ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন ১৫ শতাংশ কমাতে বিএবি’র চিঠি

|| অর্থবাজার প্রতিবেদন, ঢাকা ||

করোনা সংক্রমণের এই দুর্যোগে বেতন কমছে ব্যাংকারদের। আগামী দেড় বছরের জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা ১৫ শতাংশ কমাতে রোববার সব ব্যাংককে চিঠি দিয়েছে বেসরকারি ব্যাংক-উদ্যোক্তা মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। শুধু বেতন কমানোই নয় চিঠিতে বিজ্ঞাপন বন্ধসহ খরচ কমাতে বেশ কয়েকটি পরামর্শ দিয়েছে বিএবি।

বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ ও উৎকন্ঠিত ব্যাংক কর্মকর্তারা বলছেন, করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে লকডাউনের মধ্যেও তাদেরকে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়েছে। সংক্রমিতও হয়েছেন অনেকে। তার ওপর বেতন কমানোর এই সিদ্ধান্ত তাদের জন্য মরার ওপর খাড়ার ঘা।

কর্মকর্তাদের ক্ষোভের প্রেক্ষাপটে বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেছেন, এটা নির্দেশনা নয়, কেবল পরামর্শ। তবে ব্যাংকমালিকদের সংগঠন এ ধরনের পরামর্শ দিতে পারেন কিনা তা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। বিষয়টিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ।

বিএবির চিঠির খবর শুনে সোমবার সকাল থেকে ক্ষোভ ছিল কর্মকর্তাদের মধ্যে। বিভিন্ন ব্যাংকে কর্মকর্তাদের এনিয়েই আলোচনা করতে দেখা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যাংকের কর্মকর্তা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “ভাই, বেতন কমলে ছেলে-মেয়ে নিয়ে সংসার চালাব কী করে। করোনাভাইরাস মহামারীতে খরচ তো কমেনি; উল্টো বেড়েছে। আমরা চলবো কী করে?”

বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল মজুমদার বলেন, ‍“আমরা ব্যাংক মালিকরা বসেছিলাম। বাস্তব অবস্থা নিয়ে আলোচনা করে যে সব কর্মকর্তার বেতন ৪০ হাজার টাকার উপরে, তাদের আগামী দেড় বছর ১৫ শতাংশ বেতন কমানোর বিষয়ে সবাই একমত হয়। সে সিদ্ধান্তের আলোকে চিঠি দেওয়া হয়েছে।” নজরুল মজুমদার একইসঙ্গে এক্সিম ব্যাংকেরও চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

নজরুল মজুমদার বলেন, “সিদ্ধান্ত নেবে ব্যাংকগুলো। যদি তারা মনে করে কমাবে, তাহলে কমাবে। আর যদি মনে করে কমাবে না, তাহলে কমাবে না।” বেতন কমলে কর্মকর্তাদের সংসার চালাতে সমস্যা হবে কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমরা তো যাদের বেতন ৪০ হাজারের বেশি, তাদের বেতন কমাতে বলেছি। যারা কম বেতন পান, তাদেরটা তো কমাতে বলিনি। সমস্যা হওয়ার কথা নয়। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, সঙ্কটের সময় তো সবাইকেই ছাড় দিতে হবে।”

এক্সিম ব্যাংকে সিদ্ধান্তটি কার্যকর হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “বোর্ড সভায় সিদ্ধান্ত নিয়ে এটা আমরা করেছি। কর্মকর্তারাও মেনে নিয়েছে।”

এদিকে বিএবির এই পদক্ষেপ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “এ ধরনের চিঠি ব্যাংকগুলোর কাজে হস্তক্ষেপের শামিল। বিএবি কোনো অবস্থাতেই তা দিতে পারে না। বিএবি হচ্ছে ব্যাংকের চেয়ারম্যান-ভাইস চেয়ারম্যানদের সংগঠন। কোনো ব্যাংকের যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা একমাত্র ওই ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের। বিএবি পরিচালনা পর্ষদকে তাদের কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে পারে না।”

ইব্রাহিম খালেদ বলেন, “ব্যাংক কোম্পানি আইনের ক্ষমতাবলে এখনই বাংলাদেশ ব্যাংকের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে হবে। বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখার কোনো কারণ নেই। একটি সংগঠন থেকে বেতন কমানোর উস্কানি দেওয়ার সাহস তারা কোথা থেকে পায়, সরকারকেও সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।”

অভিজ্ঞ এই ব্যাংকার বলেন, “আরেকটি বিষয় মনে রাখতে হবে, একটি ব্যাংকের ৯০ শতাংশ টাকার মালিক কিন্তু আমানতকারীরা। উদ্যোক্তা মালিকদের অংশ মাত্র ১০ শতাংশ। ১০ শতাংশের মালিক যারা, তারা এমন স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত কোনো অবস্থাতেই নিতে পারেন না।”

ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং ইস্টার্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলী রেজা ইফতেখার বলেন, “বিএবি কোনো ব্যাংকের রেগুলেটরি বডি নয়; তারা কোনো কিছু চাপিয়ে দিতে পারে না। বেতন কমানোসহ যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ।

তিনি বলেন, “কোনো ব্যাংক যদি মনে করে, কঠিন এই পরিস্থিতিতে তাদের ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বেতন কমানো দরকার কমাবে; আর যদি মনে করে কমানোর প্রয়োজন নেই, কমাবে না। কমানোর প্রয়োজন হলে কতোটুকু কমাবে, কিভাবে কমাবে সব সিদ্ধান্তই নেবে ব্যাংকের বোর্ড। অন্য কেউ নয়।” বেতন কমানোর খবরে কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ-আতঙ্ক বিরাজ করছে বলে স্বীকার করেন ইফতেখার।

এবিবির সাবেক চেয়ারম্যান মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান বলেন, “সঙ্কটকালে ব্যাংকের খরচ কমাতে হবে ঠিক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সেটা কর্মকর্তাদের বেতন কমিয়ে কেন? অন্য নানা উপায়েও তো খরচ কমানো যায়! সে সব পথ বেছে না নিয়ে স্পর্শকাতর এ সিদ্ধান্তের কথা কেন আসছে, বুঝতে পারছি না।”

এতে হিতে বিপরীত হতে পারে জানিয়ে আনিস এ খান বলেন, “কর্মকর্তাদের বেতন কমলে তাদের মধ্যে হতাশা কাজ করবে। কাজের গতি কমে যাবে। ব্যাংকাররা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়বে। তাদের মনোবল ভেঙে পড়বে। সে ক্ষেত্রে ব্যাংকও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।”

বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ডিসেম্বরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে কার্যরত ৫৯টি ব্যাংকে বর্তমানে জনবল রয়েছে ১ লাখ ৭৮ হাজার ৪৩০ জন। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকে আছে ১ লাখ ৯ হাজার ১২৭ জন। বিদেশি ব্যাংকে তিন হাজার ৮৫৮ জন। আর সরকারি ব্যাংকে ৬৫ হাজার ৪৪৫ জন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন