কল-কারখানা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা

|| সারাবেলা প্রতিবেদন, ঢাকা ||

করোনা সংক্রমণ বাড়তে থাকার মধ্যেই কল-কারখানা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি পর্যায়ের সকল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে সোচ্চার হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে হলে করোনা প্রতিরোধক স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সীমিত পরিসরে হলেও দ্রুত খুলে দিতে হবে কল কারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। শনিবার রাজধানীতে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র এক আলোচনা শেষে এমন দাবি জানানো হয়।

এদিকে এফবিসিসিআই’র এমন দাবির মধ্যেই উৎপাদনে যাচ্ছে চট্টগ্রামের তিনটি রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা ইপিজেডের ১১০টি কারখানা মালিক। তারাও বলেছেন, করোনা সংক্রমণ রোধে দরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনেই সীমিত পরিসরে উৎপাদনে যাবে এসব কারখানা। এতে শ্রমিক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংক্রমণ ঝুঁকি তৈরি হবে না বলেও দাবি তাদের।

কিন্তু মালিকদের এমন আশ্বাসে আশ্বস্ত হতে পারছেন চট্টগ্রামের জেলা সিভিল সার্জন। তিনি বলেছেন, যে কোন ধরনের জনসমাগমই করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি তৈরিতে সহায়ক। তবে সরকারের এই চিকিৎসা কর্মকর্তাও দরকারি স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কারখানা চালুর পক্ষে মত দিয়েছেন সরকারের এই চিকিৎসা কর্মকর্তা। শুধু চট্টগ্রামের তিনটি ইপিজেডই নয়, এর বাইরেও উৎপাদনের যেতে চাইছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড ওনারস এসোসিয়েশন বিজিএমইএ’র সদস্য বেশ কিছু কারাখানা ।

উল্লেখ্য বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল কর্তৃপক্ষ-বেপজার অধীনে চট্টগ্রাম ও কর্ণফুলী দুটি ইপিজেড রয়েছে। এর বাইরে আনোয়ারায় রয়েছে ইয়ংওয়ান গ্রুপের মালিকানাধীন কোরিয়ান আরেকটি ইপিজেড। চট্টগ্রাম ইপিজেডে তৈরি পোশাক, তাঁবু, ইলেক্ট্রনিক্স পণ্য, ফেব্রিক্স, জুতাসহ বিভিন্ন পণ্যের ১৫৮টি কারখানায় কাজ করছেন প্রায় দুই লাখ শ্রমিক। কর্ণফুলী ইপিজেডে ৪১টি কারখানার শ্রমিকসংখ্যা প্রায় ৭৬ হাজার। অন্যদিকে আনোয়ারার কোরিয়ান ইপিজেডে ২২টি কারখানায় শ্রমিক সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার।
এদিকে দেশের অর্থনীতি বাঁচানোর যুক্তি দেখিয়ে চলমান এই মহামারির মধ্যেই সকল কল-কারখানা এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি সব ধরণের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। শনিবিার সংগঠনটি বর্তমান পরিস্থিতিতে করণীয় নিয়ে আলোচনায় বসে। সেখান থেকেই সিদ্ধান্ত হয় যে, যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে হলেও সকল শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে।

এরআগে গত ২০শে এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন, পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য নির্দেশিকা কঠোরভাবে মেনে শ্রমিকদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে পারলে রোজার মাসের মধ্যে সীমিত আকারে কিছু কারখানা চালু করা যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যের রেফারেন্স টেনে চীন, ভিয়েতনাম, ভারত, কম্বোডিয়ার মত প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো এ মুহূর্তে তাদের রপ্তানিমুখী শিল্প খুলে দেওয়ার বিষয়ে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা পর্যালোচনা করে বাংলাদেশেও একই পথ অনুসরণ করতে সরকারের প্রতি অনুরোধ জানান ব্যবসায়ী নেতারা।

এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বলেন, “একটি কঠিন সময় পার করছি আমরা। লাখ লাখ শ্রমিকের জীবিকা ও দেশের অর্থনীতিকে বাঁচানোর জন্য সীমিত আকারে হলেও পর্যায়ক্রমে শিল্প-কারখানা খুলে দিতে হবে।”

প্রাণঘাতি এই করোনাভাইরাস বিশ্বে মহামারীর আকারে ছড়িয়ে পড়ায় গত ২৬শে মার্চ থেকে দেশের বেশিরভাগ অফিস-আদালত এবং যানবাহন চলাচল বন্ধ রেখেছে সরকার। পাশাপাশি সবাইকে যার যার বাড়িতে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সর্বশেষ গত ২৩শে এপ্রিল সরকারি ভাষায় এই ‘ছুটির’ মেয়াদ ৫ই মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। সেই আদেশে বলা হয়, “ঔষধশিল্প, উৎপাদন ও রপ্তানিমুখী শিল্পসহ সকল কলকারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করে চালু রাখতে পারবে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে পরবর্তীতে শিল্প-কারখানা, কৃষি এবং উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলো ও পরিবহন পর্যায়ক্রমে উন্মুক্ত করা হবে।”

এদিকে তৈরি পোশাক খাতের প্রতিযোগী দেশগুলোর উদাহরণ তুলে ধরে কিছু শ্রমিকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে মে মাসের শুরু থেকে সীমিত পরিসরে হলেও কিছু কারখানা চালুর বিষয়ে প্রস্তাবিত একটি কর্মকৌশল সম্প্রতি সরকারের কাছে জমা দিয়েছে বাংলাদেশ গার্মেন্টস বায়িং হাউজ অ্যাসোসিয়েশন।

তবে এর বিরোধিতা করে ১১টি শ্রমিক সংগঠনের জোট গার্মেন্টস শ্রমিক অধিকার আন্দোলন বলছে, বিশ্বজুড়ে চলমান লকডাউনের মধ্যে যেখানে তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশই নেই, সেখানে মালিকদের কারখানা খোলার তোড়জোড় গ্রহণযোগ্য নয়।

করোনাভাইরাস সঙ্কটের মধ্যে রপ্তানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেওয়ার জন্য সরকার ইতোমধ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল গঠন করেছে। যে সব কারখানা সচল আছে সে সব কারখানার শ্রমিক-কর্মচারীদের চলতি এপ্রিল, মে এবং জুন মাসের বেতন-ভাতা ওই তহবিল থেকে দেওয়ার কথা।

প্রণোদনার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফজলে ফাহিম বলেন, “এফবিসিসিআই করোনাভাইরাস মোকাবিলায় অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন সংগঠনের সাথে শুরু থেকেই কাজ করে যাচ্ছে।”

মতিঝিলে ফেডারেশন ভবনে এই আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান বলেন, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে দেশের শিল্প কারখানা ‘বাস্তবভিত্তিক সিদ্ধান্তের আলোকে’ পর্য়ায়ক্রমে খুলে দিতে হবে। আমাদের অর্থনীতির কী পরিমাণ ক্ষতি হবে এবং আমাদের স্বাস্থ্য ঝুঁকি কতটুকু আছে, সেসব বিষয় পর্যালোচনা করে অতি সতর্কতার সাথে কলকারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

তিনি বলেন, “সারা পৃথিবী ঝুঁকির মধ্যে। জার্মানি, ফ্রান্সের মত দেশ করোনাভাইরাসের ঝুঁকির মধ্যে থাকার পরও প্রধান শিল্প খাত ধীরে ধীরে খুলে দিচ্ছে। আমাদেরকেও সেই পদক্ষেপ নিতে হবে। সেক্ষেত্রে এফবিসিসিআইকে একটি কৌশলপত্র তৈরি করে সরকারকে দেওয়ার আহ্বান জানান সালমান।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে ব্যবসায়ীরা যাতে কোনো জরিমানা ছাড়াই ৩০শে এপ্রিল পর্যন্ত পণ্য খালাস করতে পারেন, সে ব্যবস্থা করতে হবে। শিপিং এজেন্টদের অফিস দুপুর ১টা পর্যন্ত খোলা থাকায় কাগজ তৈরিতে দেরি হচ্ছে এবং তাতে জরিমানা গুণতে হচ্ছে ব্যব্যসায়ীদের। শিপিং অফিস দুপুর ৩টা পর্যন্ত খোলা রাখতে হবে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা রোজার মাসে প্রায় ৩৭ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করে থাকে। কিন্তু এবার সে সুযোগ নেই। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিয়ে কীভাবে তাদের ব্যবসা পর্যায়ক্রমে খুলে দেওয়া যায় সে ব্যাপারে একটি কৌশল নির্ধারণ করতে এফবিসিসিআইয়ের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

বিজিএমইএ সভাপতি রুবানা হক বলেন, “পোশাক শিল্পের ৮৬৫টি কারখানা খুলে দেওয়ার দাবি আছে। এ পর্যন্ত ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি অর্ডার বাতিল হয়েছে। আমাদের উপর কারখানা খুলে দওেয়ার চাপ আছে। অনেকের অর্ডার আছে। এলাকাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে, দিনক্ষণ বেঁধে, সীমিত আকারে, স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করে কারখানা খুলে দেওয়ার পদক্ষেপ নিতে সবার সহযোগিতা চান রুবানা।

তিনি বলেন, “প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোতে যদি অর্ডার চলে যায়, তাহলে তা ফেরত আনা কঠিন হবে। তাই সীমিত শ্রমিক নিয়ে সীমিত আকারে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।”

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, শিল্প ও দেশের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাকে লাল, হলুদ ও সবুজ রঙে চিহ্নিত করে বিভাজন করা জরুরি। সেক্ষেত্রে এফবিসিসিআই, বিজিএমই ও অন্যান্য খাতকে সঙ্গে নিয়ে খাতভিত্তিক হেলথ প্রটোকল নির্ধারণ করে কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। সরকারের দিক থেকে এ পর্যন্ত ঘোষিত প্রণোদনা র প্রশংসা করে এর পরিমাণ আরো বাড়ানোর পরামর্শ দেনে তিনি।

অন্যদের মধ্যে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন, আবদুল মাতলুব আহমাদ, এ কে আজাদ, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম, প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান, ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, একাত্তর টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মেজাম্মেল বাবু, ডিবিসি টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক মন্জুরুল ইসলাম ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদ এবং সিলেট, খুলনা, রংপুর, সুনামগঞ্জ ও জামালপুর চেম্বারের নেতারা আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন