জীবনানন্দ দাশ : জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা

জীবনানন্দকে উপেক্ষার কারণ সম্ভবত—তিনি অন্য কারো মতো নন—বাংলা কবিতায় অপ্রচলিতের প্রবর্তক তিনি। হয়তো কবিমাত্রই অবজ্ঞার শিকার—বিখ্যাত না হলে সেই সব শীতলতা আমাদের অজানা থেকে যায়।

|| মজিদ মাহমুদ || 

জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯-১৯৫৪) ইংরেজিতে কবিতা লিখতে চেষ্টা করেছিলেন, কিছু প্রবন্ধও লিখেছিলেন। কিন্তু সেসব উৎকৃষ্ট হয়নি। হলেও বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি পাঠকের তাতে এসে যেত না। তিনি মধুসূদনের মতো ইংরেজি সাহিত্যে বিখ্যাত হওয়ার (অপ)চেষ্টা করেননি। কারণ মাইকেল আগেই উপলব্ধি করেছিলেন, ‘পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণি আচরি।’ ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ও শিক্ষক হওয়ার সুবাদে জীবনানন্দ দাশ ঔপনিবেশিক প্রভুদের ভাষা ভালো করেই রপ্ত করেছিলেন। তদুপরি ইংরেজি সাহিত্যের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক তাকে বাংলা কবিতার সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সহায়ক হয়েছিল। উনিশ শতকের সূচনালগ্নে যাদের হাতে বাংলা সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি হয়েছিল তারা সকলেই ইংরেজি ভাষা-সাহিত্যে পারদর্শী।

মধ্যযুগেও বড় মাপের বাঙালি কবিরা একাধিক ভাষায় সুপণ্ডিত ছিলেন। আলাওল থেকে ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর সকলের জন্য এ কথা সত্য। আলাওলের বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মাবতী’ হিন্দি কবি মালিক মুহম্মদ জায়সির ‘পাদুমাবতে’র অনুবাদ; তেম্নি ফারসি ভাষার পণ্ডিত ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর ‘যবানী’ মিশাল ভাষায় কাব্য রচনা করেই কাব্যত্বের শীর্ষে উঠে এসেছিলেন। জীবনানন্দ দাশও এই সত্য টের পেয়েছিলেন। বাংলা কবিতার উৎকৃষ্ট তালিকায় তিনি আলাওলের নাম এনেছিলেন শ্রদ্ধার সঙ্গে। আলাওল ইংরেজি জানতেন না। সম্ভবত এশিয়ার কোনো কবিই জানতেন না। জানা দরকার হয়নি। এদেশে ইংরেজ আসার আগে বাংলা ভাষায় একটি ইংরেজি শব্দ পর্যন্ত ছিল না। তখন ইংরেজ জাতিকেই বিদেশী ভাষা শেখার কসরত করতে হয়েছিল। আলাওলকে স্বীকৃতিদান জীবনানন্দ দাশের দেশ-কালের বাইরে বেরিয়ে আসার অন্যতম লক্ষণ। আরবি-ফারসি-সংস্কৃতি ও হিন্দির মাধ্যমে দুনিয়ার অধিকাংশ উৎকৃষ্ট সাহিত্যের সঙ্গে আলাওলের পরিচয় ঘটেছিল। ইংরেজি সাহিত্যের ভুবনখ্যাত শেক্সপীয়ারের নাম তখন পর্যন্ত পৃথিবীর কোনো প্রান্তের লোকই জানতেন না। ইংরেজ শাসন সুবাদে যে যৎসামান্য ভালো কিছু সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছিল তার অন্যতম শেক্সপীয়ার। শেক্সপীয়ার জন্মসূত্রে আলাওলের কিছুটা জ্যেষ্ঠ হলেও জায়সির হিন্দি ‘পাদুমাবৎ’ রচিত হয়েছিল শেক্সপীয়ারের জন্মের আগে। আলাওল এসব ভাষায় সুপণ্ডিত হলেও তার রচনা অপ্রয়োজনীয়ভাবে বিদেশী শব্দদুষ্ট নয়।

জীবনানন্দ দাশ কবি ও সাহিত্য সমালোচকের জন্য ইংরেজি শেখার আবশ্যকতা অনুভব করেছিলেন। ‘দেশ কাল ও কবিতা’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি এ ব্যাপারে সবিস্তারে আলোচনা করেছেন। বাংলা কবিতার মঙ্গলার্থে ইংরেজি জানার ওপর জোর দিয়েছিলেন। তবে তিনি বিশ্বাস করেননি, ইংরেজি কবিতা জগতের উৎকৃষ্ট। তার ভাবনা ছিল, ইংরেজি বিশ্বভাষা হওয়ার সুবাদে অন্য ভাষার মহৎ সাহিত্যও এ ভাষার মাধ্যমে জানা সম্ভব। পঠন ও পাঠদানের ক্ষেত্রে ইংরেজিয়ানা তাকে প্রাত্যহিক মানব সমাজের সঙ্গে যুক্ত করেছিল।

জীবনানন্দ দাশের ক্ষেত্রে এ ধরনের আলোচনার বিপদ সামনে রেখে সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হচ্ছে। বড় মানুষের জীবন ও কর্ম নিয়ে আমরা সব সময় নির্ভয় হয়ে বলতে পারি না। সত্যের পাশাপাশি একটি প্রক্ষিপ্ত চরিতও তাদের আচ্ছন্ন করে রাখে। অলস পাঠকের ক্ষেত্রে, শ্রুতি মুগ্ধকের ক্ষেত্রে সেটিই একমাত্র আশ্রয়। বুদ্ধদেব বসু জীবনের শুরুতেই জীবনানন্দ দাশকে ‘নির্জনতার কবি’র ছাপ্পা মেরে দিয়েছিলেন। যার কপি বাঙালি পাঠক বগলদাবা করে ঘুরছেন। জাতি হিসেবে আসল বইয়ের চেয়ে নোটের কদর আমাদের কাছে কিছুটা বেশি। তবে বুদ্ধদেব বসু ছিলেন একজন সৎ সমালোচক। জীবনানন্দ দাশকে পাঠকের সামনে এনে দেয়ার প্রথম সাহসী কাজটি তিনি করেছিলেন। ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ গ্রন্থ আকারে প্রকাশের আগেই বুদ্ধদেব বসু ‘প্রগতি’ পত্রিকায় জীবনানন্দের নতুনত্বের সপক্ষে কলম ধরেছিলেন। জীবনানন্দ দাশের মৃত্যুর বহু বছর পরেও উপেক্ষিত ছিলেন, তার প্রমাণ মিলবে ১৯৭২ সালে ভারতে আকাদেমির আয়োজনে বাঙালি কবিদের একটি হিন্দি সংস্করণে। জীবনানন্দের দুই দশক পরের কবিরাও সেখানে ঠাঁই পেয়েছিলেন কিন্তু জীবনানন্দ ছাড়া। এমনকি কবিগুরুর সবার প্রতি অবারিত আশীর্বাদও জীবনানন্দের জন্য অবিমিশ্র ছিল না। একটু বিরক্ত হয়েই যেন বলেছিলেন—‘তোমার কবিত্বশক্তি আছে তাতে সন্দেহমাত্র নাই।—কিন্তু ভাষা প্রভৃতি নিয়ে এত জবরদস্তি করো কেন বুঝতে পারিনে।’

অথচ ভাষা নিয়ে জবরদস্তি ও তাকে বশ মানাতে পারাই তো বড় কবির কাজ। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বমাপের হওয়া সত্ত্বেও কোথায় যেন বিশেষ করে ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে তার মধ্যে কিছুটা রক্ষণশীলতা কাজ করেছে। নজরুলের সঙ্গে তাঁর বাহাস বাংলা সাহিত্যে খুনের মামলা হিসেবে (কু)খ্যাত হয়ে আছে। সম্ভবত বাংলা ভাষার শক্তি নিয়ে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে কিছুটা সংশয়ও ছিল; নিজের কৃতিত্বে নোবেল পাওয়া সত্ত্বেও বাংলা সর্বভারতীয় ভাষার দাবিদার হওয়ার ব্যাপারে তিনি দ্বিধাহীন হতে পারেননি। জীবনানন্দ কিন্তু অবলীলায় বলেছিলেন,—‘বাংলা যে রকম ভাষা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাতে স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রভাষার স্থান স্বভাবতই তার প্রাপ্য।’

জীবনানন্দকে উপেক্ষার কারণ সম্ভবত—তিনি অন্য কারো মতো নন—বাংলা কবিতায় অপ্রচলিতের প্রবর্তক তিনি। হয়তো কবিমাত্রই অবজ্ঞার শিকার—বিখ্যাত না হলে সেই সব শীতলতা আমাদের অজানা থেকে যায়। মাইকেল রবীন্দ্রনাথ নজরুলের মতো জীবনানন্দও ছিলেন প্রাতিস্বিক—আপন বৈশিষ্ট্যে আলাদা। তাদের জীবন-যাপন ধর্ম ও বিশ্বাস; তাদের রচনার বিষয় ও আঙ্গিক তাদের নিজেদের। বাংলা কবিতার এই চার প্রধান পুরোহিত প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে আসেননি। গভীর অর্থে এই চারজনই বিদ্রোহী ও বৃত্তবিরোধী—চেতনায় ও প্রকরণে।

তবে অসতর্ক প্রচারণায় ক্ষতি যা হওয়ার তাই হয়েছে। বলা হয়েছে, জীবনানন্দ দাশ পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়ার ভয়ে কিছুটা রাস্তা ঘুরে আসতেও ইতস্তত করতেন না। অতিথির কথা না ভেবেই ঘরে রাখা একটিমাত্র চেয়ারে বসে পড়তেন। রাত জেগে শিশিরের শব্দ শুনতেন। এসবই হয়তো সত্য—তবে এলিয়টভক্ত রবীন্দ্রপূজকের পক্ষে সত্য হওয়া কি সম্ভব? তাছাড়া জীবনানন্দের সমকালীন কিংবা তার পরবর্তী বিশ্বের কবিরা যখন রাষ্ট্রদূত থেকে শৈল্য চিকিৎসার ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরছেন তখন জীবনানন্দ দাশ কেবলই কবি, তাই বা কতখানি আদরণীয়? মিরোস্লাব হোলুবের ডাক্তারি, নেরুদার কূটনীতি, নিকানোর পাররার পদার্থবিজ্ঞান—সমকালে প্রচারিত ছিল। অথচ জীবনানন্দ জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন—সেই সত্য মানতে আমাদের কষ্ট হয়। কবিপত্নী লাবণ্য দাশ জীবনানন্দ দাশের এই নিস্ক্রিয়-মূর্তির বিরোধিতা করেছিলেন— ‘অনেকে বলেন, তিনি নিপাট ভালো মানুষ—কোনো দিকে তার দৃষ্টি ছিল না ইত্যাদি। এ সব যখন শুনি, বা পড়ি, তখন আমার খানিকটা অদ্ভুত লাগে। কারণ ঐ ছবিতে আমি যেন আমার অচেনা ব্যক্তিত্বহীন একজন সাজানো সৌখিন কবির তৈরি করা ছবি দেখতে পাই। আমি ঐ ব্যক্তিত্বহীন জীবনানন্দকে সত্যিই চিনি না।’

জীবনানন্দ দাশের বিচিত্র ও বিশাল সাহিত্যকর্মের সবটুকু এখনো আমাদের কাছে এসে পৌঁছেনি। আবদুল মান্নান সৈয়দসহ দু-একজন পরিশ্রমী সাহিত্য সমালোচকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে যে সব তথ্য এসে পৌঁছেছে তার আলোকে বলা যায়, জীবনানন্দের হৃদয় সংবেদ সমকালীন অপরাপর কবির চেয়ে সূক্ষ্ম ও গভীর। কিন্তু কবি হিসেবে তার যীশুভাবমূর্তি আমাদের হতাশ করে। এটি বিচার করে দেখার সময় এসেছে। যীশুকে নিয়ে ‘লাস্ট টেম্পটেশন অফ ক্রাইস্ট’ ছবিতে কিন্তু বাম গালে চড় খেয়ে ডান গাল পেতে দিতে দেখা যায়নি। রীতিমতো বিদ্রোহী—তা না হলে ইহুদি যাজকদের ক্ষমা ডাকাত বারাব্বাকে ছুঁয়ে গেলেও যীশুকে অস্পর্শ রেখে দেয়! যে ক্রুশে তাকে বিদ্ধ করা হয় তাতে ‘সিডিশন’ লেখা ছিল।

জীবনানন্দ দাশের জন্ম ও জীবনকাল ছিল সারা বিশ্ব তথা ভারতবর্ষের সবচেয়ে ঘটনাবহুল সময়। তার জীবদ্দশায় দুই-দুটি বিশ্বযুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। রাশিয়ায় মার্কস নির্দেশিত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিশ্ব-রাজনৈতিক ভূগোলের ব্যাপক পরিবর্তন। যুগান্তকারী বৈজ্ঞানিক ঘটনাসমূহের আবিষ্কার। তদুপরি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঘটনাবহুল মহারণের দিনসমূহ। বিশেষ করে বিশ শতকের শুরু থেকেই প্রায় সারা বিশ্বে জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতার চরম বিকাশ ঘটেছিল। ইউরোপে নাৎসি—নাজি ও বলশেভিক আন্দোলন, এশিয়ায় চীনের বিপ্লব ও জাপানের জাতীয়তাবাদী চেতনা; লাতিন আমেরিকা থেকে আফ্রিকা পর্যন্ত জাতীয় চেতনার কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হয়ে উঠছিল। আর এসব জাতীয়তা উপ্ত হয়েছিল আন্তর্জাতিক চেতনা বিকাশের ফলে। তখন ভারতবর্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী (বাংলা) ভাষার একজন প্রতাপ ও প্রভাবশালী কবি কী করে কেবল ইতিহাসের মহাকালের চেতনালোক নিয়ে কাব্যরচনায় সন্তুষ্ট থাকতে পারেন? আমাদের আবিষ্কারের কোথায় যেন একটু ভুল হয়ে গেছে। না হলে জীবনানন্দ দাশকে কেন আমরা ‘রূপসী বাংলা’র কবি বলি। জীবনানন্দ কি নিজে সেই পরিচয়ে তুষ্ট থাকতে চেয়েছিলেন? তাহলে কবির জীবদ্দশায় এই অমরগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি আলোর মুখ দেখলো না কেন? লিখলেন চল্লিশের দশকে আর গ্রন্থ আকারে বের হলো ষাটের দশকে, মৃত্যুর তিন বছর পরে ১৯৫৭ সালের আগস্ট মাসে। কবির জীবদ্দশায় এ ধরনের অনন্যসুন্দর কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ না করার কী কারণ থাকতে পারে? যে বিবেচনাগুলো আমি ভেবেছি:

১. কবি যাকে রূপসী বাংলা বলছেন তা সমকালীন নয়, মহাকালের চেতনালোক থেকে উৎসারিত সময় চেতনা থেকে উদ্ভূত বাংলা; যে বাংলার সঙ্গে অনুশীলন গোষ্ঠীর সন্তানদের পরিচয় ছিল না, যারা স্বাধীনতার জন্য শক্তির পদে নিজেদের উৎসর্গ করেছেন।

২. মৃত্যুচেতনা ও নস্টালজিয়া—যা তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের বিপরীত।

৩. কবি এমন একটা সময়ের বাংলার রূপকল্প অঙ্কন করেছেন, যখন এদেশে মুসলমান আসেনি, ইংরেজ আসেনি—এই বাংলা কেবল হিন্দুর। এই চেতনা দেশকেন্দ্রিক জাতীয়তাবাদী চেতনার বিরুদ্ধে। (জওহরলাল নেহেরু ডিসকভারি অফ ইন্ডিয়া গ্রন্থে বলেছিলেন, ‘এক জাতীয়তার চারিদিকে জমে ওঠে প্রীতির অনুভূতি, নানারূপ জাতীয় প্রথা বা সংস্কার এবং একই উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে সমস্ত জাতির জীবনকে একসূত্রে গাঁথতে চায়।’) এক জাতীয়তার ক্ষেত্রে এই নিষ্পাপ বইটিও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

৪. আঙ্গিকের শিথিলতাও কবির ভাববার কারণ হতে পারে। তাই নিজের সঙ্গে একটু বোঝাপড়া করে নিতে চাচ্ছিলেন।

৫. তবে সবচেয়ে বড় কারণ হয়তো কবি ভেবেছিলেন, এই গ্রন্থটি প্রকাশিত হলে তার চেতনার তীক্ষ্নতা ও বহুমুখিতা পাঠকের কাছে পৌঁছতে বাধার সম্মুখীন হবে; জীবনোপলব্ধির যে গভীরতা তিনি বাঙালি পাঠকের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন—সার্বিক বিবেচনায় এ গ্রন্থে তা অনুপস্থিত।

সুতরাং, নির্জনতার কবি কিংবা রূপসী বাংলার কবি বলে আমরা যে সিল এঁটে দিয়েছি তা জীবনানন্দ দাশ পঠনে একটি বড় অন্তরায়। জীবনানন্দ দাশ বাংলা কবিতায় কী এমন অসাধ্য কাজ করেছিলেন যার জন্য তার মৃত্যুর পঞ্চাশ বছর পরেও আমাদের নতুন নতুন করে আবিষ্কার করতে হচ্ছে? জীবনানন্দ দাশ আসলে বস্তুর সঙ্গে মানুষের যে সংঘাত, নশ্বরতার সঙ্গে অবিনশ্বরের দ্বন্দ্ব, মর মানুষের সঙ্গে শাশ্বতের সম্পর্কায়নের যে কষ্ট—আমাদের মনও যেন সব সময় আমাদের নয়—যে চেতনা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না—সেই মনের মতো জটিল ভাষাশৈলীর ভেতর দিয়ে তিনি আমাদের নিয়ে যেতে চেয়েছেন; যার সবখানি এখনো আমাদের পরিচিত নয়। তিনি প্রশ্ন তুলেছিলেন—শিকার ও শিকারির মধ্যে মৌলিক কোনো পার্থক্য আছে কিনা। বলেছিলেন ‘বৈকুণ্ঠ ও নরক থেকে তারা কতখানি দূর।’ ‘তবুও বেদম হেসে খিল ধরে যেতো ব’লে বেড়ালের পেটে/ইঁদুর ‘হুররে’ বলে হেসে খুন হতো সেই খিল কেটে কেটে।’

জীবনানন্দ দাশের জাতীয়তা আন্তর্জাতিকতার যে বিষয় নিয়ে এ আলোচনার সূত্রপাত, তা একটু খোলাসা করে নেয়া যাক। আন্তর্জাতিক ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ আলোচনা শুরু করা হয়েছে। কিন্তু জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতাবাদের যে রাজনৈতিক প্রসিদ্ধি, কবির ক্ষেত্রে তা অবান্তর। জাতীয়তার একটি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক ব্যাখ্যা থাকলেও কবির আন্তর্জাতিকতা বলতে প্রায়ই চিরন্তনতা বোঝানো হয়ে থাকে। আর তা মূলত মানবচেতনা ও বিশ্বচেতনার আন্তর্জাতিকতা। রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তা ও আন্তর্জাতিকতা নিয়ে নেপাল মজুমদার দুই খণ্ডে বিশাল গ্রন্থ রচনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের জন্য অবশ্য রাজনৈতিক অর্থেই আন্তর্জাতিকতা প্রাসঙ্গিক ছিল। বোধের আন্তর্জাতিক উদ্বোধনের সঙ্গে সমন্বয় সাধন ছাড়াও বিশ্বরাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ভাবিত ছিলেন। তাই ইউরোপ থেকে এশিয়া পর্যন্ত জলে স্থলে অন্তরীক্ষে সোয়ার হয়ে তৎকালীন বিশ্বব্যবস্থার অসঙ্গতি তুলে ধরে কখনো প্রশংসিত কখনো তিরস্কৃত হয়েছেন। বিশেষ করে আমেরিকা ও চীন ভ্রমণের তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা আমাদের জানা আছে।

জীবনানন্দ ভারতবর্ষের বাইরে কোথাও গিয়েছেন কিনা তার জীবনীকাররা উল্লেখ করেননি। হয়তো যাননি। কিন্তু জীবনানন্দ দাশ সারা জীবনই ছিলেন একজন পর্যটক—নাবিক ও অশ্বারোহী। জীবনানন্দের ব্যক্তি ইমেজ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে এ বিষয়টি স্মরণ রাখলে কিছু উদ্ধার পাওয়া সম্ভব। বাঙালি এমনকি ভারতবর্ষ দুটি গুরুত্বপূর্ণ (রণ) কৌশল থেকে পিছিয়ে ছিল। তার একটি ঘোড়া আর একটি যুগোপযোগী সমুদ্রযান অর্থাৎ (রণ) তরী। বাঙালিদের ইতিহাসের কালে পিছিয়ে থাকার এটিও অন্যতম কারণ। এদেশ আক্রান্ত হয়েছে ঘোড়ার মালিক আর সমুদ্রের ওপর যারা আধিপত্য বিস্তার করেছিল তাদের দ্বারা। অথচ নদীবেষ্টিত বরিশালের চিরলাজুক ও কারো কারো দৃষ্টিতে পলায়নপর জীবনানন্দ দাশ তার রচনায় তুলে এনেছেন অশ্বের হ্রেষা আর সমুদ্রের ডাক। পর্যটন ও শিকারের কাহিনী তার কবিতার মুখ্য অনুষঙ্গ। মানব হৃদয়ের সঙ্গে চিরন্তন গ্রন্থনা ছাড়াও ভ্রমণাকাঙ্ক্ষা ছিল সর্বব্যাপ্ত। জাতির জীবনে এমন কোনো ইচ্ছার ইঙ্গিত সুপ্ত থাকে; যা কারো কারো মাঝে প্রকাশ ঘটে। জীবনানন্দের ক্ষেত্রে সেই অনুক্ত চেতনার আশ্চর্য প্রকাশ ঘটেছিল। তার রচনায় শাদা ধূসর অদ্ভুত সব রঙের ঘোড়া মহাকালের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে দাপাদাপি করে বেড়ায়।

কবি মানব হৃদয়ের আবিষ্কারক—মানুষের যে সর্বব্যাপ্ত অনুভূতি, প্রেমিক হৃদয়ের হাহাকার, সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসা, মরদেহের অমরতার আকাঙ্ক্ষা কবি ভাষার মাধ্যমে তা ধারণ করেন। ভাষার সঙ্গে চেতনা আর বস্তুর সংঘাতের তীব্রতাই শিল্পের গভীরতা নির্ণায়ক। সেদিক দিয়ে পাঁচ হাজার বছর আগের কবির সঙ্গে বর্তমান কবির পার্থক্য কম। এমনকি গ্রিক কবি হোমার আর বাঙালি কবি শাহ মুহম্মদ সগিরেরও তেমন তফাত নেই। ইলিয়াডে হেক্টর নিহত হওয়ার পরে বৃদ্ধ পিতা প্রায়ামের হাহাকার; আর ‘ইউসুফ জুলেখা’র হারানো ইউসুফের জন্য বৃদ্ধ পিতা ইয়াকুবের আর্তনাদ প্রায় একই রকম। বীরধর্মবিরোধী পুত্র হত্যাকারীর পদস্পর্শ করে নিহত পুত্রের লাশ ভিক্ষা করেছেন রাজা প্রায়াম। তেম্নি ইয়াকুব নবী বলছেন, যে ধর্ম আমার হারানো পুত্রকে ফিরিয়ে দেবে আমি সেই ধর্ম গ্রহণ করবো। পুত্র বাৎসল্যের এই চিরন্তন সত্য সর্বধর্মে সর্বভাষাভাষী ও জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে একই মাত্রায় বিদ্যমান। যেমন বলা হয় বড় মানুষদের চিন্তার মিল থাকে; তেমনি বড় কবিদেরও রচনার অন্তর্নিহিত সত্যের রূপ এক। আর কবির চেতনামূলে গেঁথে থাকে তার স্বদেশ ও সমকাল। যে কারণে শাহ মুহম্মদ সগির মরুভূমির বনি ইসরাইলী সন্তান এবং মুসলমানদের অন্যতম নবী তাকেই কি না নিয়ে আসলেন ভারতে এবং জুলেখাকে বানালেন মূর্তিপূজক।

