে বিপ্লবী লড়াইকে অগ্রসর করতে হবে।
শোক কৃষক সমিতির
কমরেড মোর্শেদ আলীর মৃত্যুতে কৃষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি অ্যাড. এস এম এ সবুর ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহির চন্দন গভীর শোক ও শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। শোকবার্তায় নেতৃবৃন্দ বলেন, কমরেড মোর্শেদ আলী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব শেষ করে শ্রমিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন এবং নেতৃত্ব দেন। পরবর্তীতে কৃষক আন্দোলনেও নেতৃত্ব দেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষক সমিতির দুইবার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
আজীবন বিপ্লবী কমরেড মোর্শেদ আলী এদেশের শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের মুক্তিসংগ্রামে প্রেরণার উৎস হিসেবে বেঁচে থাকবেন।