|| বার্তা সারাবেলা ||
এবারের আষাঢ় এসেছে তার নিজের মত করে। করোনাকালের প্রকৃতিতে নেই কার্বনের আধিক্য। নেই সেইমাত্রার দূষণ। যা অস্থির করে তুলেছিল প্রকৃতিকে। গেল তিনমাসে প্রকৃতি পেয়েছে স্বস্তি। পেয়েছে নিরপদ্রুব সমর্থন। দেশের নদ-নদী উপচে পড়ছে পানিতে। আকাশজুড়েই নিত্য খেলা চলছে মেঘমালার। কখনো ঘন কালো হয়ে আসছে। কখনো ধরে রাখতে পারছে না নিজেকে। বাধাহীন আকাশ থেকে পড়ছে ঝড়ঝরিয়ে। গাছপালাতে আনন্দের নাচন। মুক্ত সবুজ বলছে দেখ, আমি কত স্বাধীন! আমি কতটা নিজের মত শ্বাস নিতে পারছে। কতটা গুছিয়ে নিতে পারছি নিজেকে।
সবুজের সমারোহে নতুন প্রাণের বার্তা নিয়ে এসেছে আষাঢ়। আকাশ ছেয়েছে মেঘের ঘনঘটায়। মেঘদূতের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে পয়লা আষাঢ়।
সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি এবং শিল্পকলার অঙ্গন আষাঢ়বন্দনায় নিবেদিত, উচ্ছ্বসিত। কবির কবিতায়, শিল্পীর সুরে-গানে, চারুশিল্পীর তুলির আঁচড়ে, চলচ্চিত্রের সেলুলয়েডে, নকশিকাঁথার ফোঁড়ে ফোঁড়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সমৃদ্ধ ভান্ডারে বর্ষার অপরূপা রূপবর্ণনা, স্থিতি ও ব্যাপ্তি মূর্ত চিরকালীন হয়ে আছে।
আষাঢ় নিয়ে রবীন্দ্রনাথ তার কবিতায় লিখেছেন-
“আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে–
আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে।
এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি
পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি
নূতন মেঘের ঘনিমার পানে চেয়ে
আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে।”
বর্ষা কবি-সাহিত্যিকদের মাস। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত এমন কোনো কবি নেই যিনি কি-না বর্ষা নিয়ে এক-দু’লাইন লেখেননি। আষাঢ়-শ্রাবণ, বর্ষা-বৃষ্টি এসব শব্দ কবিদের ভাবের জগতে বুঁদ করে, তাঁদের চোখ চকচক করতে থাকে, হাত নিশপিশ করতে থাকে, আর দেখতে দেখতে দিস্তা দিস্তা কাগজ ভরিয়ে ফেলেন।
তাইতো রবীন্দ্রনাথ তার ‘আষাঢ়’ কবিতায় লিখেছেন-
“নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।
বাদলের ধারা ঝরে ঝরঝর,
আউশের ক্ষেত জলে ভরভর,
কালি-মাখা মেঘে ও পারে আঁধার ঘনায়েছে দেখ্ চাহি রে।
ওগো, আজ তোরা যাস নে ঘরের বাহিরে।”
বাংলায় আষাঢ়-শ্রাবণ দুমাস বর্ষা ঋতু। এ সময় জলীয় বাষ্পসমেত দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুতে শুরু হয়ে ভেতরগত আন্দোলন। যা বৃষ্টিরূপে আছড়ে পড়ে জমিনে। বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় এই বর্ষায়। তাই চারপাশের পরিবেশ রূপ বদলায়। বর্ষার ভারি বর্ষণে শরীর ধুয়ে নেয় প্রকৃতি। পরিচ্ছন্ন হয়। নতুন করে জেগে ওঠে। বেলি, বকুল, জুঁই, দোলনচাঁপা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার সুবাসে ভরে ওঠে চারপাশ। ষড়ঋতুর বাংলাদেশে এ মাসের তাৎপর্য কিছুটা ভিন্ন। আষাঢ় মানেই যেন মেঘবতী জলের মৌসুম। বর্ষার বাদল দিনের প্রথম কদম ফুলের হাসি তো ভুবন ভোলানো! কী গ্রাম, কী নগর সর্বত্রই বর্ষার আগমনী বার্তা জানান দেয় কদম। যেন একই কথার জানান দিতে পেখম মেলে ময়ূর। বৃষ্টির জল গায়ে নিয়ে নৃত্য করে।’
চিরকালই কবিদের বর্ষাবন্দনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে এই বর্ষার মোহিনী রূপ। ব্যক্ত হয়েছে অনেক- অব্যক্ত রয়ে গেছে আরো বেশি। গহন বর্ষার সজল কালো মেঘবৃষ্টি ভেজা ভুঁইচাপা, কামিনী আর দোলনচাঁপার গন্ধ মনে যে অনির্বচনীয় আনন্দ সঞ্চারণ করে- ভাষার সাধ্য কি পৌঁছায় সেখানে! মেঘমেদুর বর্ষার রং রূপ রস গন্ধ মানুষ ভালোবেসেছে অনন্ত কাল। আর যুগে যুগে কবিরা সে ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন তাঁদের কবিতায়। বর্ষা বন্দনায়।
বর্ষা ঘিরে এ সুধা রচনার আনন্দ থেকে ফিরে থাকতে পারেননি আদিযুগ থেকে মধ্যযুগ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক, আধুনিক থেকে সময়ের কোনো কবিই। সব যুগে সব সময়ে বর্ষা তার অপরূপ রূপের ছুরি নিয়ে হানা দিয়েছে প্রেমিক কবির মনে। কবিরাও অপরূপ রূপের দেবী বর্ষার ছুরিতে খুন হতে চেয়েছেন বারে বারে।
কালিদাস ‘মেঘদূত’ কবিতায় পর্বতের ওপারে নির্বাসিত শূন্য ও একাকী জীবনে ‘মেঘ’কে দূত করে পাঠিয়েছেন প্রিয়ার কাছে। চণ্ডীদাস বর্ষাকে হিসাব করেছেন প্রেমোবহ্নিতে ঘৃত হূদয়ের পোড়া ছাইয়ের অনুষঙ্গ করে। বিরহ কাতরতা প্রকাশ করেছেন মেঘের ঘন কালো রূপের সঙ্গে তুলনা করে। তিনি লিখেছেন—‘এঘোর রজনী মেঘের ঘটা কেমনে আইল বাটে/ আঙ্গিনার মাঝে বধুয়া ভিজিছে দেখিয়া পরাণ ফাটে।’
মাইকেল মধুসূদন দত্তের কবিতায় বর্ষা আবার ধরা দিয়েছে প্রকৃতির অরূপ শক্তি হিসেবে। তাঁর কবিতায় বর্ষার প্রকৃতি ও মানব প্রকৃতি মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। তার সাথে দেবতাগণও ঘোষণা করেছে একাত্মতা। ‘বর্ষাকাল’ কবিতায় কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত বর্ষার রূপকে ভাবনার তুলিতে বর্ণনা করেছেন এভাবে—‘গভীর গর্জন করে সদা জলধর উথলিল নদ-নদী ধরণীর উপর/ রমণী রমণ লয়ে সুখে কেলি করে/ দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্তরে।’
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি, প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর কবিতায় বর্ষাকে এড়িয়ে যাননি। বাংলা ভাষার শুদ্ধতম এ কবির কবিতায় বর্ষা এসেছে আরও কাছ ঘেঁষে। ‘এ জল ভালো লাগে’ কবিতায় কবি বলেছেন—‘এই জল ভালো লাগে; বৃষ্টির রূপালি জল কত দিন এসে/ ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল- চোখের উপরে/ তার শান-স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে, আবেগের ভরে/ ঠোঁটে এসে চুমো দিয়ে চলে গেছে কুমারীর মতো ভালোবেসে;/ এই জল ভালো লাগে;-নীলপাতা মৃদু ঘাস রৌদ্রের দেশে/ ফিঙ্গা যেমন তার দিনগুলো ভালোবাসে- বনের ভিতর/ বার বার উড়ে যায়,- তেমনি গোপন প্রেমে এই জল ঝরে/ আমার দেহের পরে আমার চোখের পরে ধানের আবেশে…’
পল্লী কবি জসিমউদ্দীন-এর কবিতায় বর্ষা এসেছে আরেক রকম ব্যঞ্জনা হয়ে। তিনি উদাস হয়ে দেখেছেন বর্ষার রূপে। সে রূপে এমনই ব্যাকুল হয়েছেন যে তিনি কোনো পথ আর খুঁজে পান না, সব পথই আনন্দে ভরপুর—‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছল ছল জলধারে/ বেণু-বনে বায়ু নাড়ে এলোকেশ, মন যেন চায় কারে।’
নির্মলেন্দু গুণ বর্ষার মেঘ আর বৃষ্টি দুইকেই ধারণ করেছেন বোধের ভিতর। চাকুর এপিঠ ওপিঠের মতো ব্যবহার করেছেন জাগ্রত প্রতিবাদে, অন্যায়ের শাই শাই চাবুক রূপে। বর্ষাকে উপমা করেছেন রক্তকণ্ঠের প্রতিনিধি হিসেবে—‘আমি কতো ভালোবাসা দু’পায়ে মাড়িয়ে অবশেষে,/ কল্পনা মেঘোলোক ছেড়ে পৌঁছেছি বাস্তব মেঘে।/ আজ রাত বৃষ্টি হবে মানুষের চিরকাম্য দাবির ভিতরে।’ (কবিতা : বউ)
সৈয়দ শামসুল হক বর্ষার বৃষ্টিকে পবিত্র এক জলফোয়ারা রূপে দেখেছেন। বৃষ্টিতে ধৌত হলে পৃথিবীর আর কোনো জলে ধৌত হবার প্রয়োজন নেই বলেই বর্ষার এ বৃষ্টিতে ভেজা ঘরে প্রাণের স্বদেশকে স্বাগত জানিয়েছেন।—‘তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ,/ তুমি ফিরে এসেছ তোমার বৃষ্টিভেজা খড়ের কুটিরে/ যার ছায়ায় কত দীর্ঘ অপেক্ষায় আছে সন্তান এবং স্বপ্ন;’ (কবিতা :তোমাকে অভিবাদন বাংলাদেশ)
হুমায়ূন আহমেদের বর্ষালোভের কথা কে না জানে। সমুদ্রের কাছে গেলে এই গীতিকবি যেমন হুলুস্থুল মার্কা পাগল হয়ে যেতেন তেমন মাতাল হয়ে যেতেন বর্ষার বৃষ্টি দেখে। আকাশ ডাক দিয়ে বৃষ্টি নামতে দেরি হতো—বাড়ির উঠোনে নামতে দেরি হতো না বিন্দুমাত্র তাঁর। যে প্রিয়াকে ভালোবাসতেন প্রাণাধিক সে প্রিয়তমাকে তাই তিনি অন্য কোনো ঋতুতে নয়, বর্ষা ঋতুতেই আসতে বলেছেন, যদি তাঁকে মনে পড়ে—‘যদি মন কাঁদে/ তুমি চলে এসো, চলে এসো/ এক বরষায়।/ এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে/ জল ভরা দৃষ্টিতে/ এসো কোমল শ্যামল ছায়।/ যদিও তখন আকাশ রবে বৈরী/ কদম গুচ্ছ হাতে নিয়ে আমি তৈরি।/ উতলা আকাশ মেঘে মেঘে হবে কালো/ ছলকে ছলকে নাচিবে বিজলী আরো।/ তুমি চলে এসো, চলে এসো/ এক বরষায়।’ (গীতকবিতা : যদি মন কাঁদে)
ঘনমেঘ যখন দল বেঁধে আকাশে উড়ে বেড়ায় সে মেঘের সঙ্গে কবির ভাবপ্রবণ মনও কল্পনার জগতে উড়তে থাকে। তখন সরল মানুষের মতো কবির মনের সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনাগুলো যেন জলছবি হয়ে ওঠে মেঘের শরীরে।
বর্ষা যেমন আষাঢ় শ্রাবণ শুধু কাঁদে আর কাঁদে। পাঁচটি ঋতুর সমস্ত বেদনা নিয়ে যেমন বর্ষা এসে হাজির হয় প্রকৃতির উঠোনে। তেমনি কবি মহাদেব সাহা বর্ষার বৃষ্টি-কান্নাকে সারা জীবন যেন ধরে রাখলেন তাঁর ভাবের মলাটে। একটা জীবন কবির কাছে পুরোটাই যেন বর্ষার মেঘের মতো—‘এই যে জীবন উজাড় করে বর্ষার মেঘের মতো/ তোমাকে ভিজিয়ে দিচ্ছি/ তুমি কখনোই তার কিছু অনুভব করলে না;/ তুমি বুঝলে না এই সহস্র সহস্র চুম্বনের ব্যাকুলতা নিয়ে/ আমি তোমার জন্য দাঁড়িয়ে আছি,/ তোমাকে ভিজিয়ে দেওয়ার জন্য হাজার বছর ধরে/ আমি মেঘ হয়েছি সমুদ্রে,/ লক্ষ লক্ষ শীতরাত্রি ভেদ করে তোমার জন্য ফুটেছি গোলাপ;/ তুমি বুঝলে না আমি কতকাল এই বর্ষা হয়ে আছি,/ মেঘে মেঘে মল্লার হয়ে আছি তোমার জন্য/ একবিন্দু অশ্রু হয়ে আছি সমস্ত প্রেমিকের চোখে।’ (আমার এতো বর্ষা)
সুফিয়া কামাল, রফিক আজাদ, আহম্মদ রফিক সহ এপার ও ওপার বাংলার কোনো বাঙালি কবিই বর্ষার বন্দনা থেকে বিরত থাকেতে পারেননি।
চিরকালই কবিদের বর্ষাবন্দনায় বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে এই বর্ষার মোহিনী রূপ। ব্যক্ত হয়েছে অনেক—অব্যক্ত রয়ে গেছে আরও বেশি। গহন বর্ষার সজল কালো মেঘ-বৃষ্টি ভেজা ভুঁইচাপা, কামিনী আর দোলনচাঁপার গন্ধ মনে যে অনির্বচনীয় আনন্দের সঞ্চার করে—ভাষার সাধ্য কী পৌঁছায় সেখানে! মেঘমেদুর বর্ষার রঙ রূপ রস গন্ধ মানুষ ভালোবেসেছে অনন্তকাল। আর যুগে যুগে কবিরা সে ভালোবাসার চিহ্ন রেখে গেছেন তাঁদের কবিতায় । বর্ষা বন্দনায়।