কাবুলে আইএসের বোমায় নিহতের সংখ্যা এ পর্যন্ত ৯০ জন

কাবুল বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের ওই এলাকা এড়িয়ে চলতে বলেছিল বুধবার। এই সতর্কবার্তার মধ্যেই যুক্তরাজ্যের আর্মড ফোর্সেস বিভাগের জুনিয়র মন্ত্রী জেমস হিপি বৃহস্পতিবার বিবিসি রেডিও ফোরকে বলেন, কাবুল বিমানবন্দরে মারাত্মক হামলার চেষ্টা হতে পারে বলে ‘খুবই বিশ্বাসযোগ্য‘ খবর আছে তার কাছে।

|| বার্তা সারাবেলা ||

কাবুল বিমানবন্দরের কাছে ইসলামিক স্টেটের বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৯০ এ দাঁড়িয়েছে। এতথ্য জানিয়েছেন আফগানিস্তানের জনস্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। এরইমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট এ হামলার দায় স্বীকার করে নিয়েছে। বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যার দিকে হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে ওই জোড়া বিস্ফোরণে আহতও দেড়শ ছাড়িয়েছে বলে নাম পরিচয় জানাতে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তার বরাত দিয়ে জানিয়েছে বিবিসি।

তালেবানের কাবুল দখলের পর কূটনীতিক, বিদেশি নাগরিক ও অসংখ্য আফগানের দেশ ছাড়ার তোড়জোড়ের মধ্যে এ প্রাণঘাতী হামলা হল। হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ১৩ সেনা নিহত হয়েছে বলেও দেশটির কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে জানিয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার সতর্কতা জারির কয়েক ঘণ্টার মধ্যে  বৃহস্পতিবার এই হামলার ঘটনা ঘটলো। একে অনেকে ‘আত্মঘাতী’বলে দাবি করছেন। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কাবুলে বিমানবন্দরের কাছে ব্যারন হোটেলের গেইটে প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে। সেখানে গোলাগুলিও হয়। তার পরপরই বিমানবন্দরের অ্যাবি গেইটের কাছে ভিড়ের মধ্যে ঘটে দ্বিতীয় বিস্ফোরণ।

বিমানবন্দরের বাইরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা তালেবান যোদ্ধারাও বিস্ফোরণে আহত হয়েছে বলে ওই বাহিনীর একজন মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ধারণা করছিলেন, ইসলামিক স্টেটের খোরাসান গ্রুপ (আইএসআইএস-কে) এর পেছনে থাকতে পারে।

রাতে টেলিগ্রামে আইএস এর মুখপত্র আমাক নিউজ এজেন্সির এক বার্তায় দাবি করা হয়, কাবুল বিমানবন্দরের আত্মঘাতী এই বোমা হামলা তাদেরই কাজ।

১১ দিন আগে তালেবানের হাতে কাবুলের পতন হওয়ার পর এই হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়েই ৮২ হাজারের বেশি মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বিদেশিদের পাশাপাশি আফগানরাও রয়েছেন তাদের মধ্যে।

৩১শে অগাস্টের চূড়ান্ত সময়সীমার মধ্যে লোকজনকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য তোড়জোড় করছে পশ্চিমা দেশগুলো। দেশ ছাড়ার চেষ্টায় হাজার হাজার আফগানও মরিয়া হয়ে বিমানবন্দরের ভেতরে ও বাইরে অপেক্ষা করছেন প্রতিদিন।

এই নাজুক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস সেখানে হামলা চালাতে পারে বলে খবর আসছিল গত কয়েক দিন ধরেই।

কাবুল বিমানবন্দরে সন্ত্রাসী হামলার ‘উচ্চ ঝুঁকিতে’ রয়েছে জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের ওই এলাকা এড়িয়ে চলতে বলেছিল বুধবার। এই সতর্কবার্তার মধ্যেই যুক্তরাজ্যের আর্মড ফোর্সেস বিভাগের জুনিয়র মন্ত্রী জেমস হিপি বৃহস্পতিবার বিবিসি রেডিও ফোরকে বলেন, কাবুল বিমানবন্দরে মারাত্মক হামলার চেষ্টা হতে পারে বলে ‘খুবই বিশ্বাসযোগ্য‘ খবর আছে তার কাছে।

তিনি বলেছিলেন, সম্ভবত কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেরকম কিছু ঘটতে পারে।

এরপর আফগানিস্তানের স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পেন্টাগনের প্রেস সেক্রেটারি জন কিরবি জানান, কাবুল বিমানবন্দরের বাইরে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে এবং এ বিষয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অবহিত করা হয়েছে।

বিলাল সারওয়ারি নামের একজন আফগান সাংবাদিক প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাতে এক টুইটে বলেছেন, বিমানবন্দরের অ্যাবি গেইটের বাইরে কাগজপত্র পরীক্ষার জন্য দিয়ে একটি নালার পাশে অপেক্ষা করছিলেন বহু আফগান। তাদের মধ্যে অনেক নারী ও শিশুও ছিল। সেখানেই ভিড়ের মধ্যে আত্মঘাতী বোমা বিস্ফোরণ ঘটনায় একজন অন্তত আরও একজন সেখানে গুলি চালায়।

আফগানিস্তানের টোলো নিউজের খবরেও ভিড়ের মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটানোর কথা বলা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যের ফরেন অ্যায়ের্স অ্যান্ড ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্ট্যাটেজি কমিটির সদস্য অ্যালিসিয়া কেয়ার্নস বলেছেন, ব্যারন হোটেলের বাইরে বিস্ফোরণের ঘটনায় বহু মানুষ আহত হয়েছেন। যুক্তরাজ্যের নাগরিকদের পাশাপাশি আফগানদের মধ্যে কাদের সরিয়ে নেওয়া হবে, তা বাছাইয়ের কাজ চলছে ওই হোটেলে।

এই কনজারভেটিভ এমপি এক টুইটে জানিয়েছেন, ওই হোটেলের উত্তর গেইটের কাছে বোমা হামলার পাশাপাশি গুলিও চালানো হয়েছে। টোলো নিউজের এক টুইটে দেখা যায়, ঘটনাস্থল থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মানুষজনকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছু ভিডিওতে দেখা যায় রক্ত আর লাশ, আশপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মানুষের জুতা, ব্যাগ আর বিভিন্ন জিনিসপত্র।

সিএনএস জানিয়েছে, বিস্ফোরণের খবর যখন এল, প্রেসিডেন্ট বাইডেন তখন হোয়াইট হাউজের সিচুয়েশন রুমে আফগানিস্তানের ওপর প্রতিদিনের ব্রিফিং শুনছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেনও ছিলেন তার সঙ্গে। কাবুলে বিস্ফোরণের খবর আসার পরপরই জরুরি বেঠক ডেকেছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, পরিস্থিতি হয়ত এমন দাঁড়াতে পারে যে কোনো কিছুই আর কারও নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।

কাবুল বিমানবন্দরে হামলা: যা জানা গেছে

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসলামিক স্টেট খোরাসান পাকিস্তান ও আফগানিস্তান দুই দেশ থেকেই নিজেদের সদস্য সংগ্রহ করে। তাদের নজর থাকে কট্টর জিহাদিদের দিকে, বিশেষ করে সাবেক তালেবান যোদ্ধাদের দিকে, যারা নিজেদের সংগঠনকে আরও বেশি কট্টর ভূমিকায় দেখতে চাইত।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ওই এলাকায় ভয়ঙ্কর কিছু সহিংসতার ঘটনায় আইএসআইএস-কের যোদ্ধাদের দায়ী করা হয়। এর মধ্যে মেয়েদের স্কুল এবং হাসপাতালে হামলার কয়েকটি ঘটনা রয়েছে। এমনকি একটি মাতৃসদনে ঢুকে গুলি করে অন্তঃসত্ত্বা নারী আর নার্সদের হত্যার ঘটনাতেও আইএস এর এই সহযোগী দলকে দায়ী করা হয়।

তালেবান যেখানে নিজেদের আগ্রহ আফগানিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখেছে,  সেখানে আইএসআইএস-কের লক্ষ্য পুরো বিশ্ব। আইএস এর গ্লোবাল নেটওয়ার্কেরই একটি অংশ তারা। পশ্চিমা স্বার্থ যেখানে আছে, সেখানে আঘাত করারই তাদের লক্ষ্য।

কাবুল বিমানবন্দরে হামলাকারী এই আইএসআইএস-কে কারা

ইসলামিক স্টেট খোরাসান প্রদেশ (আইএসকেপি) হল আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসএর একটি আঞ্চলিক সহযোগী সংগঠন, যারা আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে সক্রিয়। বিবিসি লিখেছে, আফগানিস্তানে যতগুলো জিহাদি গ্রুপ সক্রিয়, তাদের মধ্যে এই আইএসআইএস-কে সবচেয়ে বেশি উগ্রপন্থি ও সহিংস।

আইএস যখন ইরাক ও সিরিয়ার বড় একটি অংশ দখল করে নিয়ে খেলাফত কায়েমের ঘোষণা দিয়েছিল, সেই সময় ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে আইএসআইএস-কের গোড়াপত্তন হয়। পরে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক বাহিনীর অভিযানে আইএস এর সেই কথিত খেলাফতের পতন ঘটে।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কাবুল বিমানবন্দরে আত্মঘাতী বোমা হামলায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হওয়ার পর আইএসআইএস-কের নাম নতুন করে আলোচনায় আসছে। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের ধারণা, ওই হামলার পেছনে রয়েছে আইএসআইএস-কে। আইএস এর পক্ষ থেকেও টেলিগ্রামে এক বার্তায় দাবি করা হয়েছে, কাবুল বিমানবন্দরের আত্মঘাতী ওই বোমা হামলা তাদেরই কাজ।

আইএসআইএস-কে’র অবস্থান কোথায়

আইএসআইএস-কের ঘাঁটি মূলত আফগানিস্তানের নানগড়া প্রদেশে। পাকিস্তান সীমান্তের লাগোয়া ওই অঞ্চল মাদক আর মানব পাচারের জন্য কুখ্যাত। সাংগঠনিকভাবে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় যখন ছিল, আইএসআইএস-কের সদস্য সংখ্যা তখন তিন হাজারের মত ছিল বলে ধারণা করা হয়। কিন্তু আফগান, আমেরিকান, এমনকি তালেবানদের সঙ্গে বিভিন্ন লড়াইয়ে তারা অনেক যোদ্ধাকে হারিয়েছে।

তালেবানের সাথে তাদের যোগাযোগ আছে?

একভাবে দেখলে আছে, সেই যোগাযোগটা হয় তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে। সেই তৃতীয় পক্ষ হল হাক্কানী নেটওয়ার্ক। সন্ত্রাসবাদ নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাদের বক্তব্য হল, এই আইএসআইএস-কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে এই হাক্কানী নেটওয়ার্কের। তারা আবার তালেবানেরও ঘনিষ্ঠ।

তালেবান আফগানিস্তানের দখল নেওয়ার পর কাবুলের নিরাপত্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে খলিল হাক্কানীর কাঁধে, যারা মাথার জন্য ৫০ লাখ ডলার দাম ঘোষণা করা আছে। এশিয়া প্যাসিফিক ফাউন্ডেশনের গবেষক ড. সজ্জন গোহেল আফগানিস্তানের এই সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কর্মকাণ্ড পর্যবেক্ষণ করছেন বহু বছর ধরে।

তিনি বলছেন, ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে বেশ বড় কয়েকটি হামলার পেছনে আইএসআইএস-কে, তালেবানের হাক্কানী নেটওয়ার্ক এবং পাকিস্তানভিত্তিক আরও কয়েকটি সন্ত্রাসী সংগঠন সম্মিলিতভাবে জড়িত ছিল।

বিবিসি লিখেছে, গত ১৫ই অগাস্ট কাবুলের দখল নেওয়ার পর পুল-ই-চরকির কারাগার থেকে বিপুল সংখ্যক বন্দিকে ছেড়ে দেয় তালেবান যোদ্ধারা। তারা সেসময় জেল থেকে বেরিয়ে গেছে, তাদের মধ্যে আল কায়েদা আর আইএস এর জঙ্গিরাও আছে বলে খবর এসেছে।

আইএসআইএস-কে এবং তালেবানের মধ্যে আরেকটি বড় পার্থক্যের জায়গাও আছে। কাতারের দোহায় বিলাসবহুল হোটেলে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে শাস্তি আলোচনায় বসায় তালেবানের সমালোচনা করেছিল আইএসআইএস-কে। তাদের ভাষায়,আপসে শান্তির জন্য তালেবান যোদ্ধারা জিহাদের পথ ত্যাগ করেছে।

২০ বছর পর আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফেরা তালেবানের জন্য বড় একটি দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে আইএস। আর এখন সেটা পশ্চিমা দেশগুলোর জন্যও ভাবনার বিষয়।

সংবাদ সারাদিন