সে দিক দিয়ে চেতনা ও প্রকাশভঙ্গিতে জীবনানন্দ দাশ পূর্ণমাত্রায় জাতীয়তাবাদী ও আন্তর্জাতিক। দু-একটা উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। জীবনানন্দ দাশের চেতনা গভীর ও সর্বব্যাপী হলেও প্রকাশভঙ্গি পূর্ণমাত্রায় স্বদেশনির্ভর। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় যদিও ভাষার ওপর জবরদস্তি তিনি করেছেন; তবু সে ভাষা সরাসরি অন্যভাষায় তর্জমা করা মুস্কিল। কারণ তার বক্তব্য কেবল শব্দকে অবলম্বন করে পাঠকের কাছে পৌঁছতে পারে না। তার শব্দ একা চলতে জানে না; বাংলার নদী-মাঠ-ভাটফুল; ঘোড়ায় চড়ে অতীত ঋষিদের সঙ্গে আকাশের নক্ষত্রে উড়ে; পায়ের তলে লিকলিকে ট্রামের লাইন জড়িয়ে তবেই না পাঠকের কাছে এসে পৌঁছে। ভাষা প্রয়োগের ক্ষেত্রে জীবনানন্দ ছিলেন একটু বেশি মাত্রায় জাতীয়তাবাদী। প্রায় একই সময়ে জন্মগ্রহণকারী পল্লীকবি বলে খ্যাত জসীমউদ্দীনের চেয়েও বেশি। বিষয় ব্যতিরেকে ভাষা এবং ভাষার ঠাট ব্যবহারে জসীমউদ্দীন ছিলেন নাগরিক। জীবনানন্দও তাই—সাধুগন্ধী, ক্লাসিক, কখনো কখনো এলিয়ে পড়া শিথিল, ধীর লয়ের মধ্যেও আশ্চর্য গতিময়— তবু তার কবিতার ভাষা বাংলার প্রকৃতির মধ্যে ভিজে ভিজে উঠে এসেছে।

‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ প্রকাশের মধ্য দিয়ে বাংলা কাব্যে যে যুগান্তকারী মাইলফলক স্থাপিত হয়েছিল সেখানেও তিনি বলেছেন—

হাতে তুলে দেখিনি কি চাষার লাঙল

বাল্টিতে টানিনি কি জল?

কাস্তে হাতে কতবার যাইনি কি মাঠে?

মেছোদের মতো আমি কত নদী ঘাটে

ঘুরিয়াছি;

পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশটে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে

গিয়েছে জড়ায়ে;

জীবনানন্দ দাশ ‘ঝরাপালক’-পর্ব ভিন্ন কখনো উচ্চকণ্ঠ ছিলেন না—তবু তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসনের কুফল, অতীত বাংলার প্রতি পক্ষপাত, স্বাধীনতার পক্ষের সৈনিকদের জয়গান তার কবিতায় ব্যাপকভাবে এসেছে। মহাত্মা গান্ধী, চিত্তরঞ্জন দাশসহ রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে কবিতা রচনা, হুমায়ূন কবীরসহ রাজনৈতিক সাহিত্যিক নেতাদের নামে গ্রন্থ উৎসর্গ, স্টালিন থেকে নেহেরু, ফ্রয়েড-মার্কস সমকালীন বিশ্ব নিয়ন্তারা সবাই তার কবিতায় এসেছে—স্বাধীনতার বীরদের প্রতি সম্মান, মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে কলমের সক্রিয়তা কবির জাতীয়তাবাদী চেতনার পরিচায়ক। জীবনানন্দের কবিতা আসলে দেশকাল ও নক্ষত্রের কারুকার্যময় জগতের মধ্য দিয়ে হৃদয়ের অভ্যন্তরে জটিল মিথস্ক্রিয়তা শেষে পৃথিবীর প্রান্তরে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায়।

জীবনানন্দ দাশের জাতীয়তা আন্তর্জাতিকতার ভূগোল ও রাজনৈতিক চিন্তার একটি উদাহরণ এখানে দিয়ে রাখি—

এই নগরী যে কোনো দেশ; যে কোনো পরিচয়ে

আজ পৃথিবীর মানব জাতির ক্ষয়ের বলয়ে

অন্তবিহীন ফ্যাক্টরি ক্রেন ট্রাকের ট্রাফিক কোলাহলে

হৃদয়ে যা হারিয়ে গেছে মেশিনকণ্ঠে তাকে

শূন্য অবলেহন থেকে ডাকে

‘তুমি কি গ্রীস পোল্যাণ্ড চেক প্যারিস মিউনিক

টোকিও রোম ন্যুইয়র্ক ক্রেমলিন আটলান্টিক

লন্ডন চীন দিল্লী মিশর করাচী প্যালেস্টাইন?

একটি মৃত্যু, এক ভূমিকা, এক আইন।’

বলছে মেশিন। মেশিন প্রতিম অধিনায়ক বলে :

‘সকল ভূগোল নিতে হবে নতুন করে গড়ে

আমার হাতে গড়া ইতিহাসের ভেতরে,

নতুন সময় সীমাবলয় সবই তো আজ আমি;

ওদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে আমার স্বত্বাধিকারকামী;

আমি সংঘ জাতি রীতি রক্ত হলুদ নীল;

সবুজ শাদা মেরুন অশ্লীল

নিয়মগুলো বাতিল করি; কালো কোর্তা দিয়ে

ওদের ধূসর পাটকিলে বফ্ কোর্তা তাড়িয়ে

আমার অনুচরের বৃন্দ অন্ধকারের বার

আলোক করে কী অবিনাশ দ্বৈপ-পরিবার।

[আনন্দা : শ্রেষ্ঠ কবিতা]

দুটি বিশ্বোযুদ্ধোত্তর ক্লান্ত পৃথিবীতে জীবনানন্দ দাশ পরিভ্রমণ করেছিলেন। কেবল কবির জীবন নয়; সেই ভয়াবহ নিষ্ফল পৃথিবীতে একনায়কদের মেশিন প্রতিম দাপটে কীভাবে যে মানুষ বেঁচে থাকে তারই একটি জবাব দিয়েছেন কবি : ‘আমাদের হাড়ে এক নির্ধূম আনন্দ আছে জেনে/পঙ্কিল সময়স্রোতে চলিতেছি ভেসে।’ অথবা সমকালীন বিশ্বের বিকৃত বিকলাঙ্গ বিকৃত মানুষ তার কবিতায় উঠে এসেছে— ‘হাইড্র্যান্ট খুলে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল/অথবা সে হাইড্র্যান্ট হয়তো গিয়েছিল ফেঁসে।’

জীবনানন্দ দাশের মতো কবির জন্য এ ধরনের আলোচনা আলাদা গুরুত্ব বহন না করলেও সাধারণ পাঠক কবির বাণীকে তার প্রাত্যহিকতার সঙ্গে মিলিয়ে নিতে এবং নিজের জীবনের কোনো একটা চেতনার সঙ্গে সম্পর্কিত করে পাঠ করতে ভালোবাসেন। রবীন্দ্র-নজরুল ছাড়াও তার সমকালীন তিরিশের প্রধান কবিরা নিজেদেরকে কাব্যসাধনার সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিকে যেভাবে সম্পৃক্ত করেছিলেন, জীবনানন্দ দাশ নিজেও তা থেকে দূরে ছিলেন না। এমনকি বাঙলা কবিতার আধুনিকতার প্রবর্তক মধুসূদনও দেশ কালীনতা পুরাণের ছলে মেঘনাদ বধ কাব্যে যত্নের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছিলেন।

জীবনানন্দ দাশের আগে-পরে ইউরোপ আমেরিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় যারা আন্তর্জাতিক বাজারে নিজেদের অবস্থান করে নিয়েছিলেন, তাদের মধ্যে আছেন টিএস এলিয়ট, ডব্লিউ বি ইয়েটস, জন ক্রোয়ি র‌্যানসম, হার্ট ক্রেন, অডেন নাশ, ডব্লিউ এইচ অডেন, স্টেফেন স্পেন্ডার, কার্ল শপির, ডিলান টমাস, রবার্ট লাউয়েল, ওয়াকার গিবসন, নিকোলাস গ্যিয়ন, পাবলো আর্মানদো ফেরনানদেস, সেসার ভায়েহো, কার্লোস ওকেন্দো দে আমাৎ প্রমুখ। এদের মধ্যে টিএস এলিয়টের কিছুটা প্রভাব জীবনানন্দ দাশের ওপর পড়েছিল। এলিয়ট বয়সে জীবনানন্দ দাশের চেয়ে এক দশক বড় ছিলেন। কিন্তু এলিয়ট তার সমকালীন ইংরেজি কবিতাকেও প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন। এমনকি রবীন্দ্রনাথও এলিয়টের কয়েকটি কবিতা অনুবাদ করেছিলেন। এলিয়ট অবক্ষয়ী ক্যাথলিক হলেও বিষ্ণুর মতো নিরীশ্বরবাদীরাও তার প্রতি ঝুঁকে পড়েছিলেন।

তবে বিশ্বকবিতার ক্ষেত্রে আমাদের যে যৎসামান্য পরিচয় ঘটেছে তার প্রধান মাধ্যম তর্জমা। ইংরেজির বাইরেও যে সব ভাষার কবিতার সঙ্গে আমাদের কিছুটা পরিচয় ঘটেছে তার অধিকাংশই ইংরেজি জ্ঞানের স্বল্পতা নিয়ে। যদিও বলা হয়ে থাকে, তর্জমায় কবিতা বাদে সবটুকু থাকে। তর্জমার সঙ্গে কবিতার হ্রী ও শ্রী, লালিত্য ও নান্দনিকতা ফেলে আসতে হয়। আবার এ কথাও সত্য প্রাচীনকাল থেকে বিশ্বের যে সব মহান সাহিত্য আমাদের কাছে পৌঁছেছে তা তো কেবল অনুবাদ ও শ্রুতির মধ্য দিয়ে। কবির নিজস্ব ভাষা কেবল পাঠককে কাছেই টানে না প্রতিবন্ধকতাও সৃষ্টি করে। কবির ভাষা-স্টাইল বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বভাষার এবং সমগোত্রীয় পাঠকদের ওপর কিছুটা প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম। আর অন্যভাষার কবিদের ক্ষেত্রে ভাষা শৈলীর চেয়ে বাণী কিংবা কাহিনীর মাধ্যমে জীবনসত্যের গুরুত্ব পেয়ে থাকে। মহাভারত থেকে শুরু করে আমরা যে সব মহাকাব্যের কথা জানি তার অধিকাংশই আমাদের কাছে তর্জমার মাধ্যমে কাহিনী আকারে এসেছে। এমন কি টি এস এলিয়টের ভাষার ইল্যুশন, কোডমিক্সিং এবং কোড সুইচিং বাঙালি পাঠকের কাছে কোনো অর্থ বহন করে না, যতক্ষণ না তার অর্থ সরল হয়ে আমাদের কাছে পৌঁছায়। একটি উচ্চবৃত্তিক ভাষার ডিগলোসিয়া তৈরির মাধ্যমে এলিয়ট আলাদা হয়ে পড়েন। সুতরাং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোনো উৎকৃষ্ট সাহিত্য পৌঁছে যাওয়ার জন্য তর্জমা অতি আবশ্যক। কিন্তু আমাদের মতো পরাস্ত জাতির ভাষা সাহিত্য তর্জমার দায়িত্ব নেবে কে? রবীন্দ্রনাথ জাহাজে বসে অবসর কাটাতে এবং ইংরেজভাষী বন্ধুদের হাতে নিজের সাহিত্যকর্মের দু-এক টুকরো তুলে দিতে কৌতূহলবশত ‘গীতাঞ্জলি’ নিজেই তর্জমা করেছিলেন। বলা হয়ে থাকে, রবীন্দ্র-তর্জমায় ইয়েটস একটু হাতটাত লাগিয়েছিলেন—ডাহা মিথ্যা। রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি জ্ঞান ছোট করে দেখার কারণ নেই। আসলে উচিত ছিল, ইয়েটস এবং এলিয়টেরই রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদ করা। কিন্তু রাজভাষী হওয়ার সুবাদে তাদের সেই কষ্টকর পথে পা বাড়াতে হয়নি। বরং, বয়সে তিন দশকের ছোট হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথই এলিয়টের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন।

তর্জমার আলো যদি জীবনানন্দ দাশের ওপর পড়তো তাহলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জীবনানন্দের মূল্য হতো সমধিক—সেই সঙ্গে কবির আর্থিক কষ্ট ঘুচে যেতে পারতো। জীবনানন্দ দাশ নিজেও কাব্যজীবনকে বিশ্ব কাব্যসভার অংশ মনে করতেন। তিনি বলেছিলেন, ‘প্রতিভার কাছে কবিকে বিশ্বস্ত থাকতে হবে; হয়তো কোনো একদিন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতার সঙ্গে তার কবিতাবৃত্তও প্রয়োজন হবে সমস্ত চরাচরের সমস্ত জীবের হৃদয় মৃত্যুহীন স্বর্ণগর্ভ ফসলের ক্ষেত বুননের জন্য।’ কিন্তু কীভাবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতাবৃত্তের সঙ্গে তার মিলন ঘটবে? তর্জমা ভিন্ন আর কি কোনো পথ খোলা আছে? আমরা এলিয়টের কবিতার বিভিন্ন শব্দের অর্থ আবিষ্কারের মাধ্যমে তাকে পঠনের আনন্দ খুঁজে পাই। তেমনি জীবনানন্দ দাশের সব কবিতা কি এখনো আমাদের কাছে খোলাসা হয়েছে?

এ আলোচনার শুরু করেছিলাম জীবনানন্দ দাশের ইংরেজি রচনার কসরত দিয়ে। ইংরেজি আরো বেশি আন্তর্জাতিক ভাষা হয়ে উঠেছে। ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ’ নিয়ে এক আলোচনায় তিনি বলেছিলেন—‘ইংরেজ চলে যাচ্ছে। হিন্দি রাষ্ট্রভাষা।…ইংরেজির তুলনায় হিন্দী ঢের অশক্ত ভাষা—গরীব সাহিত্যের।’ জীবনানন্দ দাশ হিন্দির চেয়ে বাংলা ভাষাকে সাহিত্যের জন্য বেশি শক্তিশালী মনে করতেন। কিন্তু ‘ইংরেজিতে জ্ঞান বিজ্ঞানের পরিভাষা বেশি’ হওয়ায় দেশী যে কোনো ভাষা শেখার চেয়ে ইংরেজি শিক্ষার প্রতি তিনি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তবু ‘শিক্ষা সাহিত্যে ইংরেজি’ প্রবন্ধে জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন ‘এ দেশের প্রায় শিক্ষিত লোকেরই ইংরেজি সাহিত্য সম্পর্কে তেমন কোনো রুচি নেই, চেতনা নেই, খাঁটি আলোচনা করবার শক্তি নেই; বাংলা সাহিত্যেও তাদের মনের প্রবেশ প্রায় একই রকম। বাঙালির পক্ষে ইংরেজির চেয়ে বাংলা সাহিত্য বেশি জানা উচিত।’

জীবনানন্দের জাতীয়তা আন্তর্জাতিকতার মাত্রাজ্ঞান কোনটাই যুক্তিকে অতিক্রম করেনি। ‘যুক্তি জিজ্ঞাসা ও বাঙালী’ প্রবন্ধে এর একটি যৌক্তিক পারম্পর্য তিনি নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘আমেরিকা বৃটেন সোভিয়েত রাশিয়া—পৃথিবীর সব রাষ্ট্রই আজ জাতীয়তাবাদী।’ কিন্তু তিনি মনে করতেন কেবল জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ‘গোটা পৃথিবীর হৃদয়মনকে না বদলাতে পারলে কোনো বিচ্ছিন্ন দেশের মন ও কাজের পদ্ধতি বদলানো প্রায় অসাধ্য ব্যাপার।’

 

সংবাদ সারাদিন