করোনা ও মার্কিন এক বাংলাদেশি ক্যাবচালক

|| শেখ কবিরুল হাসান ||
দেশে থাকতে ছিলাম কালার ল্যাব ব্যবসায়ী। ভাগ্য আমাকে নিয়ে এলো আমেরিকায়। এখন নিউইয়র্ক শহরের একজন ক্যাব ড্রাইভার। সারা বিশ্বের সকল বর্নের, সকল গোত্রের, সকল ধর্মের যারা নিউইয়র্ক শহরে আসা যাত্রীদের সেবা দেওয়াই আমাদের কাজ।
প্রথম যখন চীনে করোনার সংক্রমণ শুরু হলো, শুনে শুধুই হাসতাম।তখনও ভাবতে পারিনি এই করোনাই আমাদের জীবনকে লন্ডভন্ড করে দেবে।
চীন পেরিয়ে ইরান, ইতালি, স্পেনসহ বিশ্বের সকল দেশ যখন করোনার অভিঘাতে নাকাল তখনও মনে হয়েছিল আমাদের কিছুই হবে না।
এত হাজার হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে যে দিন জন এফ কেনেডি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দিয়ে নিউইয়র্ক শহরে ঢুকলাম, সেদিনও ভাবিনি আমাদের সাজানো পরিবারগুলো এমন তছনছ হবে। লাশের মিছিলে আমাদের সহকর্মীরা যুক্ত হবে।
যাত্রী তুলি আর গুঞ্জন শুনি করোনা। সরকারও নড়ে চড়ে বসলো। আমাদের ব্যবসাতেও তার প্রভাব পড়তে শুরু করলো।
চোখের সামনে সব ব্যবসায়ী পথে বসতে চলেছি, এ কেমন এক হিসাব।একদিকে যাত্রী কমে, অন্যদিকে জ্যামিতিক হারে বাড়ছে করোনা সংক্রমণ।
আমরা ক্যাবিরা দিশেহারা হতে লাগলাম। ১৫ থেকে ১৬ ঘন্টা টানা কাজ করেও মহাজনের টাকা উঠাতে পারতাম না। সবাই সবার সাথে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়ে সকলের খোঁজ খবর নিতে শুরু করলাম।
আমাদের একটা মিল থাকে, যে দিন ব্যবসা খারাপ হয় সে দিন সবারই ব্যবসা খারাপ হতে থাকে। যে দিন ভাল হয় সে দিন সবারই ব্যবসা ভাল হয়।
দিনে দিনে শহরে গাড়ী কমতে শুরু করলো। আমাদের মধ্যে চার শ্রেনীর ড্রাইভার রয়েছে।
০১. গাড়ী + মেডেলিয়ন ওনার মাসিক কিস্তি।
০২. গাড়ীর ওনার সাপ্তাহিক কিস্তি।
০৩. সাপ্তাহিক লিজ চালক।
০৪. ডেলি বেসিস চালক।
প্রথমে ডেইলি বেসিস চালক কাজ বন্ধ করতে লাগলো। এর পর সাপ্তাহিক লিজ ওনাররা কাজ বন্ধ করে দিলো। এরপর মেডেলিয়ন ওনাররা কাজ বন্ধ করতে লাগলো। সবশেষে মাঠে রইল শুধু গাড়ীর ওনাররা। এরা দিশে হারা কারন কাজ হোক না হোক সাপ্তাহিক মেডেলিয়ন লিজ দিতেই হবে ৮৫০ ডলার, যদি পরিশোধিত গাড়ী হয়। অন্যথায় গাড়ী প্রতি ১১০০ ডলার।
আমিও একজন গাড়ীর ওনার, সে হিসাবে মাঠে আছি। সে কি যন্ত্রনা। ১৫ থেকে ১৬ ঘন্টা কাজ করেও ১০০ ডলার আয় করতে পারি না।
ভিতরে ভিতরে কান্না পেতে লাগলো। কারন প্রবাস জীবনটা প্রচন্ড সংগ্রামের, কাজ করলে পয়সা আসে, আর কাজ না করলে পয়সা নেই।
ঘাড় ব্যথা বাড়তে লাগলো মানষিক চাপে। চাপটা কেমন একটু বলি। ঘর ভাড়া, পার্কিং ভাড়া, গাড়ীর ইনস্যুরেন্স পেমেন্ট, মোবাইল লাইন ভাড়া, ইন্টারনেট ভাড়া, টিভি লাইন ভাড়া, নিজের পথখরচ, নিজের সংসারের বাজারসহ সকল যোগান, এরপর বাংলাদেশের নিজ বাড়ির খরচসহ একটা মোটা দাগের যোগান আমাদের বইতে হয়। সব মিলিয়ে মাসে ৫ হাজার ডলারের ধাক্কা।
এবার বলেন, প্রেসারটা কেমন? কত কাটছাট করবো? সব কাটছাট করতে পারলেও দেশের যোগান ঠিক রাখতে হবে।
যখন যাত্রী শুণ্যের কোটায় তখনও আমি রাস্তায়, যখন চরম বিপদের মধ্য দিয়ে সময় পার করছে সবাই, তখনও আমি রাস্তায়।
সহকর্মী যাকেই ফোন করি সে বলে বাসায়। আমার প্রেসার বাড়তে লাগলো। এই প্রেসার থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে লাগলাম। কোনো কুল-কিনারা করতে না পেরে সবশেষ সিদ্ধান্ত নিলাম নিজ গাড়ী সারেন্ডার করবো।
দিনটি মনে হয় ১৫ই মার্চ , রোববার দুপুর ১ টায় নামলাম কাজে। ঘুরতে ঘুরতে জীবন শেষ। শুধুই নিরাস, যাত্রী মেলাতে পারি না।
হঠাৎ সন্ধ্যা ৬টার দিকে ইউনিয়ন স্কয়ার পার্কের মধ্য থেকে মধ্য বয়সী এক নারী হাঁত উঁচু করলো, ভাবলাম এখন থেকে শুরু হবে আমার ব্যবসা। যাত্রী উঠে বসলো পিছন সিটে, জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাবেন? বলে হসপিটাল …… কথা বলতে পারছে না। প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট, যাত্রীর চোখ লাল, মনে হচ্ছে চোখ বের হয়ে যাবে।
আমি প্রচন্ড ধাক্কা খেলাম, ভিতরে ভিতরে ভয়, আর বুঝি বাঁচতে পারবো না। আমি তো মরবই সঙ্গে আমার পরিবারটাও তছনছ হবে।
আবার মনে মনে ভাবছি, আমি কি পাগল হলাম? পেছন থেকে হর্ন দিচ্ছে আরেক চালক, আমি কেনো ধীরে চালাচ্ছি। যাই হোক কোনো এক সময় পৌঁছে গেলাম হাসপাতালের গেটে।
যাত্রী নামতে পারে না তার শ্বাস কষ্টের কারনে, কথা বলতে পারছে না।শুধু বুঁক চেপে ধরে। ভাড়া বেশি না মাত্র ৭ ডলার।যাত্রী তার ব্যাগ থেকে মুঠি মুঠি কয়েন বের করতে লাগলো আর ফ্লোরে ফেলতে লাগলো। আমি বললাম তোর ভাড়া দিতে হবে না। সে জীবন বাঁচাতে দৌড় দিলো, আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, সে পড়ে গেলো, বাঁচার কত আকুতি।
হাসপাতালের সিকিউরিটি আমার দিকে এগিয়ে এসে প্রথম প্রশ্ন, তোর কয়টা বাচ্চা?
আমি জবাবে বললাম, তিন মেয়ে।সিকিউরিটি বললো, তুই যে রোগি এনেছিস এটা করোনায় আক্রান্ত । যা বাসায় যা, বাচ্চাদের সময় দে।
আমি হতবাক কি করলাম? হাজারও প্রশ্ন মাথা জুড়ে। আমি ড্রাইভ করতে পারছিলাম না। আমার গাড়ীর ব্রেক ধরে না, আমার গাড়ীর স্পিড নেই।মাঝপথে মেয়ের মাকে ফোন করলাম, বললাম আমি বাসায় আসছি, তোমরা আমায় ছোবে না।
আমি বাসায় এসে গরম পানিতে গোসল করলাম, টানা ৭ থেকে ৮ দিন নিজেকে আলাদা রাখলাম। প্রতিদিন লেবু গরম পানি খেতে লাগলাম, দিনে ৪ থেকে ৫ বার রং চা।
এখন আমি সুস্থ শারিরীকভাবে তবে মানষিক ভাবে অসুস্থ ।
আজ বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের নিয়ে, রিক্সা চালকদের নিয়ে কত সমালোচনা। ওরা কি সাধে পায়ে হেঁটে রাস্তায় নেমেছে? না , ওদের প্রেসারে ওরা রাস্তায় নেমেছে।
আবারও অনুরোধ আপনারা নিজেকে গুটিয়ে বাসায় থাকুন। নিজে বাঁচুন, পরিবারকে বাঁচাতে সহয়াতা করুন।
শেখ কবিরুল হাসান, নিউইয়র্ক থেকে

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন