মরছে মানুষ, জীবন ফিরে পাচ্ছে পৃথিবী

|| অনলাইন ডেস্ক ||
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বিস্তারে পুরো মানব সভ্যতা থমকেই যায়নি, প্রায় বিপর্যস্ত বলা যায়। বিশ্বের বেশীর ভাগ দেশই আজ লকডাউনে। বন্ধ হয়ে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, যান চলাচল, এমন কি কলকারখানাও। স্থবির হয়ে পড়েছে পুরো জনজীবন। মহা আরেক অর্থমন্দায় পড়তে যাচ্ছে বিশ্ব।
উন্নত দেশগুলো সাময়িক ভাবে এসব ক্ষতির সামাল দিতে পারলেও, যদি এভাবেই চলতে থাকে তবে তাদেরও হিমশিম খেতে হবে। সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছে আমাদের দেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো। এধরণের দেশের সাময়িক বিপর্যয় ঠেকানোর মতো অবস্থাইতো নেই। দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তো বাদই দিলাম।
জনজীবন যখন এরকম চরম বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ঠিক তখনই পৃথিবী নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছে নতুন রঙে। মনে হয় যেন মানুষের ওপর রাগ মেটাতেই স্বয়ং পৃথিবী দাওয়াত দিয়ে এনেছে করোনা ভাইরাসকে।
লক-ডাউন আর হোম কোয়ারেন্টাইনের প্রভাবে কমে গিয়েছে মানুষের আধিপত্য আর ঔদ্ধত্য। মানুষ বেশিরভাগ সময় ঘরে থাকার কারণে গণপরিবহণ ও ব্যক্তিগত যানবাহন উভয়েরই ব্যবহার কমেছে। অনেক জায়গায় অফিস, কারখানাও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে কার্বন ও নাইট্রোজেন গ্যাসের নিঃসরণও কমেছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়।
পরিবেশ দূষণের জন্য দায়ী প্রধান দেশগুলো হল চীন, আমেরিকা, ইংল্যান্ড ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। আর করোনার এপিসেন্টার এই দেশগুলোর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। চীনের উহান থেকে করোনার শুরু হলেও সেই উহান অনেকটাই বিপর্যয় কাটিয়ে উঠেছে। এখন সবেচেয়ে বড় বিপর্যয়ের মধ্যে আছে ইতালি ও আমেরিকা। এখানে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা প্রতিদিনই রেকর্ড ছাড়াচ্ছে।
মানবসভ্যতার এমনি ঘোর বিপদের মধ্যে করোনা প্রকৃতিকে কিভাবে নিজের মত সাজতে সহায়তা করছে, দেখা যাক তারই কিছু নমুনা।
বেড়েছে বাতাসের গুণগত মান
চীন থেকে এই উৎপন্ন এই ভাইরাসের কারণে বায়ু দূষণের মাত্রাও সবচেয়ে বেশি কমেছে এই দেশটিতেই। বিশ্ব অর্থনীতিতে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হলেও বর্তমানে এর অর্থনৈতিক অবস্থা ৯০ দশকের চীনকে স্মরণ করিয়ে দেবে। একই সঙ্গে বর্তমানে চীনের বাতাসের গুণগত মান গত দুই দশকের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে। এই বিশুদ্ধ বায়ুর কারণেও সুস্থ হচ্ছে অনেক মানুষ।
স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্শাল ব্রুকের গবেষণা বলছে, চীনের বিশুদ্ধ বাতাসের কারণে ৪০০০ শিশু যাদের বয়স ৫ বছরের নিচে ও প্রায় ৭৩০০০ প্রাপ্তবয়স্ক যাদের বয়স ৭০ এর উপরে, তারা প্রাণে বেঁচে গিয়েছে।
উপরের সংখ্যাগুলো আরেকবার পড়ুন আর এবার ভাবুন প্রকৃতির ক্ষমতা সম্পর্কে। করোনা এতো সংখ্যক মানুষ মারতে পারেনি, যত সংখ্যক প্রকৃতি তার বায়ু দিয়ে বাঁচিয়েছে।
কমেছে ক্ষতিকর গ্যাসের নিঃসরণ
অগণিত মানুষ হোম-কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে থাকায় কমেছে গাড়ির ব্যবহার। গাড়ি থেকে প্রতিনিয়ত নিঃসৃত হয় কার্বন মনোঅক্সাইড, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। কিন্তু মানুষের গাড়ি ব্যবহার কমানোয় ব্যাপকভাবে কমেছে মনোঅক্সাইডের নিঃসরণও, যা গত বছরের তুলনায় ৫০ শতাংশ কম। এর সঙ্গে ট্রাফিক জ্যাম কমেছে ৩৫ শতাংশ।
শুধু মনোঅক্সাইডের নয়, এর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে কার্বন ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ। তেলের দাম বাড়া অবশ্য এতে বেশ ভূমিকা রেখেছে। চীনে কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ কমেছে ২৫ শতাংশ আর নিউইয়র্কে ৫ থেকে ১০ শতাংশ। নিউইয়র্ক পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মনোঅক্সাইড গ্যাস সমৃদ্ধ শহর।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক রোশিনের মতে, সে নিউয়র্কের আকাশ কখনো এতোটা পরিষ্কার দেখেনি যতটা সে এই করোনা মহামারীর সময়ে দেখছে।
চীনে ইতিমধ্যে ২৫ শতাংশ অনবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার কমেছে। এর ফলে কার্বন নিঃসরণও কমেছে। নর্দান হেমিস্ফেয়ারে (চীন পৃথিবীর যে অঞ্চলে অবস্থিত) সবশেষ এতো কম পরিমাণ কার্বন পাওয়া গিয়েছিল ২০০৯ সালে।
বেড়েছে জনসচেতনতা
নিঃসন্দেহে অন্য যেকোন সময়ের চেয়ে মানুষ আজ বেশি সচেতন। অর্থ প্রতিপত্তির কথা না ভেবে তারা আজ স্বাস্থ্যের প্রতি বেশি মনযোগী। প্রকৃতির কদর তারা হয়তো বুঝতে শিখেছে। এই মহামারীর কারণে হলেও হয়তো মানুষের মাঝে কিছুটা সচেতনতার সঞ্চার ঘটেছে।
২০১৫ সালে টেড-এক্সে বক্তৃতা করতে গিয়ে মাইক্রোসফট প্রতিষ্ঠাতা বিল গেটস বলেছিলেন, “আগামী কয়েক দশকের মধ্যে যদি পৃথিবীতে কয়েক মিলিয়ন মানুষ মারা যায় তবে তার কারণ হবে একটি মহামারী রোগ। নিউক্লিয়ার অস্ত্র তৈরী ও গবেষণায় আমাদের বিনিয়োগের কোন ঘাটতি নেই। কিন্তু বায়োলজিক্যাল রিসার্চ নিয়ে আমাদের কোন মাথাব্যথাই নেই। তাই হুট করে কোন প্রানঘাতী অনুজীব যদি আমাদের আক্রমণ করে তবে তাকে সামাল দেওয়ার জন্য আমরা প্রস্তুত নই।“
একেই হয়তো বলে বিলিওনিয়ার মাইন্ড। ভবিষ্যতকে এরা একেবারে নিখুঁতভাবে অনুমান করতে পারে। আর এখন এই মহামারী থেকে আমাদের কেবল সচেতনতাই বাঁচাতে পারে।
তবে পরিবেশের কিছু ক্ষতিও হচ্ছে এই ভাইরাসের কারণে। আর সেটা হচ্ছে বর্জ্য পদার্থের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার মাধ্যমে।
অতিরিক্ত মেডিক্যাল ওয়েস্টেজ
করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগী চীনেই এখন অবধি সবচে বেশী। দেশটির মোট ২২টি শহরে রোগী সংখ্যা, সর্বোচ্চ রোগী ধারণক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গিয়েছে। আর ২৮টি শহরে রোগী সংখ্যা ধারণক্ষমতার একদম কাছাকাছি। এর মধ্যে আবার অনেক অস্থায়ী হাসপাতালও আছে। উহান শহরে মোট ১৪টি অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে। চীনে এখন অবধি মোট রোগী ৮০,০০০ এর বেশী আর মৃতের সংখ্যা ৩০০০ এর বেশী। এতসব রোগীর কারণে প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ মেডিক্যাল ওয়েস্টেজ তৈরি হচ্ছে। চীনে প্রতিদিন প্রায় ৬০২২ টন মেডিক্যাল ওয়েস্টেজ তৈরি হচ্ছে।
এতো গেল শুধু চীনের কথা। এই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র, ইতালী, স্পেন, জার্মানিসহ উন্নত বিশ্বের যেসব দেশ করোনা আক্রান্ত সেসব দেশে নিয়ত বাড়ছে মেডিকেল বর্জ্য। যা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে বেশী। তাছাড়া এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে সারা বিশ্বে। তাহলে ভাবুন পুরো পৃথিবীতে কি পরিমাণ বর্জ্য তৈরি হচ্ছে শুধু এক ভাইরাসের কারণে।
তথ্যসূত্রঃ bbc.com, REUTERS, POLTICO, amp.dw.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন