রানা প্লাজার পঙ্গু নিলুফার গোটা পরিবারই এখন পঙ্গু

|| লোটন আচার্য্য, সাভার থেকে ||

‘পঙ্গু শুধু আমি হইনি , আমার পায়ের সাথে সাথে আমার পরিবারও পঙ্গু হয়েছে। যেই দিন থেকে রানা প্লাজা ভাঙছে সেই দিন থেকে কষ্টের দিন শুরু হইছে । এখন দু’মুঠো ভাতও  ঠিক মতো খেতেও পারি না । ছেলের পড়াশুনা বন্ধ । পঙ্গু হওয়ায় স্বামীও ছেড়ে চলে গিয়েছে’ সাংঘাতিক কষ্ট আর আক্ষেপ জড়ানো এই কথাগুলো রানা প্লাজা দুর্ঘটনায় আহত গার্মেন্টস শ্রমিক নিলুফা বেগমের । নিলুফা বেগম এখন থাকেন সাভারের রাজাশন আমতলার পালোয়ান পাড়ায় ইসমাইল পালোয়ানের শ্রমিক কলোনিতে।

নিলুফা জীবিকার তাগিদে স্বামী সন্তান নিয়ে সাভারে আসেন সেই ২০০৯ সালে। একটু স্বচ্ছলতা আর একটু ভাল আগামীর স্বপ্ন ছিল তার। চাকরি নেন ফ্যানটম টেক কারখানায় সুইং অপারেটর হিসেবে। ফ্যাক্টরিটি ছিল রানা প্লাজার ৫ তলায়।  যা বেতন পেতেন তাতে বেশ ভালই চলছিল তার ছন্দময় দিন । প্রতিদিনের মতো সেদিনও কাজে যান নিলুফা। দিনটি ২০১৩ সালে ২৩শে এপ্রিল। হঠাৎই সকাল পৌনে দশটা দিকে তিন তলার একটি পিলার থেকে বেরিয়ে আসে চড়চড় শব্দ।

পিলারের খানিকটা পলেস্তারা খুলে পড়ে পাশের সেলাই মেশিনের ওপর । শব্দ আর পলেস্তারা খুলে পড়তে থাকায় সবাই প্রথমদিকে নিলুফার মত অনেকেই ঠাহর করতে পারেনি আসলে কী হচ্ছে। তবুও অনিশ্চয়তা নিয়ে সেদিনের মত কাজশেষে বাড়ি ফেরেন নিলুফা। চাকরি বাঁচাতে পরদিন ২৪শে এপ্রিলে সকালে আসেন কাজে। কারখানার বাইরে অন্যান্য শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে অপেক্ষা করছিলেন নিলুফা । সকাল আটটার দিকে মাইকে ঘোষণা করে সবাইকে কাজে যোগ দিতে বলে মালিক পক্ষের লোকজন । চাকরিচ্যুত করবার ভয় দেখিয়ে আধ ঘন্টার মধ্যেই সব শ্রমিককে কারখানায় ঢুকতে বাধ্য করায় কর্তৃপক্ষ। কাজ শুরু হয় তিন তলা থেকে নয় তলা সব কয়টি ফ্লোরে।

এর মধ্যেই চলে যায় বিদ্যুৎ। ঘুটঘুটে অন্ধকারে ডুবে যায় গোটা ভবন । কারখানা কাজ চালু রাখতে চালানো হয় জেনারেটর। জেনারেটরের বিদ্যুতে আলো ঝলমল করে ওঠার পরপরই কয়েক হাজার শ্রমিক নিয়ে ধসে পড়ে রানা প্লাজা । নিভে যায় বিদ্যুতের আলো। আবারো নেমে আসে অন্ধকার। বাঁচাও বাঁচাও আর্তনাদ আর শ্রমিকদের বেরিয়ে আসার চেষ্টাচিৎকারে ভীতসন্ত্রস্থ হয়ে পড়ে গোটা এলাকা।

কবরসম অন্ধকার আর হত-আহত হাজারো মানুষের ভীড়ে কারখানার মেঝেতে পড়েছিলেন নিলুফা। নিজের শরীরের ওপর মৃত দুইজন। মেঝে আর ছাদের দূরত্ব মাত্র একফুট। এভাবেই কেটে যায় দু:সহনীয় কয়েক ঘন্টা। ভয় আর তৃষ্ণায় প্রাণ ওষ্ঠাগত। এমনি সময়ে নাগাল মেলে আধা লিটারের এক বোতল পানি। বোতলভর্তি পানি মিললে কী হবে, হাত উঁচু করে বোতল তুলতেই বাঁধে ছাদ । তৃষ্ণা আর মেটাতে পারেনি নিলুফা।

রাত ৯ টায় দিকে দেবদূতের মত নিলুফাকে উদ্ধার করে দমকল বাহিনী ও স্থানীয় লোকজন। নিলুফার এরপরের জীবনটা আরেক দফা দু:সহের। গণস্বাস্থ্য ও এনাম হাসপাতালসহ আরো কয়েকটি হাসপাতালে চিকিৎসা চলে প্রায় এক বছর। তাতেও সারেনি ক্ষত। মেনে নিতে হয়েছে পঙ্গুত্ব । দেখতে দেখতে কেটে গেছে সাত সাতটি বছর। এই সাত বছরে পঙ্গুত্ব ছাড়াও নিলুফার জীবনে যোগ হয়েছে আরো বেশ কিছু দু:সহ অভিজ্ঞতা।

স্বামী শহীদুল ও ছেলে রিফাতকে নিয়ে তিন সদস্যের সংসার। পঙ্গুত্বের চিকিৎসা খরচ আর তিনজনের খাবার যোগানো। ছেলেটাও পড়াশুনা করছিল। পঞ্চম শ্রেণীতে। সবমিলিয়ে অনটন যেন প্রকট হয়ে ওঠে সংসারে। নিরুপায় এই সময়ে নিলুফাকে একা ফেলে চলে যায় স্বামী শহিদুল। 

অনটন আর বাবার চলে যাওয়া। এতে বন্ধ হয়ে যায় রিফাতের পড়াশুনা। রিফাত এখন কিশোর। কাজ করেন ডিম বিক্রির দোকানে । সেখানকার আয়ে মায়ের চিকিৎসা আর দু’জনের সংসার খরচ। কোনভাবে মিটে যাচ্ছিল।

কিন্তু এখন এই করোনায় সেই আয়ও বন্ধ। কিভাবে চলবে মায়ে-পুতের জীবন। তাইতো মায়ের নিরুপায় আক্ষপ,’‘পঙ্গু শুরু আমি নই ,আমার পরিবারও হয়েছে!’

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন