স্বাস্থ্য ব্যবস্থা : করোনা : পাশ্চাত্য : কিউবা

মোজাম্মেল হোসেন
গেল ৬ই এপ্রিল আমার ফেইসবুকের ছোট এক বাক্যের পোস্ট দিয়েছিলাম “আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের চেয়ে কিউবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ভালো– ঠিক কি-না চিল্লায়া কন।” অনেকে সমর্থন করেছেন, কেউ মৃদু ব্যঙ্গ করেছেন, কেউ আলতোভাবে বাংলাদেশ প্রসঙ্গও এনেছেন। আমার ঘনিষ্ট বন্ধু মুহাম্মদ হিলালউদ্দিন লিখেছেন, ‘কোন বিচারে? বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা প্রয়োজন।’ তাঁর মন্তব্যের জবাব লিখতে গিয়ে একটু বড় হওয়ায় তা ফেসবুকে আপলোড হলো না। তাই আলাদা পোস্ট দিলাম। বন্ধুরা উপেক্ষা করতে পারেন, কেউ আগ্রহী হলে পড়তে পারেন:
দৃষ্টি আকর্ষণ Muhammad Hilaluddin & Fahmidul Haq: আমি তো ‘ঠিক কি-না’ জানতে চাইসি। চিল্লায়া কইলে বিচার-আচার-ব্যাখ্যা লাগে না। বিশ্বাস করলেই হয়। তবু যখন প্রশ্ন তুলেছেন, বলি। আমি বড় বড় হাসপাতাল, অত্যাধুনিক চিকিৎসা যন্ত্রপাতি, দামী ওষুধ এবং সে-সব দিয়ে উন্নত চিকিৎসার কথা বলি নাই। বলেছি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার কথা, জনস্বাস্থ্য নীতির কথা, যা দিয়ে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যায়। ফাহমিদুল হকের মন্তব্যে সেটা পরিস্কার আছে।
কিউবার হেলথ কেয়ার সিস্টেম নিয়ে পাশ্চাত্যে অনেক আলোচনা ও গবেষণা হয়। তিনটি স্বীকৃত তথ্য:

  • দুই দেশের মাথাপিছু আয়ে আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকলেও শিশুমৃত্যুর হার কিউবার চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বেশি (২০১৯ ইউনেস্কোর হিসাবে যথাক্রমে ৫ ও ৬.৫);
  • মানুষের গড় আয় কাছাকাছি (২০১৮-এর হিসাব যুক্তরাষ্ট্রে ৮০.১ বছর ও কিউবায় ৭৮.৯ বছর);
  • জনসংখ্যার অনুপাতে ডাক্তারের সংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে কিউবায় অনেক বেশি (হু’র ২০১৭-এর হিসাব প্রতি ১০ হাজার মানুষের জন্য যথাক্রমে ২৫.৯৪ ও ৮১.৯০)।

কিউবার গ্রামাঞ্চলে প্রচুর হাসপাতাল। চিকিৎসা শিক্ষার মানও ভালো। লাতিন আমেরিকা ও আফ্রিকার বহু দেশের ডাক্তার কিউবা থেকে পাশ করে। কিউবার রাষ্ট্রীয় কর্মসূচিতে একটি ‘মেডিক্যাল আন্তর্জাতিকতাবাদ’ আছে। প্রেনসা লাতিনার খবর বা কিউবার ‘কমিউনিস্ট প্রপাগান্ডা’ পড়ার দরকার নাই। এসব তথ্যের জন্য পশ্চিমা মিডিয়া ও উইকিপিডিয়া পড়লেই হয়।
এই মার্চের ১১ তারিখে কিউবায় প্রথম করোনাভাইরাস রোগী তিন ইতালীয় পর্যটক শনাক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঝাঁকে ঝাঁকে ডাক্তার ও মেডিক্যাল ছাত্রকে পাঠানো হয় প্রত্যেক বাড়িতে। তারা সর্দিকাশির রোগীদের পরীক্ষা করে ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করে। (ভেবে দেখুন, বাংলাদেশে করোনা-ঢেউয়ে সর্দি-জ্বরের সাধারণ চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেল। আর হাজার হাজার গার্মেন্ট শ্রমিক মহাসড়কে মুখ থুবড়ে পড়লো এক মাসের বেতন পাওয়ার জন্য)।
কিউবায় ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত ৩৬৩ জন করোনার নিশ্চিত রোগী শনাক্ত হয়েছে। সুস্থ হয়েছেন ১৮জন আর মারা গেছেন ৯ জন। কিউবায় আতঙ্ক নেই (ওই মহাদেশে ইকুয়েডরে রাস্তায় লাশ পড়ে থাকার খবর বেরিয়েছে)। এক হাজার যাত্রীর ৫ জন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার খবরে ক্যারিবীয় সাগরে ভাসমান এম এস ব্রেইমার নামের জাহাজকে কয়েকটি দেশ প্রত্যাখ্যান করলেও কিউবা বন্দরে নোঙর করার অনুমতি দেয় এবং যাত্রীদের বিমানে লন্ডনে যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে গঠিত একটি ছোট কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের এ হচ্ছে মানবিক চরিত্রের প্রমাণ।
আমেরিকায় কাড়ি কাড়ি টাকা দিলে উন্নত মানের চিকিৎসা পাওয়া যায় (বাঙালি প্রবাসীরা দেশে এলে দাঁতের স্কেলিং করায় ও চশমা নেয়, কারণ আমেরিকায় ওটা করাতে গেলে বেতনের প্রায় পুরোটা দিতে হয়)। তবে বীমা না থাকা রোগী হাসপাতালে ঢুকতে না পেরে বাইরে প্রাণত্যাগ করে, যদি না প্রাণবায়ু থাকতে অল্পসংখ্যক সরকারি হাসপাতাল পর্যন্ত পৌছুতে পারে। অন্যদিকে আমেরিকার চিরশত্রু ৬০ বছর ধরে বাণিজ্যিক অবরোধের শিকার কিউবায় সরকারি খরচে সবাই জীবন বাঁচানোর মতো চিকিৎসা পায়।
এই পার্থক্যের কথা বলছিলাম স্বাস্থ্য ব্যবস্থা অর্থে। এর বেশি ‘বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা’ আমি মুখ্যুসুখ্যু মানুষ জানি না।
ইংল্যান্ডের কথা আজ বিস্তারিত বললাম না। সেখানে নাগরিকরা নামমাত্র ফি দিয়ে সরকারি খরচে ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসে (NHS, UK) যে স্বাস্থ্যসেবা পায় তাকে আমেরিকান ও অন্য মুক্তবাজারওয়ালারা ‘সোশ্যালিস্ট হেলথ সিস্টেম’ বলে ব্যঙ্গ করে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ১৯৪৮ সালে এনএইচএস গঠন করা হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের গণমুখী স্বাস্থ্যব্যবস্থার মুখোমুখি হয়ে নিজ দেশের লেবার মুভমেন্টের চাপে। ৭০ বছর টিকে আছে। ‘সমাজতান্ত্রিক’ দুর্বলতা ওই ব্যবস্থার কিছু আছে (আমাদের দেশে খয়রাতি কিছু করতে যান, দেখুন কী অবস্থা হয়) কিন্তু চিকিৎসার মান এত খারাপ নয় যে আমাদের রাষ্ট্রের শীর্ষরাসহ হোমরাচোমরারা ওদেশে ডাক্তার দেখাতে ছুটে যান না (এঁদের টাকা লাগে, যাঁরা ব্রিটিশ নাগরিক নন)।#
মোজাম্মেল হোসেন, সাংবাদিক

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন