টাকার জন্য করোনায় মৃত সন্তানকে গ্রামে নিতে পারলেন না চা শ্রমিক বাবা

শ্রীমঙ্গলের মির্জাপুর চা বাগানের স্থায়ী বাসিন্দা সুজন কালিন্দী। পঁচিশ বছর বয়সী এই যুবক চা বাগানেই কাজ করতেন দিনে মাত্র ১০২ টাকা মজুরিতে। স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে এই টাকায় সংসার টানতে পারছিলেন না তিনি। ঘরে মা নেই, বৃদ্ধ বাবাও জীবন সায়াহ্নে। করোনাকালে স্ত্রীও ছিলেন বাপের বাড়িতে।

|| সারাবেলা প্রতিনিধি, শ্রীমঙ্গল ||

শ্রীমঙ্গলের মির্জাপুর চা বাগানের স্থায়ী বাসিন্দা সুজন কালিন্দী। পঁচিশ বছর বয়সী এই যুবক চা বাগানেই কাজ করতেন দিনে মাত্র ১০২ টাকা মজুরিতে। স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে এই টাকায় সংসার টানতে পারছিলেন না তিনি। ঘরে মা নেই, বৃদ্ধ বাবাও জীবন সায়াহ্নে। করোনাকালে স্ত্রীও ছিলেন বাপের বাড়িতে।

সংসারের একটু সচ্ছলতার আনতে মাস তিনেক আগে চলে আসেন রাজধানীতে। চাকরি নেন সাভারের বিরুলিয়ার আলফা ড্রিংকিং ওয়াটার ফ্যাক্টরিতে। রিকশাভ্যানে করে ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দিতেন পানীয় জল। থাকতেন রাজধানীর মিরপুর– ১০ নম্বর সেকশনের এ ব্লকের ৭ নম্বর রোডের ৫ নম্বর মেসবাড়িতে। গত রোববার ৬ই জুলাই রাত দেড়টার দিকে করোনায় মারা যান সুজন। কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের একটি দল হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী তাকে সৎকার করে। 

করোনার এই অভিঘাতের সময়ে সুজনের শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না। কিছুদিন ধরে অসুস্থতা বোধ করায় কারখানা মালিক সাইফুল ইসলামের সহায়তায় ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ হন। গত শুক্রবার কাজে যোগ দেন। কিন্তু এক দিন যেতে না যেতেই আবারো জ্বর ও সদর্ি। গেলো রোববার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মারা যান সুজন।

সুজনের সহকর্মী সহিদুল ইসলামের মাধ্যমে জানতে পেরে সিলেট থেকে রওনা হন বাবা বকুল কালিন্দি। তার আগেই কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সোমবার রাত আটটার দিকে সৎকার করা হয় সুজনকে। সংবাদ সারাবেলার পক্ষ থেকে কোম্পানির মালিক সাইফুল ইসলামের মুঠোফোনে বারবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি, একপর্যায়ে সেল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

এ ব্যাপারে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আব্দুস সালাম মুঠেফোনে সংবাদ সারাবেলাকে জানান, আলফা ড্রিঙ্কিং ওয়াটারের শ্রমিক সুজন ১০/১২ দিন আগে থেকেই অসুস্থ ছিলো, করোনার উপসর্গ ছিলো তার। শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে আ্যাম্বুলেন্স করে জাতীয় হার্ট ফাউন্ডেশন নেওয়ার পথেই মারা যাযন তিনি। ‘ব্রড ডেড’ হিসেবে একটি সনদ দিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

কারখানা মালিকের বরাত দিয়ে আব্দুস সালাম বলেন, ‘ওর বাবা নাকি লাশ নেবে না এমনাট বলেছেন, সম্ভবত বাগানের ব্যবস্থাপকের মোবাইল ফোনে ওনারা যোগাযোগ করেন।’ আমাদের কাছে সকাল দশটার দিকে আ্যম্বুলেন্স চালক পরিচয় দিয়ে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয় কিনা বলে সাহায্য চায় বিপাকে পড়া আ্যম্বুলেন্স চালক। কিন্তু আমরা তাকে বলি, আ্যাম্বুলেন্সে আসা লাশ তো বেওয়ারিশ হয় না। আমরা তার অবস্থান জানতে চাইলে, সে জানায় পল্লবী থানায় রয়েছে। হসপিটালে নামের তথ্য ভুল দেওয়ার কারনে নাম লিখা হয় মো. সুজন! হাসপাতালে যাওয়ার পথে মালিকপক্ষের আরও একজন ছিলেন বলে জানান তিনি। নামবিভ্রাটের কারনে এ লাশকে কিভাবে দাহ করা হবে? কেউ এগিয়ে আসেনি। মানবিক কারনে আমরা পাশে থাকি। পরে স্থানীয় কাউন্সিলর ও সাংবাদিকের সহযোগীতায় পুনরায় হাসপাতাল থেকে নাম সংশোধন করিয়ে প্রকৃত নামে দ্বি-নকল মৃত্যুসনদ পেয়ে পুলিশ ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরের অনুমতি এবং মালিক সাইফুল ইসলামের অনুরোধে আমরা সোমবার রাত আটটার দিকে সকল প্রকার স্বাস্থ্যবিধি ও হিন্দু ধর্মীয় রীতি মেনে দাহকার্য সম্পন্ন করি।’

আব্দুস সালাম নিশ্চিত করে জানান, অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থেকে একপর্যায়ে লাশের গন্ধ এলাকায় ছড়াতে থাকলে তারা কাউন্সিলরের ও মালিকের অনুরোধে চিতায় লাশ ওঠান। ততক্ষণেও ঢাকায় এসে পৌঁছাননি সুজনের বাবা, দেখতে পারেননি শেষবারের মতো ছেলের মুখটি।

তবে, সুজনের মৃত্যু সংবাদ শুনে কালবিলম্ব না করে বাবা বকুল কালিন্দি ঢাকায় ছেলেকে দেখতে যান বলে জানান মির্জাপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. সাইদুজ্জামান। সাথে এও যোগ করেন, আর্থিক দুরাবস্থার কারনে করোনার এই সময়ে লাশ ঢাকা থেকে আনতে পারেননি তিনি। অন্তত ১০ হাজার টাকা যাতায়াত খরচ যোগানোর মতো সাধ্য তার ছিলো না।

মির্জাপুর চা বাগানের কর্মচারী গৌতম বলেন, ‘ছেলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বকুল ও তার অন্য দুজন আত্মীয় ঢাকায় যান, সেখানে সংকার করা হয় বলে আমরা জেনেছি। বকুল কালিন্দি আজ (মঙ্গলবার) ভোরে ফিরে এসেছেন। নিজের ঘরে কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন এবং চা বাগান কর্তৃপক্ষ কোয়ারেন্টিনকালীন সময় পর্যন্ত তাকে বিনাশ্রমে মজুরী প্রদান করবে।’

পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, সুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর পুলিশের একটি টিম তার ভাড়া মেসে গিয়ে সন্ধান চালায়। তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে বিষয়টি জানানো হয়। এ সম্পর্কে গতকাল পর্যন্ত (সোমবার) জানি যে, ছেলেটি মারা গেছে, তার অভিভাবক আসবেন। তবে, আলফা ড্রিকিংয়ের মালিক সাইফুল ইসলাম (যেখানে সে কাজ করে) প্রথমে বলছেন, ছেলের অভিভাবক আসবে না। আমাদের কাছে ঐ মৃত ছেলের মালিকপক্ষ বেওয়ারিশ সনদ চেয়েছিলো কিন্তু আমরা তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করি যেহেতু তার পিতা ও স্বজনরা রয়েছেন এই মর্মে আমরা জানতাম।  

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন