শফিকুল ইসলাম টুক্কার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি

বাবা মারা যান ১৯৬১ সালে। আমার বয়স তখন তিন কি সাড়ে তিন। সে হিসাবে আমার জন্ম ১৯৫৮ সালে। মুক্তিযুদ্ধসময়ে আমার বয়স ১৩ কিংবা ১৪ বছর। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার মা আমাকে নিয়ে অথৈ সাগরে পড়েন। সে সময় মা আমাকে নিয়ে ওঠেন তার বাবা শুকুর শেখের বাড়িতে। আমি বড় হতে থাকি নানার বাড়িতে। একটু বড় হলে মা আমাকে নানা বাড়ির সামনেই রাস্তার ধারে বসিয়ে দেন বাদাম বুটকালাইয়ের দোকান দিয়ে। বেচাবিক্রি কী হতো তা জানি না, তাতে মায়ের হয়তো দু’চার পয়সা আয় হতো, কিন্তু আমরা চলতাম নানার সংসারেই।

শফিকুল ইসলাম টুক্কা

একাত্তুরের অসহয়োগ আন্দোলনের সময় গ্রামের সব মানুষের সঙ্গে শহরে মিছিল করতে আসতাম, এতে আমার খুব আনন্দ হতো। ২৫শে মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরু হলে সে কথা গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ধীরে ধীরে মানুষের মধ্যে ভীতিকর অবস্থা শুরু হতে থাকে। গুজব ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে যে, পাকসেনারা সিরাজগঞ্জ শহরে চলে আসতে পারে। এ ভীতিকর অবস্থায় অনেকেই শহর ছাড়তে শুরু করে।

আমাদের নানা-মামার পরিবারেও এ নিয়ে আলোচনা চলতে শুরু করে। কারণ আমাদের শহর ছেড়ে গ্রামে গিয়ে থাকার মতো কোনও আত্মীয়-স্বজন নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই।

২৭শে এপ্রিল পাকসেনারা সিরাজগঞ্জ আসার দু’এক দিন আগে সিরাজগঞ্জ বয়রাঘাটে বিমান থেকে বোমা নিক্ষেপ করে। সেখানে এক রিকশাচালক ও এক ঘোষ শহীদ হন। অন্যদের সঙ্গে আমিও শহীদদের দেখতে যাই।

তাদের দেখে আসার পরে বাড়ির সবাই প্রস্তুতি নেই গ্রামের দিকে চলে যাওয়ার জন্য। নিজেদের কোনও আত্মীয় না থাকায় বাড়ির বাৎসরিক কামলা হবির বাড়ি শাহানগাছা গ্রামে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরিবারের যা কিছু নেওয়ার মত সেসব মালামাল এবং গরুছাগল নিয়ে পরিবারের সবাই রওনা হই হবির বাড়ি শাহানগাছার দিকে। তার একদুই দিন পরেই সিরাজগঞ্জে পাকসেনারা এসে দখলে নিয়ে আগুন দিতে শুরু করে। আমরা শাহানগাছা গ্রাম থেকে সে আগুন ও আগুনের ধোঁয়া দেখতে পাই।

পাকসেনারা সিরাজগঞ্জ দখলে নিয়ে শুরু করে নির্যাতন, মানুষ খুন আর জ্বালাও পোড়াও। গণহত্যার বিভীষিকাময় কথাবার্তা গ্রাম থেকেই জানতে পারি। এর মধ্যেই কেউ কেউ শহরে এসে ঘুরে যাচ্ছে। এতে আমাদেরও সাহস একটু বাড়ে। প্রায় কুড়ি দিন পর একদিন আমি আর রফিক মামা গ্রামে আসি বাড়ির অবস্থা দেখার জন্য। সেদিন বাড়ির কাঠাল গাছ থেকে বেশ কিছু কাঠাল নিয়ে শাহানগাছা ফিরে যাই। একই দিনে পুড়িয়ে দেওয়া এক দোকানের ছাইয়ের মধ্যে বেশ কয়েক আনা পয়সা কুড়িয়ে পাই। তা নিয়ে গিয়ে গেলে মা খুব খুশি হন।

এরপর থেকে একদুই দিন পর পরই মামার সাথে শহরে আসতে শুরু করি। আমার শুরু হয় পোড়া দোকানের ছাইয়ের মধ্যে পয়সা খোটার কাজ। কখনো মামার সঙ্গে কখনো বা একা একা পয়সা খুঁজে ফিরতাম। সবই পেতাম খুচরা পয়সা। কারণ নোট তো পুড়ে গেছে, কিন্তু খুচরা পয়সাগুলো আগুনে পুড়েও টিকে আছে। কোনও কোনও দিন পেতাম এক টাকা দেড় টাকা কখনো বা দশটাকার খুচরা পয়সাও কুড়িয়ে পেয়েছি। যেদিন বেশী পয়সা পেতাম সেদিন আনন্দে মনটা নেচে উঠতো। আমি সব পয়সা মায়ের হাতে তুলে দিতাম। মা এ সব পয়সা দিয়ে সংসারের খরচ চালাতেন। চালডাল কেনা ছাড়াও মা দুধভাতের ব্যবস্থা করতেন সে পয়সা দিয়ে।

শহরে এসে জানপুরে নিজের বাড়ির অবস্থা দেখে ভিক্টোরিয়া স্কুলের পাশ দিয়ে ঢুকতাম শহরে। ওই রাস্তা দিয়ে চলে আসতাম চৌরাস্তা, সেখান থেকে শহরের অন্যান্য জায়গায় যেতাম। ভিক্টোরিয়া স্কুলের মধ্যে বেশ কিছুদিন পাকসেনারা ক্যাম্প করে ছিল, সেখানে পাকসেনা ও রাজাকারদের দেখেছি।

সত্যনারায়ণ সারদা সতিয়াদের বাড়িতে রাজকার, আলবদরের ক্যাম্প করা হয়েছিল। সেখানে আলবদর রাজাকারদের আড্ডা দিতে দেখেছি। এ ছাড়াও শহরের মধ্যে বড় পুলসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে রাজাকারেরা রাইফেল কাধে নিয়ে ডিউটি করতো।

মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় আমাদের পরিবার শাহানগাছার হবির বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে ছিলো। শেষের দিকে এসে গ্রামে গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের আনাগোনা বাড়ে। সবাই তখন আলোচনা করতো, তাড়াতাড়িই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। শৈলাবাড়ি যুদ্ধে গোলাগুলির আওয়াজ পাই শাহানগাছাতোই।

অবশেষে সিরাজগঞ্জ থেকে ১৩ই ডিসেম্বর পাকসেনারা পালিয়ে যায়, মুক্ত হয় সিরাজগঞ্জ। এর দুতিন দিন পরেই আমরা পুরো পরিবার শাহানগাছা থেকে চলে আসি সিরাজগঞ্জ শহরে। শহরে এসে ভিক্টোরিয়া স্কুল, সিরাজগঞ্জ কলেজ সহ বিভিন্ন স্থানে দেখতে পাই মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প। ভিক্টোরিয়া স্কুলে রাজাকারদের দেখেছি আটকে রাখতে, যারা ক’দিন আগেও শহরময় দাপটের সাথে ঘুরে বেড়াতো।

পুনশ্চ: স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরওে শফিকুল ইসলাম টুক্কা চৌরাস্তার মোড়ের চায়ের দোকানী। এক কন্যা দুই পুত্র সন্তানের বাবা টুক্কার যাপিত জীবন লাখো স্বাধীন বাঙালির মতই টানাপোড়েনের।

অনুলিখন: সাইফুল ইসলাম।

১৮ thoughts on “শফিকুল ইসলাম টুক্কার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি”

  1. What i do not realize is in truth how you’re not actually much more well-appreciated than you may be right
    now. You’re so intelligent. You understand therefore significantly on the subject of this subject,
    produced me for my part consider it from so many numerous angles.
    Its like women and men are not involved until it’s one thing to do with Girl gaga!
    Your own stuffs great. At all times maintain it up!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন