দেশে করোনাভাইরাসের সবচে শক্তিশালী ধরনটি ‘শনাক্ত’ করলেন বিজ্ঞানীরা

শুরু থেকেই বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের চেহারা নির্ধারণে সচেষ্ট হয়েছেন। বিশ্বজুড়ে এই প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে করোনার কোন চেহারা বা রূপটি বাংলাদেশের মানুষকে বেশী সংক্রমিত করছে তা খুঁজে পাওয়া গেছে দেশের গবেষণাগারেই।

|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||

নতুন করোনাভাইরাস বারবার তার চেহারা বদলাচ্ছে বলেই এর প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কারে হিমশিম খাচ্ছেন গবেষকরা। তাই বলে থেমে থাকছেন না তারা। শুরু থেকেই বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের চেহারা নির্ধারণে সচেষ্ট হয়েছেন। বিশ্বজুড়ে এই প্রচেষ্টার ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে করোনার কোন চেহারা বা রূপটি বাংলাদেশের মানুষকে বেশী সংক্রমিত করছে তা খুঁজে পাওয়া গেছে দেশের গবেষণাগারেই।

বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবের গবেষকরা নতুন এই ভাইরাসের জিনবিন্যাস বিশ্লেষণ করার পর রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে বিস্তারিত তুলে ধরেন । বাংলাদেশের রাষ্ট্রিয় এই বিজ্ঞান গবেষণাগারের বিজ্ঞানীরা বলছেন, জিন বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে এই চেহারা খুঁজে পাওয়ায় প্রাণ সংহারী এই ভাইরাসের গতি-প্রকৃতি বুঝে সংক্রমণের পরবর্তী ঢেউ ঠেকানোর প্রস্তুতি যেমন নেওয়া যাবে, তেমনি তা এর প্রতিষেধক টিকা তৈরির কাজটিও সহজ করবে।

গত বছরের ডিসেম্বরে চীনের উহান শহর থেকে প্রথম ছড়ায় নতুন এই প্রাণঘাতি ভাইরাস। দ্রুতই তা মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে সারাবিশ্বে। মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত করে বলেই জনদূরত্ব মানাই হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র প্রতিষেধক। ফলে মানুষকে ঘরে থাকতে বাধ্য করে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো। স্থবির হয়ে পড়ে আর্থ-সামাজিক সব কর্মকান্ড। তারপর সংক্রমণের শুরু থেকে গেল সাতমাসে এই ভাইরাসে সারাবিশ্বে সংক্রমিত হয়েছে প্রায় দেড় কোটি মানুষ। মারা গেছে ৬ লাখের বেশি মানুষ।

মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করায় সার্স সিওভি-২ নামের এই ভাইরাসের প্রকৃতি বুঝতে বিশ্বজুড়ে গবেষকরা এর জিনবিন্যাস খুঁজে বের করতে সচেষ্ট হয়। এই চেষ্টায় নতুন করোনাভাইরাসটির রূপ বদল করে সংক্রমণ ঘটানোর বিষয়টিও নজরে আসে তাদের।

বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষকরাও এ পর্যন্ত এই ভাইরাসের ১৭১টি জিনোম সিকোয়েন্সিং ডেটা হাতে নিতে পেরেছেন। যেগুলো ইতোমধ্যেই তারা ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনোলজি ইনফরমেশন (এনসিবিআই) ও গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা (জিএসএআইডি)-তে জমাও দিয়েছেন।

বিসিএসআইআরের ডেজিগনেটেড রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস-ডিআরআইসিএম ল্যাবে রোববারের সংবাদ সম্মেলনে এসবেরই বিস্তারিত তুলে ধরলেন জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবের প্রধান সেলিম খান।

করোনাভাইরাসের শরীরে ১২৭৪টি প্রোটিন থাকে জানিয়ে এই গবেষক বললেন, “এগুলোর মধ্যে ২১২ থেকে ৫২৩ পর্যন্ত হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ স্পাইক প্রোটিন। এর মধ্যে আমরা কোনো মিউটেশন বা রূপ বদলের প্রমাণ পাই নাই। ৬১৪-জি করোনাভাইরাস যে স্ট্রেইনটি সিকোয়েন্সিংয়ে শনাক্ত হয়েছে, তা কিন্তু এর বাইরে পড়ছে। আমরা প্রত্যেকটি জিনোম সিকোয়েন্সে ‘ডি৬১৪জি’ করোনাভাইরাস স্ট্রেইনটি পেয়েছি।”

তিনি বললেন, তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে তার জিনোমিক লেভেলে ৫৯০টি ও প্রোটিন লেভেলে ২৭৩টিরও বেশী পরিবর্তন ঘটিয়েছে। এগুলোর মধ্যে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ‘ডি৬১৪-জি’ করোনাভাইরাস স্ট্রেইনটি সিকোয়েন্সিংয়ে শনাক্ত হয়েছে, যাকে তারা বাংলাদেশে সংক্রমণের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন।

সেলিম খান বলেন, “আমরা ২১২ থেকে ৫২৩ পর্যন্ত ৮টি মিউটেশন পেয়েছি ইউনিক, এই মিউটেশনগুলো পৃথিবীর অন্য কোথাও ঘটে নাই। আমাদের নজর রাখতে হবে আমরা আরও ইউনিক মিউটেশন পাই কি না।”

উল্লেখ্য, বাংলাদেশে সংক্রমণের প্রধান কারণ এই ডি৬১৪জি’ ধরনটি গত ফেব্রুয়ারির শুরুতে ইউরোপে প্রথম দেখা গিয়েছিল। এখন যা ভারত, ব্রাজিল, ইরানেও সংক্রমণের প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে।

‘ডি৬১৪-জি’ ধরনটি নিয়ে চীনের গবেষকরা বলছেন, করোনাভাইরাসে সংক্রমিতদের শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হয়, তা পরবর্তীতে করোনাভাইরাসের বিভিন্ন ধরনগুলোকে ঠেকাতে পারলেও ‘ডি৬১৪-জি’কে প্রতিরোধ করতে পারে না।

প্রতিষেধক বা টিকা আবিষ্কারের প্রচেষ্টায় বিসিএসআইআরের এই গবেষণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে জানিয়ে সেলিম খান বলেন, “যখন কোনো মেডিসিন, ভ্যাক্সিন ডিজাইন করবে, সমস্ত মিউটেশন মাথায় রেখে ডিজাইন করতে হবে।”

সংবাদ সম্মেলনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান দেশে করোনাভাইরাসে নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের ভিত্তিতে বলেন, “বাংলাদেশের করোনাভাইরাসটি ইতালির ভাইরাসটির সাথে বেশি নিবিড়।”

চলতি বছরের মে মাসে সারাদেশে করোনাভাইরাসের সঠিক চিত্র জানতে ৮টি বিভাগ থেকে সংক্রমণের হার ও জনসংখ্যার পরিসংখ্যানিক ভিত্তিতে এই ভাইরাসের সর্বমোট ৩০০টি সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন করতে জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরিকে প্রকল্প হাতে নেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়।

এরপর থেকেই বিসিএসআইআরের গবেষক দলটি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন অ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের সার্বিক সহযোগিতায় সারা দেশ থেকে নমুনা ও রোগীদের মেডিকেল ইতিহাস সংগ্রহ ও জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

সেলিম খান এও জানান, বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের পাশাপাশি কোভিড-১৯ এর রোগীর নমুনায় সহাবস্থায় অন্যান্য আরও রোগ সংক্রামক জীবাণু বা প্যাথোজেনের উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন। এখন তারা সেই জীবাণুগুলোর উপস্থিতিতে সংক্রমনের তীব্রতার সম্ভাব্য যোগসূত্র খুঁজে বের করতে গবেষণা চালাচ্ছেন।

এছাড়াও বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা কোভিড-১৯ রোগীর নমুনায় অন্যান্য মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট জিনের উপস্থিতি শনাক্ত করতে সমর্থ হয়েছেন বলে জানান সেলিম খান। এই পরিস্থিতিতে রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের জন্য জিনোম সিকোয়েন্সিং কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তা তুলে ধরেন তিনি। বলেন, করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সিং দ্রুততর এবং বৃহত্তর স্তরে পরিচালিত হলে ভাইরাস কীভাবে কীভাবে মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে, তা বুঝতে চিকিৎসক, রোগতত্ত্ব বিশেষজ্ঞ ও জনস্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করবে, যাতে ভবিষ্যৎ মহামারী রোধ করার জন্য কর্ম পরিকল্পনা নির্ধারণ করা যায়।

তিনি বলেন, “মানুষ হতে মানুষে ইনফেকশন বিস্তারের মাধ্যমে করোনাভাইরাসের জিনোমগুলো ক্রমাগত পরিবর্তন হতে থাকে। এই পরিবর্তনগুলো রেকর্ড ও বিশ্লেষণ করে, ভাইরাসটির বিস্তাররোধে জিনোম সিকোয়েন্সিং প্রযুক্তি ফলপ্রসূ ভূমিকা পালন করবে। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বার সময়ে অঞ্চল ভেদে ভাইরাসটি তার স্বতন্ত্র রূপ -মিউটেশন তৈরি করতে পারে, সেক্ষেত্রে সিকোয়েন্সিংয়ের মাধ্যমে অঞ্চলভিত্তিক এই স্বতন্ত্র ভাইরাস স্ট্রেইন শনাক্তকরণের মাধ্যমে মহামারী পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে সেকেন্ড ওয়েভের সময়ে অতি দ্রুত ভাইরাসের সম্ভাব্য উৎস স্থল শনাক্ত করা সম্ভব হবে।”

এছাড়াও এই ভাইরাসের পরিবর্তনগুলো রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়াতে কতটা ভূমিকা রাখছে এবং রোগের তীব্রতা বা লক্ষণসমূহের সঙ্গে করোনাভাইরাসের মিউটেশন সরাসরি সম্পর্কিত কি না, তা নির্ধারণেও সিকোয়েন্সিং ডেটা সহায়তা করতে পারে।

এক্ষেত্রে বিসিএসআইআর বাংলাদেশের অন্যান্য গবেষণা সংস্থা ও ঔষধ প্রশাসনকে তথ্যউপাত্ত দিয়ে সহায়তা করবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়।

জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবের বিজ্ঞানীরা ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন ও ইউনিভার্সিটি অব নটিংহ্যামের বায়োইনফরমেটিক্স দলের সঙ্গেও কোভিড-১৯ এর প্রভাব বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ গবেষণায় যুক্ত হয়েছেন জানিয়ে বিজ্ঞানমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান বলেন, “নভেল করোনাভাইরাসের জীবন রহস্য উন্মোচনের মাধ্যমে এর উৎস, গতি, প্রকৃতি ও বিস্তার সঠিকভাবে জানতে পারলে তা থেকে খুব সহজেই আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো। বিশেষ করে এই তথ্য উপাত্ত করোনাভাইরাসের চিকিৎসা এবং ওষুধ বা টিকা তৈরির ক্ষেত্রে বিস্তর সুবিধা দেবে। ফলে দ্রুতই সমস্যার সমাধান হবে।”

এখন পর্যন্ত পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা ৬৭ হাজার ৫২৪ এর বেশি করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স ডেটা গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটা (জিএসএআইডি)-তে প্রকাশ করেছেন।

ইয়াফেস ওসমান বলেন, “এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১৭১টি করোনাভাইরাসের জীবন রহস্য তথ্য পাঠানো হয়েছে। এই গবেষণার ব্লুপ্রিন্ট বিশ্বে চলমান ভ্যাকসিন গবেষণা গ্রুপের সাথে প্রকাশ করে তাদের ভ্যাকসিন গবেষণায় অংশীদার হওয়ায় চেষ্টা চলছে।”

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আনোয়ার হোসেন এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন এ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক একেএম শামসুজ্জামান।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন