|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
ক্রমবর্ধমান করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সামাল দিতে আসছে বুধবার থেকে সাতদিনের জন্য ‘কঠোর লকডাউন’ ঘোষনা করেছে সরকার। এই সাতদিন সব ধরনের অফিস ও পরিবহন চলাচল বন্ধের পাশাপাশি বাজার-মার্কেট, হোটেল-রেস্তোরাঁসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ১৪ই এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ২১শে এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত এসব বিধিনিষেদ ও নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে। এই সময় সব সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্বশাসিত অফিস এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে বলা হলেও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে শিল্প কারখানা চালু রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
লকডাউনের মধ্যে শপিংমল বন্ধ থাকবে। তবে কাঁচাবাজারে কেনাবেচা হবে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত। হোটেল-রেস্তোরাঁ নির্দিষ্ট সময় শুধু খাবার বিক্রি ও সরবরাহ করতে পারবে। এই সাতদিন অতি জরুরি দরকার ছাড়া সাধারন মানুষকে ঘরের বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। তবে টিকা কার্ড দেখিয়ে টিকা নিতে যাওয়া যাবে।
দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউয়ে রোগী ও মৃত্যু লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকায় এক সপ্তাহের এই ‘কঠোর লকডাউনের’ ঘোষণা এল।
যা কিছু নিষেধ
>> সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি অফিস/আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন। তবে বিমান, সমুদ্র, নৌ ও স্থলবন্দর এবং এ সংশ্লিষ্ট অফিসগুলো এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে থাকবে।
>> বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট আদালতগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা জারি করবে।
>> সকল প্রকার পরিবহন (সড়ক, নৌ, রেল, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যবস্থা ও জরুরি সেবার ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না।
>> শিল্প-কারখানা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। তবে শ্রমিকদের নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় আনা-নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
>> আইনশৃঙ্খলা এবং জরুরি পরিষেবা, যেমন- কৃষি উপকরণ (সার, বীজ, কীটনাশক, কৃষি যন্ত্রপাতি ইত্যাদি), খাদ্যশস্য ও খাদ্যদ্রব্য পরিবহন, ত্রাণ বিতরণ, স্বাস্থ্যসেবা, কোভিড-১৯ টিকা প্রদান, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস/জ্বালানি, ফায়ার সার্ভিস, বন্দর (স্থলবন্দর, নদীবন্দর ও সমুদ্রবন্দর) কার্যক্রম, টেলিফোন ও ইন্টারনেট (সরকারি-বেসরকারি), গণমাধ্যম (প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া), বেসরকারি নিরাপত্তা ব্যবস্থা, ডাক সেবাসহ অন্যান্য জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও সেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অফিস, তাদের কর্মচারী ও যানবাহন এ নিষেধাজ্ঞার আওতার বাইরে থাকবে।
>> অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া (ঔষধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয়, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকার ইত্যাদি) কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না। তবে টিকা কার্ড দেখিয়ে টিকা নেওয়ার জন্য যাতায়াত করা যাবে।
>> খাবারের দোকান ও হোটেল-রেস্তোরাঁয় দুপুর ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা এবং রাত ১২টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত কেবল খাবার বিক্রি/সরবরাহ (কিনে নিয়ে যাওয়া/অনলাইন) করা যাবে। শপিংমলসহ অন্যান্য দোকান বন্ধ থাকবে।
>> কাঁচাবাজার এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৩টা পর্যন্ত উন্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করা যাবে। বাজার কর্তৃপক্ষ/স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করবে।
>> বোরো ধান কাটার জরুরি প্রয়োজনে কৃষি শ্রমিক পরিবহনের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসন সমন্বয় করবে।
এসব বিধিনিষেদ ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে সারা দেশে জেলা ও মাঠ প্রশাসনকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়মিত টহল জোরদার করতে বলা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে। বলা হয়েছে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক তার পক্ষে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগকে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ক্ষমতা দেবেন।
শুক্রবারের জুমা ও আসন্ন রোজায় তারাবি নামাজের জামাত কীভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে করা যায়, সে বিষয়ে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় শিগগিরই নির্দেশনা জারি করবে। এসব নির্দেশনা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগ প্রয়োজনে সম্পূরক নির্দেশনাও জারি করতে পারবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রজ্ঞাপনে।
লকডাউনেও খোলা শিল্প-কারখানা
করোনাভাইরাসের ক্রমবর্ধমান সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ১৪ই এপ্রিল বুধবার থেকে সারাদেশে ‘কঠোর লকডাউন’ জারি করা হলেও এই সময়ে উৎপাদনমুখী কারখানা খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে জারি করা বিধিনিষেধের প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ১৪ই এপ্রিল ভোর ৬টা থেকে ২১ এপ্রিল রাত ১২টা পর্যন্ত এসব নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে।
এই সময় সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্বশাসিত ও বেসরকারি অফিস/আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী নিজ নিজ কর্মস্থলে অবস্থান করবেন। তবে শিল্প-কারখানা স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় চালু থাকবে। নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকদের আনা-নেওয়া নিশ্চিত করতে হবে।
লকডাউনের মধ্যে সকল প্রকার পরিবহন (সড়ক, নৌ, রেল, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইট) বন্ধ থাকবে। তবে পণ্য পরিবহন, উৎপাদন ব্যবস্থা ও জরুরি সেবার ক্ষেত্রে এই আদেশ প্রযোজ্য হবে না।
পোশাক শিল্প মালিকরা ‘লকডাউনের’ মধ্যেও কারখানা খোলা রাখার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএসহ আরও কয়েকটি সংগঠন রোববার ঢাকায় এক যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেও এ দাবি তুলে ধরে।
লকডাউনের প্রস্তুতিতে রোববার বিকালে সরকারের কয়েকটি দপ্তরের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এবং নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের বৈঠক হয়। সেখানে উৎপাদনমুখী কারখানা চালু রাখার বিষয়ে সম্মতি দেওয়া হয় বলে পরে বৈঠকে উপস্থিত একজন বিকেএমইএ নেতা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছিলেন।
লকডাউনে ‘অতি জরুরি’ দরকার ছাড়া বাইরে নয়
করোনাভাইরাসের প্রকোপ নিয়ন্ত্রণে বুধবার থেকে এক সপ্তাহের যে বিধিনিষেধ সারা দেশে কার্যকর হচ্ছে, তাতে সবাইকে অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করা হয়েছে। সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, ওষুধ ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য কেনা, চিকিৎসা সেবা, মৃতদেহ দাফন/সৎকারের মত ‘অতি জরুরি প্রয়োজন’ ছাড়া কোনোভাবেই বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাবে না।
তবে লকডাউনের মধ্যে যাদের টিকা দেওয়ার তারিখ পড়বে, তারা টিকা কার্ড দেখিয়ে যাতায়াত করতে পারবেন।
পণ্যের গাড়িতে যাত্রী না তুলতে সতর্কতা কাদেরের
লকডাউনের সময় পণ্যবাহী যানবাহনে যাত্রী নিলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সোমবার নিজের সরকারি বাসভবন থেকে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি- বিআরটিএর চলমান কার্যক্রম নিয়ে মতবিনিময় সভায় ভিডিও কনফারেন্সে এ কথা বলেন তিনি।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “লকডাউন চলাকালে পণ্যবাহী পরিবহন যাতে কোনোভাবেই যাত্রীবাহী পরিবহনে রূপ না নিতে পারে সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর রাখতে হবে।”
তিনি বলেন, “১৪ই এপ্রিল থেকে সর্বাত্মক লকডাউনের ঘোষণায় লঞ্চ ও ফেরিঘাটে ঘরমুখো মানুষের উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে, কেউ স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্বের বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে না, এ ধরনের মনোভাব করোনা সংক্রমণকে আরও অবনতির দিকে নিয়ে যেতে পারে। প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এ বিষয়ে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।”
কর্মকর্তাদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেন, “করোনাকালে গণপরিবহন চলাচলে শর্ত প্রতিপালনের ক্ষেত্রে অনেক মালিক-শ্রমিক কথা রাখেনি, আবার কেউ রেখেছে। অনেকে সমন্বয়কৃত ভাড়া আদায় করেছে ঠিকই কিন্তু অর্ধেক আসন খালি রাখেনি। এসব বিষয়ে এবং গণপরিবহনে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলকসহ স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের বিষয়ে কঠোর মনিটরিং জোরদার করুন।
‘লকডাউন’ এর মধ্যে পিকআপ ভ্যানে গাদাগাদি করে চলার এই চিত্র গত বৃহস্পতিবার ঢাকার আমিন বাজারে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি‘লকডাউন’ এর মধ্যে পিকআপ ভ্যানে গাদাগাদি করে চলার এই চিত্র গত বৃহস্পতিবার ঢাকার আমিন বাজারে। ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি“প্রয়োজনে মোবাইল কোর্টের সংখ্যা বাড়িয়ে নিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করতে হবে। জেলা পর্যায়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদের সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে। যেখানে অনিয়ম সেখানে ব্যবস্থা নিতে হবে, কাউকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। গণপরিবহন পরিচালনায় সরকার যখন যে নির্দেশনা দিবে তা কঠোরভাবে কার্যকর করতে হবে, এ বিষয়ে সতর্ক দৃষ্টি রাখুন।”
অসাম্প্রদায়িক চেতনার বিরোধীদল চান কাদের
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের সবার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, “দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতি ও বিরোধীদলের ভূমিকা নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়ে থাকে। একথা অনেকাংশে সত্য যে, নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও বাধা-বিপত্তির মধ্যে আমাদের গণতন্ত্র এখনও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হলে সরকারি দলের পাশাপাশি একটি অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তিশালী বিরোধীদল অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে।”
দায়িত্বশীল বিরোধীদল গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে যথেষ্ট অবদান রাখতে পারে মন্তব্য করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, “শক্তিশালী একটি বিরোধীদলের অনুপস্থিতিতে একদিকে যেমন উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সবল হওয়ার উর্বর ক্ষেত্র খুঁজে পায়, তেমনি সরকারি দলেরও একটি অংশের স্বেচ্ছাচারী হওয়ার অবকাশ থেকে যায়। তাই গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে বিরোধীদলের শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল ভূমিকার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।”