মানবিক বিপর্যয়ে ভারতে আটকে পড়া বাংলাদেশিরা

|| সারাবেলা ডেস্ক ||
চিকিৎসা করাতে গিয়ে ভারতের তামিলনাড়ু, চেন্নাই ও ভেলোর শহরে করোনাদুর্যোগে আটকা পড়েছেন কমপক্ষে ১০৩জন রোগীসহ ২২৪ জন বাংলাদেশি। দেশটিতে গেল ২৪শে মার্চ থেকে লকডাউন চলতে থাকায় এসব মানুষ দেশে আসতে পারছেন না। অসুস্থজন, নগদ টাকা কমে আসা আর হোটেলমালিকদের দুর্ব্যবহার সবমিলিয়ে যারপর নাই সংকটে পড়েছেন এইসব মানুষ।
দেশে ফেরাতে দিল্লি এবং কলকাতায় বাংলাদেশ হাইকমিশনও কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না বলে অভিযোগ তাদের। প্রথমদিকে দূতাবাসের পক্ষ থেকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগের কথা বলা হলেও, এখন দূতাবাসের হটলাইন নম্বরে ফোন করেও সংযোগ পাচ্ছেন না তারা
আটকে পড়া বাংলাদেশি তাজনিন নাহার জানান, ‘গত ৭ই মার্চ আমি নিজের এবং আমার বাবা-মায়ের চিকিৎসার জন্য তাদের নিয়ে চেন্নাই ও ভেলোরে যাই। ৯ই মার্চ আমি ভেলোরের সিএমসি হাসপাতালে রোগী হিসেবে রেজিস্ট্রেশন করে ১১ই মার্চ থেকে নিজের এবং এরপর ১৪ই মার্চ থেকে আমার মায়ের চিকিৎসা শুরু করি। দুজনের চিকিৎসা ২৬শে মার্চ পর্যন্ত চলেছে। এর মধ্যেই ২১শে মার্চ রাতে জানতে পারি ২২শে মার্চ রোববার সারা ভারত একদিনের জন্য লকডাউন করা হয়েছে। ২৩শে মার্চ রাতে জানতে পারলাম, তার পরের দিন অর্থাৎ ২৪ তারিখ থেকে সারা ভারতে টানা ২১ দিনের লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ওই অবস্থায় কোথাও চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
কারণ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, লকডাউনের আগে থেকে বিদেশিরা যেসব হোটেলে অবস্থান করছেন, তাদের লকডাউন চলাকালেও সেখানেই থাকতে হবে।
হোটেলে তিন দিন থাকার পর তাজনিন দিল্লিস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনে যোগাযোগ করেন। ওই সময় দূতাবাসের পক্ষ থেকে তার নাম, ভারতে কোথায় অবস্থান করছেন সেই ঠিকানা, ভারতে ব্যবহৃত ফোন এবং পাসপোর্ট নম্বর হোয়াটসঅ্যাপ মেসেজে পাঠাতে বলা হয়। এই নির্দেশ মেনে তাজনিন তার বাবা-মাসহ একই হোটেলে অবস্থান করা সকল বাংলাদেশীর বিবরণ টেক্সট করে দেন।
তাজনিন বলেন, ‘পরের দিন অর্থাৎ ২৮শে মার্চ তাজনিন কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনের কাছ থেকে একটি ফোন পান। হাইকমিশন আশ্বস্ত করে জানায়, আটকে পড়া সকলকে দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। এরই মধ্যে তাজনিন নিজ উদ্যোগে চেন্নাই ও ভেলোরের নানা জায়গায় আটকে পড়াদের তথ্য সংগ্রহ করে দূতাবাসে ই-মেইলে করেন। হাইকমিশনে পাঠানো ওই তালিকার একটি অনুলিপি ঢাকা থেকে প্রকাশিত ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে এসেছে। সেখানে রোগীদের নাম, পাসপোর্ট এবং ফোন নম্বর রয়েছে।
তাজনিন বলেন, ‘এর প্রেক্ষিতে ১ কি ২রা এপ্রিল আমাদের জানানো হয়, একটি বিশেষ বিমানে করে আমাদের চেন্নাই থেকে প্রথমে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে। বিমান ভাড়া পড়বে ২০ লাখ; তার মানে ১৬০ জন যাত্রীর জন্য মাথাপিছু সাড়ে ১২ হাজার টাকা। অনেকের অসুবিধা থাকা সত্ত্বেও দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য আমরা সকলেই এতে রাজি হই। কিন্তু এর একদিন পরেই জানানো হয়, এই ব্যবস্থাও নিশ্চিত নয়। এরপর দিল্লি হাইকমিশনে ফোন দেওয়া হলে তারা জানায়, বাংলাদেশে লকডাউন শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ তারা নিতে পারবে না।’
তাজনিন জানান, আটকে পড়া বাংলাদেশি রোগী ও স্বজনদের অবস্থা এখন খুবই শোচনীয়। সকলের জমানো টাকা-পয়সা অনেক আগেই ফুরিয়ে গেছে। লকডাউনের মাঝে দেশ থেকে টাকা আনাও এখন কঠিন। যাদের উপায় আছে, তারা জমিজমা বিক্রি করে হলেও কিছু টাকা আনিয়েছেন। কিন্তু সবাই তো আর তা পারেননি। এখানকার হোটেল মালিকরা এখন ভাড়ার জন্য খুবই দুর্ব্যবহার শুরু করেছে, হোটেল ছাড়ার জন্য তাগিদ দিচ্ছে, টেলিভিশনে ডিশের সংযোগ, বিদ্যুতের লাইন, ওয়াইফাই লাইন বন্ধ করে দিচ্ছে।
এদিকে দূতাবাস যে হটলাইনে ফোন দিতে বলছে, সেখানে ফোন দিলে তা এনগেজড দেখাচ্ছে। অসংখ্যবার চেষ্টা করেও কেউ আর ফোন দিতে পারছেন না’।
তাজনিন আরও জানান, এখানকার (হোটেলের) পানিতে দুর্গন্ধ; পানি কিনে খেতে হয়। কিন্তু লকডাউনের কারণে পানি কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। আবার খাবার নিয়েও সমস্যা। মাছ-মাংস, সবজি কিছুই কেনা যাচ্ছে না। সকালে কিছুক্ষণের জন্য রেশনের দোকাল খোলা থাকে, সেখানে প্রচণ্ড ভীড়ে ভারতীয়দের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করে শুকনো খাবার যেমন; চাল, ডাল, তেল, আলু ইত্যাদি কিনতে হয়।
‘অসুস্থ রোগীদের অনেকেই উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ নানা প্রকার দীর্ঘমেয়াদি রোগে ভুগছেন। প্রতিদিন শুধু আলু, তেল ইত্যাদি খেয়ে ইতোমধ্যেই অনেকের রক্তচাপ বেড়ে গেছে। আমরা একটি মানবিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। অথচ দূতাবাস আমাদের জন্য কিছুই করছে না। আর কিছুদিন এভাবে চললে আমাদের রাস্তায় থাকতে হবে।
তাজনিন বলেন, ‘করোনাভাইরাসের এই ঝুঁকির মাঝে আমাদের খাদ্যের সন্ধানে এখন প্রতিদিন বাইরে যেতে হয়। অনেকেই না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন হোটেল কক্ষে। এই অবস্থা থেকে আমরা মুক্তি চাই। আমরা নিজ দেশে ফিরে আসতে চাই।’#
সংবাদসূত্র: দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন