|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে সরকারঘোষিত ১৮ দফা বিধিনিষেধের মধ্যেই সারাদেশে শুরু হয়েছে সাত দিনের ‘লকডাউন’ তথা ঘরবন্দিত্ব। লকডাউনে অফিস আদালত ও কলকারখানা খোলা রেখে গণপরিবহন বন্ধ করে দেয়ায় সবথেকে বেশী ভোগান্তিতে পড়েন শ্রমিক ও অফিসমুখি লোকজন। কিন্তু ।
সোমবার লকডাউনের প্রথম দিন রাজধানীসহ সারাদেশেই অনেকেই বিশেষ করে শ্রমজীবি ও কম আয়ের মানুষেরা মানতে পারেননি এই বিধিনিষেধ। তাছাড়া বিধিনিষেধ মানাতেও খুব বেশি কড়াকড়ি দেখা যায়নি আইনশৃংখলা বাহিনীসহ সংশ্লিস্টদের দিক থেকে।
ভোর ৬টায় লকডাউনের শুরু থেকেই ঢাকায় চলছে না কোন ধরণের বাস-মিনিবাসসহ গণপরিবহন। তবে রাস্তাজুড়েই ছিল প্রাইভেট কার, অটোরিকশা ও রিকশা।
সীমিত পরিসরে সরকারি অফিস-আদালতের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কল-কারখানা খোলা থাকায় প্রায় সবাইকেই পায়ে হেঁটে, কিংবা রিকশায় যেতে হয়েছে কর্মস্থলে।
নিধিনিষেধ মেনে বেশীর ভাগ শপিং মল বন্ধ থাকলেও লকডাউন প্রত্যাহারের দাবিতে রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় দ্বিতীয় দিনের মত বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত উম্মুক্ত স্থানে স্বাস্থ্যবিধি মেনে কেনাবেচা করার কথা ছিল। তবে সোমবার সকালে বিভিন্ন এলাকার চিত্র ছিল আগের মতই।
মার্কেট খোলার দাবিতে বিক্ষোভ রাজশাহীতে
লকডাউনের মধ্যে রাজশাহী শহরে মার্কেট খোলার দাবিতে বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ীরা। সোমবার বেলা ১১টার পর সাহেববাজার আরডিএ মার্কেটের সামনে জড়ো হয়ে ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন। পরে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু আসলাম ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানোর আশ্বাস দিলে দুপুর ১২টার দিকে তারা রাস্তা ছেড়ে চলে যান।
ব্যবসায়ী কাজল হোসেন বলেন, তারা ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছেন। প্রশাসন থেকে আলোচনা করে কালকে জানাবেন। দোকানপাট খোলার সিদ্ধান্ত না হলে তারা নিজেরাই দোকান খুলে ফেলবেন বলে জানান।
রাজশাহী কাপড়পট্টি ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার শামিম বলেন, গত বছর লকডাউনের কারণে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে ঠিকমতো ঈদ করতে পারেননি। তিনি লকডাউনের মধ্যে তাদের একটা সময় বেঁধে দেওয়ার আহ্বান জানান।
বোয়ালিয়া থানার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মন বলেন, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু আসলাম এসে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো শুনেছেন। তিনি ব্যবসায়ীদের কথা সরকারের উপর মহলে জানাবেন এমন আশ্বাস দেন। এরপর রাস্তা থেকে ব্যবসায়ীরা চলে যান।
এডিএম আবু আসলাম বলেন, লকডাউন সরকারি সিদ্ধান্ত। সেই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মার্কেট খোলার কোনো সুযোগ নেই। কেউ যদি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে রাখে সেগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে।
প্রথম দিন জরুরি পরিষেবা ছাড়া সব বন্ধ থাকলেও কঠোরভাবে লকডাউন মেনে চলতে মাঠে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সড়কে বাস না চললেও রিকশা ও অটোরিকশা চলছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, এইসব পরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে যাত্রীদের উঠতে ও সামাজিক দূরত্ব মেনে চলতে নির্দেশনা দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। কোথাও যানবাহনে দুই-তিনজনের অধিক দেখলে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনার আবু কালাম সিদ্দিকী বলেন, রোববার রাত থেকেই মার্কেট ও গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। প্রথম দিনে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে যাতে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাড়ির বাইরে না যায়। তবে দ্বিতীয় দিন থেকে আরও কড়াকড়ি করা হবে।
ঢিলেঢালা পাবনায়, মানানোর চেষ্টায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী
করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে সরকার ঘোষিত লকডাউনে ঢিলেঢালা ভাব দেখা গেছে পাবনায়। যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ থাকার কথা থাকলেও সোমবার ঢাকা থেকে যাত্রীবাহী বাস এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই চলাচল করছে ইজি বাইক ও রিকশা।
আইনশঙ্খলা বাহিনী সাধারণ মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছে; তাতে না হলে প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করা হবে বলে জেলার পুলিশ সুপার মুহিবুল ইসলাম খান জানিয়েছেন।
সরেজমিনে পাবনার বাস টার্মিনাল, বড় বাজার, লাইব্রেরি বাজার ও আব্দুল হামিদ রোড ঘুরে দেখা যায়, নিত্য পণ্যের দোকান ছাড়াও অধিকাংশ দোকানই অর্ধেক খোলা। রাস্তা ও ফুটপাতে জটলা করে হকারের দোকানে চলছে কেনাবেচা। বাজারেও শারীরিক দূরত্ব মানা হচ্ছে না।
আব্দুল আলীম নামের একজন ইজিবাইক চালক বলেন, “করোনাভাইরাসের ভয়ে ঘরে বসে থাকলে পেটের ভাত জোগাবে কে? গতবার তাও কোনরকম চাল, ডাল পেয়েছিলাম। এবার তাও দেওয়া হবে না শুনেছি। তাই রাস্তায় নামা ছাড়া উপায় নেই।”
ব্যবসায়ী সমিতির নেতা হাফিজ উদ্দিন বাহার বলেন, “লকডাউন চাই না। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের যে কর্মচারী আছে তাদের দায় আর কতদিন তারা বহন করবে। কাজেই সরকার লকডাউন দিলে এই সমস্ত কর্মচারীদের বেতন সরকারকেই দিতে হবে।”
তিনি এফবিসিসিআই সভাপতিকে বিষয়টা দেখার অনুরোধ জানান।
এদিকে, জনসাধারণকে সচেতন করতে লকডাউন মানার অনুরোধ নিয়ে সোমবার শহরে বিভিন্ন পয়েন্টে ব্রিফিং করেন জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ ও পুলিশ সুপার মুহিবুল ইসলাম খান। এ সময় জনগণকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সরকারের নির্দেশনা মেনে চলার অনুরোধ জানান তারা।
জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, “জনগণ করোনাভাইরাস পরিস্থিতির বিষয়টি গুরুত্ব না দিলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। আমরা প্রতিনিয়ত জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। জনগণ সতর্ক না হলে লকডাউন বাস্তবায়ন করা কঠিন।”
পাবনার পুলিশ সুপার মুহিবুল ইসলাম খান বলেন, “এটা আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ জনগণকে সচেতন করা যাচ্ছে না। আমরা প্রাথমিকভাবে ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা করছি। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগ করা হবে।”
পরে জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার শহরের বিভিন্ন দোকানে সরকারি নির্দেশনা মানার জন্য সতর্ক করেন।
এদিকে, লকডাউন ঘোষণার পর থেকে গত দুই দিনে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। তাদের মাধ্যমে আগামীতে পাবনায় করোনার সংক্রমণ বাড়তে পারে বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা।
পাবনার ডেপুটি সিভিল সার্জন ডা. আবু জাফর বলেন, “গত এক সপ্তাহে দেশের অন্যান্য এলাকার তুলনায় পাবনার করোনা পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণেই ছিল। সংক্রমণের হার ছিল শতকরা ২ ভাগ। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, বাইরে থেকে আসা মানুষের মাধ্যমে সংক্রমিতের হার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই বাইরে থেকে যারা আসছেন তারা যেন অন্তত স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলেন।” অযথা বাইরে ঘুরে সবার জন্য বিপদ ডেকে না আনার অনুরোধও জানান তিনি।
রংপুরে উদ্বিগ্ন নিম্ন আয়ের মানুষ
করোনাভাইরাস সংক্রমণের মধ্যে সারাদেশ এক সপ্তাহের লকডাউনে জীবিকা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন নিম্ন আয়ের মানুষেরা। সোমবার থেকে এক সপ্তাহের লকডাউন শুরু হয়েছে সারা দেশে। এই সময় জরুরি সেবা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান খোলা থাকলেও অন্যান্য সবকিছু বন্ধ রাখারা নির্দেশনা রয়েছে।
রংপুর মহানগরীর জাহাজ কোম্পানি মোড়ের পান দোকানি মালেক মিয়া বলেন, “ভাই আমি তো ছোট্ট একটি খিলিপানের দোকান করে পাঁচ জনের সংসার চালাই। আজ থেকে লকডাউন শুরু হয়েছে। সারাদিনে মাত্র ২০০ টাকার পান বিক্রি করেছি। তাই দিয়ে মাল কিনব না খরচ করে সংসার চালাব। আমরা তো গরিব মানুষ। চিন্তা করছি এখন কী করব। কোথায় যাব, কার কাছে যাব। কেউ তো আমাদের দিকে তাকায় না।”
ছিওবাজার এলাকার রিকশা চালক জহুরুল ইসলাম বলেন, “সকাল থেকে রিকশা চালিয়ে এখন পর্যন্ত ১০০ টাকা ভাড়া মারতে পাই নাই। রিকশার জমা দিব কী? আর সংসারের খরচ করব কী?”
নগরীর চিলমন এলাকার অটোচালক আমিনুর রহমান বলেন, “মহাজানকে জমা দিতে হয় ৫০০ টাকা, আর আমি সকাল থেকে বিকাল পযর্ন্ত ভাড়া মারছি ২৫০ টাকা। লকডাউনের কারণে শহরে লোক নাই। আমাদের তো জমানো টাকা নাই যে এক সপ্তাহ বসে খাব।”
একদিন অটো না চললে পরের দিন পেটে ভাত যায় না বলে আক্ষেপ করেন আমিনুর। সদর হাসপাতল মার্কেটের পাশের ফুটপাতে বসে সেলাইয়ের কাজ করেন দুলাল মিয়া। তিনি বলেন, “ফুটপাতে বসে আর কয় টাকা কামই করি ভাই। গত বছরের লকডাউনের ঋণ এখনও পরিশোধ করতে পারি নাই। এবারও তো লকডাউন হলো। আমরা কী করে খাব? আমরা দিন আনি দিন খাওয়া মানুষ। সকাল থেকে বসে আছি এখনও কোনো কাজ পাইনি।”
ফুটপাতের চায়ের দোকানি শামীম মিয়া বলেন, “আমরা দিন কামাই করা লোক। কামাই না থাকলে খাওয়া জোটে না। এই কয়েকদিন কোনো রকমভাবে সংসার চালিয়েছি। এখন সংসার আর সমিতির কিস্তি কীভাবে দেব। একেবারে পথে বসে গেলাম। গতবার কিছু খাবার পাইছি; এবার কে সাহায্য করবে।”
লকডাউনে শহরে লোকের সমাগম নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, “লোক না থাকলে আমরা কামাই করব কেমনে। এই সময় কারো বাসায় সাহায্য চাওয়ারও উপায় নেই। আমাদের জীবনটা আর পরিবারকে কীভাবে বাঁচাব। করোনা আমাদের পথে বসিয়ে দিল।”
ছাত্রীনিবাস মালিক শহিদুল বলেন, “অনেকগুলো সিট ফাঁকা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। এর মধ্যে লকডাউনের ঘোষণা আমাদের জন্য মরার উপর খরার ঘা।”
রংপুর মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (ডিবি এন্ড মিডিয়া) উত্তম প্রসাদ পাঠক বলেন, “করোনা মোকাবেলায় আমরা নগরবাসীকে কিছু নিয়ম মেনে চলার নির্দেশনা দিয়েছি।”
করোনা মহামারীর ঊর্ধ্বগতি কমাতে ও জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি মানাতে পুলিশ সদস্যরা কাজ করছে বলে তিনি জানান।
রংপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা বলেন, “ত্রাণ দেওয়া বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। সরকার থেকে কোনো ঘোষণাও আসেনি। কোনো সিদ্ধান্ত হলে অবশ্যই আমরা সেটা করব।”
সিলেটে প্রথমদিনেই ভিন্নচিত্র
সিলেটে লকডাউনের প্রথম দিনেই পাল্টে গেছে নগরীর চেহারা। ব্যস্ততম এই নগরীতে অনেকটা কমে গেছে মানুষের আনাগোনা। দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত যে নগরীতে তীব্র যানজট আরও মানুষের আধিক্য থাকতো সেই নগরী এখন শুনশান নীরব। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছেন না। সোমবার সকালে সিলেটের ব্যাংকগুলোতে মানুষের উপস্থিতি কিছুটা বেশি থাকলেও বেলা বাড়ার সাথে সাথে তা কমে যায়।
সিলেটের কদমতলী ও কুমারগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে কোন বাস ছেড়ে না গেলেও নগরীতে বিচ্ছিন্নভাবে চলতে দেখা গেছে সিএনজি অটোরিকশা ও রিকশা। সেই সাথে সিলেট থেকে কোনও ট্রেন ছেড়ে যায়নি এবং সিলেটে কোনও ট্রেন আসেনি। এদিকে লকডাউনে সিলেটের রেস্টুরেন্টগুলোতে সরকারের নির্দেশনা মেনে ভেতরে বসে খাবার খাওয়ার ব্যবস্থা বন্ধ রাখলেও ক্রেতাদের চাহিদা মতো খাবার প্যাকেট করে বিক্রি করতে দেখা গেছে।
সিলেটের আদালত পাড়ায় বিচার প্রার্থীদের উপস্থিতি কম থাকার পাশাপাশি আইনজীবীদের উপস্থিতিও অন্য দিনের চেয়ে একেবারেই কম ছিল। এছাড়া সিলেটের বেশ কয়েকটি আদালতের কার্যক্রম বন্ধ ছিল বলে আইনজীবী সূত্র জানায়।
জানা যায়, লকডাউনের প্রথম দিন সোমবার সকাল থেকে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও নগরীতে সিএনজি অটোরিকশা চলাচল শুরু করে। বিপণী বিতান বন্ধ থাকলেও বিচ্ছিন্নভাবে দোকানপাট খোলা ছিল। এছাড়া স্বাস্থ্যবিধি না মেনে অনেককেই মাস্ক ছাড়া নগরীতে চলাচল করতে দেখা যায়।