|| বার্তা সারাবেলা ||
করোনাভাইরাস সংক্রমণে বিশ্বে আজ সবথেকে বিপর্যস্ত দেশ ভারত। সংক্রমণসংখ্যার দিক থেকে দেশটি প্রতিদিনই গড়ছে নতুন নতুন বিশ্ব রেকর্ড। বিপর্যস্ত এই পরিস্থিতির জন্য করোনভাইরাতের ভারতীয় ধরণটিই দায়ি কিনা তা বুঝবার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা। তারা খুঁজতে চেষ্টা করছেন মাত্র দুই মাসের মধ্যে ভারতের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি এতটা খারাপ হলো কী করে?
করোনাভাইরাসের এই ভ্যারিয়েন্ট বা ধরনটির আনুষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছে বি.১.৬১৭। ভারতে প্রথম এ মিউট্যান্টটি শনাক্ত হয়েছিল বলে একে ভারতীয় ধরন বলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে মোট ১৭টি দেশে করোনাভাইরাসের এ ধরনটি পৌঁছে গেছে, তাতে বিশ্বজুড়ে তৈরি হয়েছে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা। নতুন এ ধরনটি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা যা জানতে পেরেছেন, তা তুলে ধরা হয়েছে রয়টার্স ও বিবিসির দুটি প্রতিবেদনে।

করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন আসলে কি?
বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক আর ত্রাস সৃষ্টি করা নতুন করোনাভাইরাসের বাইরের দিকে রয়েছে কাঁটার মত অংশ, যাকে বলা হয় স্পাইক প্রোটিন। মানব কোষকে আক্রমণের সময় ভাইরাসের এই ধরণটি ওই স্পাইক প্রোটিন কাজে লাগায়। ওই স্পাইক প্রোটিনের কারণেই এ করোনাভাইরাস অনেক বেশি সংক্রামক হয়ে উঠছে বলে বিজ্ঞানীদের ধারণা।
ভারতের জ্যেষ্ঠ ভাইরোলজিস্টদের একজন শহিদ জামিল এ প্রসঙ্গে বলেছেন, করোনাভাইরাসের বি.১.৬১৭ ধরনটির ওই স্পাইক প্রোটিনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন বা মিউটেশন হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্য অনুযায়ী, ভারতে করোনাভাইরাসের বি.১.৬১৭ ধরনটি প্রথম শনাক্ত হয় গত বছর ডিসেম্বরে। কাছাকাছি আরেকটি ধরন অক্টোবরেই শনাক্ত হয়েছিল।
গবেষণকদের ধারণা, এ ধরনটির জিন বিন্যাসে এমন কোনো পরিবর্তন হয়েছে, যা হয়তো এই ধরণটিকে আরও সংক্রামক করে তুলতে পারে, অসুস্থতার মাত্রা আরও গুরুতর করে তুলতে পারে, কিংবা টিকার সুরক্ষাও অকার্যকর করে দিতে পারে।
এর আগে যুক্তরাজ্য, সাউথ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে শনাক্ত নতুন ধরনগুলোর ক্ষেত্রেও একইরকম ঝুঁকি থাকার কথা বলা হচ্ছিল। এর সবগুলো ধরনকেই ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা উদ্বেগজনক ধরন হিসেবে চিহ্নিত করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। তবে ভারতীয় ধরণটিকে ডব্লিউএইচও বর্ণনা করেছে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবে।
এ ধরনটি বেশি বিপদজনক?
করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি বেশি বিপদজনক বা বেশি সংক্রামক কিনা, অথবা টিকার প্রতিরোধ ভেঙে ফেলতে পারে কি না- এখনও সে বিষয়ে নিশ্চিত কিছু বলতে পারছেন না বিজ্ঞানীরা।



যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির ভায়রোলজিস্ট ড. জেরেমি কামিল বলেন, “ভারতীয় ধরনটির একটি মিউটেশন বা পরিবর্তনের সঙ্গে সাউথ আফ্রিকা ও ব্রাজিলে চিহ্নিত ধরনের মিউটেশনের মিল রয়েছে। এই পরিবর্তনের কারণে ভারইরাসটি আমাদের দেহকে সুরক্ষা দেওয়া অ্যান্টিবডিকে পরাস্ত করতে সহায়তা করতে পারে। আগের সংক্রমণ বা টিকার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এমনটি ধারণা করা যায়।”
তবে যুক্তরাজ্যে শনাক্ত হওয়া ধরনটি এরই মধ্যে ৫০টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “আমার সন্দেহ, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটির চেয়ে বরং যুক্তরাজ্যের ধরনটি বেশি সংক্রামক- এবং আমাদের অবশ্যই আতঙ্কিত হলে চলবে না।”
ভারতীয় ধরনটি সম্পর্কে তথ্যে ঘাটতি কেন?
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরন সম্পর্কিত অনেক তথ্যউপাত্তই অসম্পূর্ণ এবং খুবই কম সংখ্যক নমুনার বিশ্লেষণ হয়েছে। ভারতে ২৯৮টি এবং বিশ্বে ৬৫৬টি নমুনার জেনেটিক সিকোয়েন্স করা হয়েছে, যেখানে যুক্তরাজ্যের ধরনটির ৩ লাখ ৮৪ হাজার সিকোয়েন্স করা হয়েছে এরই মধ্যে। ফলে ভারতীয় এই ভ্যারিয়েন্ট সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য এখনও বিজ্ঞানীদের হাতে নেই।
সংক্রমণ বাড়ার জন্য নতুন ধরণটিই দায়ী?
এটা বলা কঠিন জানিয়ে ডব্লিউএইচও বলছে, এটা বোঝার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আরও গবেষণা দরকার। কারণ পরীক্ষাগার-নির্ভর সীমিত নমুনার ওপর পরিচালিত গবেষণায় সংক্রমণ বাড়াতে এ নতুন ভ্যারিয়েন্টের ভূমিকা থাকার ইঙ্গিত মিলেছে।
ভারতের ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজেস কনট্রোলের পরিচালক সুজিত কুমার সিংহ বলেন, সংক্রমণ ছড়িয়ে পরার চিত্রটি একটু জটিল, কারণ যুক্তরাজ্যে প্রথম শনাক্ত হওয়া বি.১১৭ ধরনটি ভারতের কিছু অঞ্চলে সংক্রমণ বাড়ার জন্য দায়ী। মার্চের দ্বিতীয় ভাগ থেকে নয়া দিল্লিতে যুক্তরাজ্যের ধরনটির সংক্রমণ দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু ভারতে মহামারীতে সবচেয়ে নাকাল রাজ্য মহারাষ্ট্রে ভারতীয় ধরনটির ব্যাপক মাত্রায় বিস্তার পেয়েছে।



ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটন-এর রোগতত্ত্বের বিশেষজ্ঞ ক্রিস মারি বলেন, ভারতে অল্প সময়ের মধ্যে যে ব্যাপক মাত্রায় সংক্রমণ ছড়িয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে, ওই এলাকায় নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট সক্রিয়, যেটা আগের সংক্রমণের কারণে ওই জনগোষ্ঠীর মধ্যে তৈরি হওয়া স্বাভাবিক ইমিউনিটিকেও ভেঙে ফেলছে। এ থেকে ধারণা করা হচ্ছে, এটা সেই ‘বি.১.৬১৭’।”
অবশ্য ভারতে করোনাভাইরাসের জিন বিন্যাস বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে তথ্যউপাত্তের যে ঘাটতি আছে, এবং এই বিপুল সংখ্যায় সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার জন্য যুক্তরাজ্য এবং সাউথ আফ্রিকার ধরনটিও যে দায়ী হতে পারে, সেসব কথাও মনে করিয়ে দিতে চান বিল মারে।
রোমের বামবিনো গেসু হাসপাতালের অনুজীববিজ্ঞান ও প্রতিরোধবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান কার্লো ফেদেরিকো পেরনো বলেন, ভারতে করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের জন্য শুধু ভারতীয় ধরনটিই ‘এককভাবে দায়ী হতে পারে না’, বরং তিনি সেদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন উপলক্ষে ব্যাপক জনসমাগমের দিকেও ইঙ্গিত করেন।
যুক্তরাজ্যের ওয়েলকাম স্যাংগার ইনস্টিটিউটের ড. জেফরি ব্যারেট বলেন, “করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি সেদেশে গত বছরের শেষভাগ থেকেই বিচরণ করছে। এটাই যদি সংক্রমণ বাড়ার পেছনে মূল চালিকাশক্তি হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে এই পর্যায়ে পৌঁছাতে ভাইরাসের এই ধরনটিকে কয়েক মাস সময় নিতে হয়েছে, যা থেকে একটি ধারণা মেলে যে এই ধরনটি সম্ভবত কেন্ট-এ শনাক্ত হওয়া বি.১১৭ এর চেয়ে কম সংক্রামক।”



টিকা কি একে থামাতে পারে?
এ প্রশ্নের উত্তরে কিছুটা আশার কথা শুনিয়েছেন হোয়াইট হাউজের মুখ্য চিকিৎসা উপদেষ্টা অ্যান্থনি ফাউচি। গেলো সপ্তাহের শুরুতে এক ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, গবেষণার প্রাথমিক ফলাফল বলছে, ভারতে উৎপাদিত টিকা কোভ্যাক্সিন করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটিকে নিষ্ক্রীয় করতে সক্ষম।
ইংল্যান্ডের জনস্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, তারা আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে এ বিষয়ে কাজ করছে এবং এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ মেলেনি যে করোনাভাইরাসের ভারতীয় ধরনটি কিংবা আরও দুটি ধরন বর্তমানে ব্যবহৃত টিকাগুলোর কার্যকরিতা কমিয়ে দিতে পারে।