করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট ঠেকাতে আরো জোরালো পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ

যারা কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে আসেন, তারাও এখন আর আগের মতো আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টিনে থাকেন না। তবে আক্রান্তদের অন্তত পরিবার যেন কোয়ারেন্টিনে থাকে, সেটি নিশ্চিত করা দরকার। এসব ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও সহায়তা লাগবে

|| সারাবেলা প্রতিবেদক ||

দেশে করোনা ভাইরাস সংক্রমণের মাত্রা গেলো কিছুদিন ধরে বাড়তে থাকার পর্যায়কে উদ্বেগের বিষয় হিসেবে দেখছে সরকারসহ সংশ্লিস্টরা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব বলছে,  এ বছর মহামারীর ২১তম সপ্তাহে (২৩-২৯শে মে) সারা দেশে নমুনা পরীক্ষা হয় এক লাখ ৯ হাজার ৬৫১টি। তাদের মধ্যে শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মোট নয় হাজার ৬৬০ জন এবং ওই সপ্তাহে মারা গেছেন ২০১ জন।

পরে অর্থাৎ ২২তম সপ্তাহে (৩০শে মে থেকে ৬ই জুন পর্যন্ত)  মোট এক লাখ ১৯ হাজার ২০২টি নমুনা পরীক্ষায় মোট ১১ হাজার ৯২৮ জন রোগী শনাক্ত করা হয়। এ সময়ে সারাদেশে মারা গেছেন মোট ২৫২ জন। এই হিসাব অনুযায়ী, এক সপ্তাহের ব্যবধানে শনাক্তের হার বেড়েছে ২৩ দশমিক ৪৮ শতাংশ এবং মারা যাওয়ার হার বেড়েছে ২৫ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

এর আগে ২০তম সপ্তাহে অর্থাৎ (১৬ থেকে ২২শে মে) ১৯তম সপ্তাহের (৯ থেকে ১৫ই মে) চেয়ে সংক্রমণ বাড়ে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ। তবে সে সময় মৃত্যুহার কমে দাঁড়ায় ৮ দশমিক ৯৪ শতাংশ। মূলত ঈদের আগে পরীক্ষা কমে যাওয়ায় শনাক্ত কমে গিয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে ভারতে পাওয়া করোনাভাইরাসের ধরনটিতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাংলাদেশে বাড়তে থাকার মধ্যে এক সপ্তাহের ব্যবধানে সংক্রমণের এমন ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে।

এমন পরিস্থিতিতে কোয়ারেন্টিন ও জেলাভিত্তিক কঠোর লকডাউনের পরামর্শ এসেছে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে। আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, “সীমান্ত ব্যবস্থাপনার কারণে সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার একটু ধীরে হলেও সেটি বাড়ছে। সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় ঘাটতি থাকলে নেপালের মত আরও বাড়তে পারত।তবে সংক্রমণের হার যে বাড়ছে, সেটি শুধু সীমান্ত এলাকাতেই না, দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন এলাকায় হচ্ছে। কোনো কোনো জেলায় এখনও কম আছে, কিন্তু গড় হিসাব করলে দেখা যাবে সেটির হার ১০ এর উপরে।”

ভাইরাসের নতুন ধরন

বিশ্বজুড়ে প্রাণঘাতি এই ভাইরাসের উপস্থিতি ধরা পড়বার পর থেকে সাম্প্রতিক ভারতে পাওয়া এর ধরনটি সবথেকে বেশী মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে। ইতোমধ্যেই তা ভারত ছাড়িয়ে বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশেও বিস্তার লাভ করছে। যা কিনা সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর জন্য নতুন উদ্বেগের জন্ম দিয়েছে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান-আইইডিসিআর এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইদেশি মিলে মধ্য মে থেকে যেসব করোনাভাইরাসের জেনোম সিকোয়েন্স করেছে, তার ৮০ শতাংশেই মিলেছে এ ভাইরাসের ভারতে পাওয়া ধরনটি, যার নাম বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা দিয়েছে ‘ডেলটা’।

ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকাতেও করোনাভাইরাসের অতি সংক্রামক ওই ধরনটি পাওয়া গেছে। আক্রান্তদের ইতিহাস পর্যালোচনা করে আইইডিসিআর মনে করছে, ইতোমধ্যে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের ‘ডেলটা’ ধরনটির সামাজিক বিস্তার বা কমিউনিটি ট্রান্সমিশন ঘটেছে, যা উদ্বেগজনক। ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “নতুন নতুন ভ্যারিয়েন্ট এলে সেটি আগের ভ্যারিয়েন্টকে সরিয়ে দেয়। যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তাহলে দেশেই নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হতে পারে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যদি সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তাহলে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হবে। নতুন ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ বাড়ায় না, বরং সংক্রমণ বাড়লে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হয়।”

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. নজরুল ইসলাম করোনাভাইরাসের নতুন ধরনের দ্রুত বিস্তার প্রসঙ্গে বলেন, “আমাদের দেশে ২২টি জেলায় সংক্রমণের হার বেড়েছে। তার মধ্যে ১৫টিই সীমান্তবর্তী জেলা। ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্ট ইতোমধ্যে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু ইন্ডিয়ান ভ্যারিয়েন্টই না, এবারের ঈদুল ফিতরে ঢাকা থেকেও যারা এসব জেলায় গিয়েছেন, তাদের মধ্যেও অনেকেই ভাইরাস বহন করে নিয়েছেন বলে ধারণা করা যায়।”

করণীয় কী?

নতুন এই ভ্যারিয়েন্ট সামাল দিতে করণীয় সম্পর্কে ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “বাংলাদেশে সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় কিছুটা ঘাটতি এখনও আছে। যারা পাসপোর্ট নিয়ে আসছে, তাদের জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু যারা পাসপোর্ট ছাড়া আসছে, তাদেরকে ভয়ভীতি না দেখিয়ে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা দরকার। যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করলে সবাই কোয়ারেন্টিনের আওতায় থাকবে। যারা উচ্চ সংক্রমণশীল এলাকায় আছে, তাদের ক্ষেত্রে কোয়ারেন্টিন যেন কার্যকরী হয়, সেই বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। তাদের বোঝাতে হবে তাদের মধ্যেই অনেকে সংক্রমিত, যারা হয়ত শনাক্ত হচ্ছে না, কিন্তু তাদের শনাক্ত হওয়ার আশংকা রয়েছে। তাদের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই আর সংক্রমণ ছড়াবে না।”

দেশের ভেতরে যত নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে, তাদের সবারই আইসোলেশন নিশ্চিত করা দরকার জানিয়ে তিনি বলেন, “করোনাভাইরাস পজিটিভদের সরকারি সহায়তায় আইসোলেশনের ব্যবস্থা করা জরুরি। অনেক সীমিত আয়ের মানুষ আছে, যারা ঘরে থাকলে তাদের রোজগার বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে সামাজিক সমস্যাও রয়েছে। এইজন্য তারা বলছে না যে তারা করোনাভাইরাস পজিটিভ। তাদের ক্ষেত্রে যথাযথ সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।”

সাবেক এই বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এও বলেন, “আবার যারা কোভিড-১৯ রোগীর সংস্পর্শে আসেন, তারাও এখন আর আগের মতো আইসোলেশন কিংবা কোয়ারেন্টিনে থাকেন না। তবে আক্রান্তদের অন্তত পরিবার যেন কোয়ারেন্টিনে থাকে, সেটি নিশ্চিত করা দরকার। এসব ক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদেরও সহায়তা লাগবে বলে মনে করেন তিনি।

আর জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. নজরুল ইসলাম মনে করেন, সংক্রমণ এক জেলা থেকে আরেক জেলায় যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য প্রত্যেক জেলায় আলাদাভাবে জরুরিভিত্তিতে লকডাউন ঘোষণা করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, “সংক্রমণ রোধে জেলাভিত্তিক আলাদাভাবে সচেতন করতে হবে। জেলার মধ্যে লকডাউন বাধ্যতামূলক করা প্রয়োজন এবং প্রত্যেককে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।”সংক্রমণরোধে স্বাস্থ্যবিধি মানা এবং জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।

সংবাদ সারাদিন