রাষ্ট্রিয় ও সামাজিক জীবনের অনাচার রুখতে রাজু স্মরণ

সন্ত্রাসী গুলির একটি রাজুর মাথা ভেদ করে চলে যায়। পরে ঢাকা মেডিকেললে নিয়েও বাঁচানো যায়নি রাজুকে। রাজু চলে যান সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের স্বপ্ন অন্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে।

শহীদ রাজু দিবস ১৩ই মার্চ

|| অনন্ত সরকার ||

১৩ই মার্চ ১৯৯২। সকালটা ছিলো আর যে কোন সকালের মতোই। কিন্তু আজকেই যে সেসময়ের ক্ষমতাসীন সরকারি দল বিএনপি আর ক্ষমতার বাইরে থাকা দল আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রদল ও ছাত্রলীগের মধ্যকার সন্ত্রাস-সংঘর্ষের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে গুলিতে প্রাণ হারান মঈন হোসেন রাজু। সেই থেকে এই দিনটি অন্য যে কোন দিনের থেকে একটু আলাদা।

দেশে কেবল স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়েছে। সেলিম, দেলোয়ার, দীপালি, কাঞ্চন, রওফুন বসুনিয়া আর জেহাদের রক্তের পথ মাড়িয়ে আর তিন দলীয় জোটের রূপরেখাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে দেশ যাত্রা করেছে কথিত শাসকের গনতন্ত্রের পথে। রাষ্ট্রক্ষমতায় তখন বিএনপি। 

কিন্তু সন্ত্রাস-সংঘাত দুপুরে শেষ না হয়ে, বিকেলে আবারও সশস্ত্র বিবাদে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ নেতাকর্মীরা। এক পর্যায়ে দু’পক্ষই গুলি চালাতে শুরু করে। মুহুর্তেই গুলি চালানোর খবর ছড়িয়ে পড়ে মঈন হোসেন রাজুসহ ক্যাম্পাসের অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মাঝে। তাৎক্ষনিক রাজুর নেতৃত্বে ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীদের একটি অংশ  “গণতান্ত্রিক ছাত্র ঐক্য” নামের ব্যানারে সন্ত্রাস-সংঘর্ষের প্রতিবাদে মিছিলে নামে। মিছিল থেকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিল শিক্ষার্থীরা। তখনও দু’পক্ষের মধ্যে গুলি বিনিময় চলছিল।

মঈন হোসেন রাজু মিছিলের সামনের সারি থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কারন সে সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের স্বপ্ন দেখতেন। রাজুসহ মিছিলকারীরা জানতেন সন্ত্রাসীদের গুলিতে যে কারো প্রাণ যেতে পারে, তাও তারা পিছপা হন নি। প্রিয় ক্যাম্পাস সন্ত্রাসীদের হাতে তুলে না দেয়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রতিবাদী মিছিল সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে  মিছিলে আছড়ে পড়ে সন্ত্রাসীদের ছোঁড়া গুলি। সন্ত্রাসী গুলির একটি রাজুর মাথা ভেদ করে চলে যায়। পরে ঢাকা মেডিকেললে নিয়েও বাঁচানো যায়নি রাজুকে। রাজু চলে যান সন্ত্রাসমুক্ত ক্যাম্পাসের স্বপ্ন অন্য সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে।

এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দখলদারিত্ব আর ক্ষমতা প্রদর্শনের রাজনীতি। ১৩ই মার্চ সকালে মত বিরোধের কারণে ছাত্র শিবির কর্মীকে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা মারধোর করে।  ক্যাম্পাসে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। দুপুর না গড়াতেই সাধারন ছাত্রদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাধে পুলিশের। এ সময় মঈন হোসেন রাজু কনুইয়ে ব্যথা পেয়ে নিজ হলে( শহীদুল্লাহ হল) ফিরে যান।

মঈন হোসেন রাজু পড়াশোনাতে যেমন মেধাবী ছিলেন তেমনি যেকোন অন্যায়ের বিরুদ্ধেও ছিলেন প্রতিবাদী। ১৯৬৮ সালে ২৯শে জুলাই বরিশালে জন্ম তার। ১৯৮৭ সালে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে, মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন, কেন্দ্রীয় সংসদের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সমাজকল্যাণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন।

পরে শহীদ মঈন হোসেন রাজুর আত্মত্যাগের স্মরনে এবং সন্ত্রাসবিরোধী চেতনা ধরে রাখার দৃঢ় প্রত্যয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল ক্যাম্পাসে নির্মান করা হয় “সন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য।” ১৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ তারিখে এটির উদ্বোধন করেন সেসময়ের উপাচার্য এ. কে. আজাদ চৌধুরী।

কিন্তু দীর্ঘ ২৯ বছর পরও কি রাজুর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে? প্রশ্ন থেকেই যায়। কারন প্রতিনিয়তই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ দেশের সর্বত্র চলছে রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাস। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সৃষ্টি হচ্ছে অরাজকীয় পরিবেশ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বানিজ্য থেকে শুরু করে প্রায় সকল ক্ষেত্রেই চলছে অনিয়ম। অন্যদিকে চলছে ক্ষমতার অপরাজনীতি। কেউ মুখ ফুটে ঘটে যাওয়া অনিয়মের কথা উচ্চারন করলেই তার উপর চড়াও হচ্ছে রাষ্ট্র ও সরকারসংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীরা। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রায় সকল ক্ষেত্রেই ঘটে যাচ্ছে নানা ধরনের অনিয়ম।

সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছেন না সাংবাদিকরাও। এসব যেন এখন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সেই ৯৭ সাল থেকে বাংলাদশ ছাত্র ইউনিয়নসহ অন্যান্য প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ ১৩ই মার্চকে “সন্ত্রাস বিরোধী রাজু দিবস” হিসেবে পালন করছে। তারই অংশ হিসেবে এ বছরও নেত্রকোনা সহ সারাদেশেই দিনটি উদযাপন করবে ছাত্র ইউনিয়নসহ প্রগতিশীল সংগঠনসমূহ।

লেখক: অনন্ত সরকার, নিজস্ব প্রতিনিধি, সংবাদ সারাবেলা

সংবাদ সারাদিন