মৃত্যুকে অতিক্রম করতে চাওয়া মুর্তজা বশীর মৃত্যুতেই সপে দিলেন নিজেকে

বাংলার জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কনিষ্ঠ সন্তান মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ই অগাস্ট। জন্মবার্ষিকীর দুদিন আগে চিরবিদায় নিলেন তিনি।

|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||

মৃত্যুকে অতিক্রম করতে চাওয়া চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর আর নেই। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে শনিবার সকাল ৯টা ১০ মিনিটে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে মারা যান তিনি। সংবাদ মাধ্যমকে বাবার মৃত্যুর খবর জানিয়েছেন শিল্পীর মেয়ে মুনীর বশীর।

মুর্তজা বশীরকে শনিবার জোহর থেকে আসরের মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হবে।

৮৮ বছর বয়সী এ চিত্রশিল্পীকে এর আগেও বিভিন্ন শারীরিক জটিলতা নিয়ে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে। ফুসফুস ও কিডনি জটিলতার পাশাপাশি তার হৃদরোগও ছিল।

বাংলার জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র কনিষ্ঠ সন্তান মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ই অগাস্ট। জন্মবার্ষিকীর দুদিন আগে চিরবিদায় নিলেন তিনি।

বাবা ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর সঙ্গে ছেলে মুর্তজা বশীর

মুর্তজা বশীরের শিক্ষা জীবন শুরু হয় ঢাকার নবকুমার ইনস্টিটিউশনে, এরপর তিনি পড়াশুনা করেন বগুড়ার করোনেশন ইনস্টিটিউশন, ঢাকা গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট অব আর্টস (এখন যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ) ও কলকাতা আশুতোষ মিউজিয়ামে।

এছাড়াও ইতালির ফ্লোরেন্স একাডেমি দেল্লে বেল্লে আরতিতে চিত্রকলা ও ফ্রেস্কো বিষয়ে ও পরে প্যারিসের ইকোলে ন্যাশিওনাল সুপিরিয়র দ্য বোজার্ট এবং আকাদেমি গোয়েৎসে মোজাইক ও ছাপচিত্রে অধ্যয়ন করেন তিনি। ১৯৭৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আমন্ত্রণে এক মাসের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের ৮টি রাজ্যের বিভিন্ন জাদুঘর ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেন তিনি।

পরে আইসিসিআর ফেলোশিপে তিনি ‘বাংলার শিল্প ঐতিহ্যের’র উপর গবেষণার জন্য ভারতের বিভিন্ন জাদুঘর ঘুরে দেখেন। পরে ‘মন্দির টেরাকোটা শিল্প’ বিষয়েও তিনি ভারতে গিয়ে গবেষণা করেন।

১৯৫৫ সালে ঢাকার নবাবপুর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের ড্রইং শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন।

বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে, প্রতিবাদে মুর্তজা বশীর ছিলেন এগিয়ে থাকা মানুষ। ১৯৫০ সালে কমিউনিস্ট পার্টির ডাকে ময়মনসিংহের হাজং, ভারতের তেলেঙ্গানা ও পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণ ২৪ পরগণার কাকদ্বীপে মুক্ত এলাকা দিবস প্রচার অভিযানে গ্রেপ্তার হন মুর্তজা বশীর। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঁচ মাস জেল খাটেন তিনি।

১৯৫২ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত সুভাষ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পরিচয়’ পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের ওপর ‘পারবে না’ শিরোনামে তার কবিতা ছাপা হয়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত একুশের স্মরণিকায় ‘ওরা প্রাণ দিল’ কবিতাটি পুনর্মুদ্রিত হয়।

মুর্তজা বশীর ও আমিনা বশীর

১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ভষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ভাষা আন্দোলনে শহীদ আবুল বরকতকে রক্তাক্ত অবস্থায় অন্যদের সঙ্গে তিনি হাসপাতালে নিয়ে যান। ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের ছাদে কালো পতাকা উত্তোলনকারীদের মধ্যে তিনি ছিলেন।

২১শে ফেব্রুয়ারির ঘটনার ওপর ‘রক্তাক্ত ২১শে’ শিরোনামে ১২৫২ সালে তিনি লিনোকোটে চিত্রটি আঁকেন,যা হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ শীর্ষক সংকলনে ১৯৫৩ সালে প্রথম মুদ্রিত হয়।

‘রক্তাক্ত ২১’ কে ভাষা আন্দোলনের ওপর আঁকা প্রথম ছবি হিসেবে গণ্য করা হয় বলে এশিয়াটির সোসাইটি জানিয়েছে।

১৯৭১ সালে ১৬ই মার্চ শহীদ মিনার থেকে বাহাদুর শাহ পার্ক পর্যন্ত বাংলাদেশে চারু ও কারুশিল্পী পরিষদের উদ্যোগে ‘স্বা-ধী- ন-তা’ মিছিলে নেতৃত্ব দেওয়াদের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম।

১৯৮২ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে স্বৈরাচারী শাসনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ডাকা ধর্মঘটের নেতৃত্ব দেন।

‘দেয়াল’, ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘কালেমা তাইয়্যেবা’, ‘পাখা’ শিল্পী মুর্তজা বশীরের আঁকা উল্লেখযোগ্য সিরিজ। তিনি ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ নামে একটি শিল্পধারার প্রবর্তক। এছাড়াও ফিগারেটিভ কাজে পূর্ব পশ্চিমের মেলবন্ধনে তিনি স্বকীয়তার স্বাক্ষর রেখেছেন।

২০১৭ সালে মুর্তজা বশীরের পঁচাশিতম জন্মদিনে এশিয়াটিক সোসাইটিতে ‘মুর্তজা বশীর: মানুষ ও শিল্পী’ শিরোনামে এক বক্তৃতায় প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেছেন, “আমার মনে হয়, আমাদের দেশের অনেক শিল্পীর মতো তার মধ্যেও একটা দোলাচাল আছে। নিজের ছবিতে তিনি কী ফুটিয়ে তুলবেন-স্থানকালের বিশিষ্টতা না আন্তর্জাতিক শিল্পধারার আধুনিক উদ্ভাবনের সংলগ্নতা।

তিনি দেশীয় রীতির ঝুঁকেছেন। তবে এখানেই স্থিত থাকেননি। শিল্পী মাত্রেরই মনোজগতের রূপ ও রং বদলায়, বশীরের ক্ষেত্রেও তা ঘটেছে।

চিত্রকলায় অবদানের জন্য ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পদক, ১৯৮০ সালে একুশে পদক, ১৯৭৫ সালে শিল্পকলা একাডেমি পদক পেয়েছেন মুর্তজা বশীর।

তিনি ১৯৬৩ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘কারোয়াঁ’র কাহিনি ও চিত্রনাট্য রচনা করেন। ১৯৬৪ সালে হুমায়ূন কবীর রচিত ‘নদী ও নারীর’ চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক ও প্রধান সহকারী পরিচালক ছিলেন। ১৯৬৫ সালে উর্দু চলচ্চিত্র ‘ক্যায়সে কাহু’র শিল্প নির্দেশক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তার প্রকাশিত গল্প গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে, ‘কাঁচের পাখির গান’, ‘গল্প সমগ্র’। কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘ত্রসরেণু’, ‘তোমাকেই শুধু’, ‘এসো ফিরে অনুসূয়া’, ‘সাদায় এলিজি’। উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে ‘আল্ট্রামেরিন’, ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যে’, ‘অমিত্রাক্ষর’। নির্বাচিত রচনার মধ্যে রয়েছে : ‘মূর্ত ও বিমূর্ত’, ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’। গবেষণাগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’।

এছাড়াও ভারতের বেনারস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘জার্নাল অব দ্য নিউম্যাসটেকি সোসাইটি অব ইন্ডিয়ার’ প্রাক মুঘল যুগের মুদ্রার ওপর বেশ কয়েকটি গবেষণাধর্মী প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়।

মুর্তজা বশীর বাংলা একাডেমি ও এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের আজীবন সদস্য।

এছাড়াও তিনি জাপানের ফুকুওকা এশিয়ান কালচারাল প্রাইজ কমিটির নমিনেটর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কলা ও মানবিক গবেষণা মূল্যায়ন কমিটি ও কমনওয়েলথ স্কলারশিপ নির্বাচন কমিটির সদস্য ছিলেন।

মুর্তজা বশীর ১৯৬২ সালে আমিনা বশীরকে বিয়ে করেন। তিনি দুই মেয়ে মুনীরা বশীর ও মুনিজা বশীর ও এক ছেলে মেহরাজ বশীর যামীর বাবা।

২০১৭ সালে স্ত্রী আমিনা বশীরকে হারানোর পর তিনি আমিনা বশীর স্মৃতি ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন