তালিকা নেই জয়পুরহাটের একাত্তরের শহীদদের

স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও কোন ধরণের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি তার। শুধু ডা. আবুল কাশেমই নন, এমনই অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি না পাওয়ায় ক্ষুদ্ধ জয়পুরহাটের মুক্তিযোদ্ধাসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। শহীদদের সুনির্দিষ্ট তালিকাও নেই বলে জানান স্থানীয় প্রশাসন।

স্বাধীনতার ৫০ বছরেও মেলেনি স্বীকৃতি

|| মাহফুজ রহমান, জয়পুরহাট থেকে ||

শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাননি জয়পুরহাটের অনেকেই। জেলায় সর্বস্বীকৃত শহরের জিরো পয়েন্টে অবস্থিত শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান। সেখানে সরকারি-বেসরকারি, জাতীয়, স্থানীয় বিভিন্ন কর্মসূচী পালিত হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে কোথাও নেই তাঁর নাম, ছবি বা পরিচয়। শহীদ ডা. আবুল কাশেম মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, বুদ্ধিজীবি হওয়ায় তাকে হত্যা করে পাকসেনারা।

অথচ স্বাধীনতার প্রায় ৫০ বছরেও কোন ধরণের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি তার। শুধু ডা. আবুল কাশেমই নন, এমনই অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি না পাওয়ায় ক্ষুদ্ধ জয়পুরহাটের মুক্তিযোদ্ধাসহ নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। শহীদদের সুনির্দিষ্ট তালিকাও নেই বলে জানান স্থানীয় প্রশাসন।

১৯৭১ সালে ২৬শে জুলাই মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক ও বুদ্ধিজীবি শহীদ ডা. আবুল কাশেমকে হাত-পা বেঁধে নিয়ে যায় স্বাধীনতা বিরোধী রাজাকাররা। শহরের দেবীপুরের নিজ বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে রেলস্টেশনের কাছে একটি গাছের সঙ্গে বেঁধে ভোর রাত পর্যন্ত নির্যাতন করে। পরে মাথায় কাপড় বেঁধে সদরের কুঠিবাড়ি ব্রীজ এলাকায় নিয়ে চোখ, হাতের নখ, দাঁত তুলে নির্যাতনের পর গুলি করে হত্যা করা হয় তাকে।

একইভাবে সদর উপজেলার দোগাছীর ইয়াকুব আলী মন্ডলকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করায় জীপের পেছনে দড়ি দিয়ে বেঁধে ছেঁচড়ে প্রায় ১৭ কি.মি ঘোরানোর পর হত্যা করে পাক সেনারা। পরে তাকে অন্য আরো বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে কবর দেয়া হয় ভারত সীমান্তের চকবরকতের পাগলা দেওয়ান এলাকায়।

শহরের আরেক মুক্তিযোদ্ধা খনজনপুর মিশনের সাইকেল মেকার অমর সরকার বুড়ো। তিনি নিজে লোহার কামান তৈরি করে যুদ্ধে অংশ নেন। স্বজনরা জানান, সেই কামানটি রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু তিনি বেঁচে থাকতে, এমনকি মৃত্যুর পরও মেলেনি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। বীর এই মুক্তিযোদ্ধার পরিবার এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

শহীদ ডা. আবুল কাশেমসহ এমন অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধার কবর রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ ও সংস্কার না করায় জরাজীর্ণ পড়ে আছে।

শহরের দক্ষিণ দেওয়ান পাড়ার মৃত আনজীর হোসেন চাঁদ মুক্তিযুদ্ধের সময় তার গ্রামের বাড়ি বগুড়া এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে সক্রিয়ভাবে যুদ্ধে অংশ নেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরা জানান, আওয়ামী লীগের দু:সময়ে ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ জয়পুরহাট জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন চাঁদ। তিনিও পাননি কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। তার এতিম সন্তানদের অবস্থাও মানবেতর। শহীদ ডা. আবুল কাশেমের পরিবারের পক্ষে কাজী আসাদুজ্জামান জয় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতির জন্য মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করলেও এখনও মেলেনি তাঁর স্বীকৃতি। শহীদ ডা. আবুল কাশেমের মেয়ে লাইলী বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমার বাবা যুদ্ধের সময় আওয়ামী লীগের সংগঠক ছিলেন। আওয়ামী লীগ করায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করায় পাকবাহিনীরা আমার বাবাকে মেরে ফেলে। সরকারের কাছে আমার বাবার স্বীকৃতি চাই।

শহীদ ইয়াকুব আলী মন্ডলের নাতী আরিফুর রহমান রকেট বলেন, ১৯৭১ সালে পাকসেনারা আমার দাদাকে নির্মম ভাবে হত্যা করেছে। কিন্তু এখনও শহীদের স্বীকৃতি পায়নি। যারা শহীদ হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক এবং মুক্তিযুদ্ধ করা লোক এদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃত বা তালিকা নেই। তাঁদের সকলের তালিকা হওয়া দরকার।

অমর সরকার বুড়োর ছেলে পুলন সরকার বলেন, আমার বাবা যুদ্ধের সময় লোহা দিয়ে কামান বানিয়ে যুদ্ধ করেছিল। সেই কামান জাতীয় যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। কিন্তু এখনো মুক্তিযুদ্ধের স্বীকৃতি পাননি।

মৃত আনজীর হোসেন চাঁদের ছেলে সাব্বির হোসেন বলেন, বাবার মৃত্যুর আগে শুনেছি, আমার দাদার বাড়ি বগুড়া জেলায়। সেখানে থেকে মুক্তিযুদ্ধ করেছিল বাবা। সবাই বাবাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই জানে। কিন্তু আজও তাঁর স্বীকৃতি হয়নি। আমার মা-বাবা মৃত্যুর পর খুব কষ্টে টিনের আছরার ঘরে জীবনযাপন করছি।

সাংস্কৃতিক কর্মী টপি মো. এনামুল হক বলেন, ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি, শহীদ ডা. আবুল কাশেম ময়দান। আমরা এখানে চেতনার চাষ করি। সরকারি-বেসরকারি, স্থানীয় বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের নানা কর্মসূচী এখানে হয়। শহীদ ডা. আবুল কাশেম একজন বুদ্ধিজীবি। তাঁর স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এই ময়দানে কিছুই নেই। তাঁর জীবনী স্থাপন সহ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া দরকার।

স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা জাকারিয়া হোসেন মন্টু, বীর মুক্তিযোদ্ধা মাহাফুজাল হক বাসুনিয়াসহ অনেকেই আক্ষেপের সাথেই বলেন, শহীদ ডা. আবুল কাশেম, ইয়াকুব আলী মন্ডলকে পাকবাহিনীরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। কিন্তু তাঁদের স্বীকৃতি মেলেনি। এছাড়াও অনেকেই শহীদ হয়েছে, যুদ্ধ করেছে তারা স্বীকৃতি পাননি, তাদের স্বীকৃতি দেওয়া হোক। 

জয়পুরহাট সদর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী বলেন, অনেক শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বীকৃতি পাননি। শহীদ ডা. আবুল কাশেম, শহীদ ইয়াকুব আলীসহ অনেকের স্বীকৃতি পাওয়ার উচিত ছিলো।

জয়পুরহাট জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ আলী বলেন, যারা শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, আমার অন্তরে অন্তস্থল থেকে দাবি করবো এই মানুষগুলোর শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মূলায়ন করা হোক।

জয়পুরহাট সদর উপজেলার নির্বাহী অফিসার মিল্টন চন্দ্র রায় জানান, শহীদের তালিকার ব্যাপারে সরকারিভাবে কোন নির্দেশনা পেলে অবশ্যই তা বাস্তবায়ন করা হবে এবং শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রাষ্ট্রের যেকোন নির্দেশনা পেলেই স্থানীয়ভাবে দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।

সংবাদ সারাদিন