কুমিল্লায় সাবার হচ্ছে কৃষিজমির টপসয়েল

ফসলি জমি কেটে ইটভাটায় মাটি সরবরাহ করছে রাজনৈতিক অরাজনৈতিক নির্বিশেষে এলাকার প্রভাবশালীরা। জমির মালিকরা কেউ লাভের আশায় আবার কেউবা বাধ্য হয়েই এই টপসয়েল বিক্রি করছে।

মাটিখেকোদের দুর্বৃত্তায়নে মাঠ হচ্ছে জলাশয় পকেট ভরছে প্রভাবশালীদের

|| সারাবেলা প্রতিনিধি, কুমিল্লা ||

কোন ধরণের নিয়ম নীতির তোয়াক্কা না করে দেদার বিক্রি হচ্ছে কুমিল্লা অঞ্চলের জমির উপরিভাগের মাটি। এসব মাটির বেশীর ভাগই যাচ্ছে বৈধ অবৈধ সব ইটভাটাতে। কোথাও এসেকেভেটর আবার কোথাও বা কোদাল দিয়ে কেটে নেয়া হচ্ছে এসব ফসলী জমির টপসয়েল বা উপরিভাগের উর্বর সব মাটি। এতে কৃষিজমিগুলো পরিণত হচ্ছে অগভীর খানাখন্দে। এভাবে ভুমিরুপান্তরে ভারসাম্য হারাচ্ছে প্রতিবেশ পরিবেশ। অন্যদিকে পকেট ভরছে প্রভাবশালীদের। অভিযোগ করেও মিলছে না প্রতিকার।

জেলার চান্দিনা, দেবিদ্বার, নাঙ্গলকোট ও মুরাদনগর উপজেলায় বিধ্বংসি এমন তৎপরতা সবথেকে বেশী লক্ষ্য করা যাচ্ছে। চান্দিনার পানিপাড়া, মাইজখার, বদরপুর, মহিচাইল ইউনিয়নের খাটিগড়া, মাধাইয়া ইউনিয়নের কাশিমপুর, মুরাদপুর, সুহিলপুর ইউনিয়নের সাতগাঁওসহ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ফসলি জমি থেকে প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত অবধি চলছে মাটি কেটে নেয়ার এই মচ্ছব।

চান্দিনার পানিপাড়া গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানান, শুধু দিনেই নয়, রাতেও চলছে মাটি কাটা। আমাদের এলাকার ২টি ইটভাটায় মাটির জোগান দিতে টপসয়েল কেটে নেয়ার পর করা হচ্ছে মাছের খামার। এতে শুধু কৃষিজমিই যে কমছে তা নয়, ছোট বড় ট্রাকে করে এসব মাটি পরিবহণ করতে গিয়ে ছড়াচ্ছে ধুলা। রাস্তাঘাটে চলাই যেনো দায় হয়ে পড়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পানিপাড়া গ্রামের এক বাসিন্দা জানান, ফসলি জমি কেটে ইটভাটায় মাটি সরবরাহ করছে রাজনৈতিক অরাজনৈতিক নির্বিশেষে এলাকার প্রভাবশালীরা। জমির মালিকরা কেউ লাভের আশায় আবার কেউবা বাধ্য হয়েই এই টপসয়েল বিক্রি করছে।

ক্ষুব্ধ কন্ঠে স্থানীয় এই মানুষটি বলেন, ফসলি জমির মাটি বিক্রি করে মালিকপক্ষ লাভবান হচ্ছে, ইটভাটায় মাটি নিয়ে মালিকরা মুনাফা করছে। আর নষ্ট রাস্তা-ঘাট আবারো মেরামত করতে হচ্ছে রাষ্ট্রের অর্থে।

উপজেলা কৃষি অফিসে পাওয়া গেলো সাত বছর আগের তথ্য বলছে, চান্দিনা উপজেলার ১৯ হাজার ৮০৪ হেক্টর জমির মধ্যে আবাদি জমির পরিমান ১৩ হাজার ৯৭০ হেক্টর।

স্থানীয় সচেতন মহল জানান, গত ৭ বছরে প্রায় এই চৌদ্দ হাজার হেক্টর জমির মধ্যে অন্তত ৩ হাজর হেক্টর জমির টপসয়েল কেটে নেয়ায় জলাখন্দে পরিণত হয়েছে এগুলো।

চান্দিনা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম সুমন জানান, ফসলি জমি থেকে এভাবে মাটি কাটার বিষয়টি নিয়ে সরকারি বিভিন্ন দফতরে অনেক অভিযোগ করেছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না।

এ ব্যাপারে চান্দিনা উপজেলা কৃষি অফিসার আফরিনা আক্তার জানান, সম্প্রতি আমরা জানতে পেরেছি, ফসলি জমির মাটি কেটে ইটভাটায় নেওয়া হচ্ছে। যা আমি উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে জানিয়েছি।

চান্দিনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) বিভীষণ কান্তি দাশ জানান, এসব বিষয়ে আমরা নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করি। তবে উপজেলা কৃষি অফিস এখনো আমাকে কোন তথ্যই জানায়নি। শিগগিরই আমি যথাযথ ব্যবস্থা নেবো।

চান্দিনার মতো মুরাদনগর উপজেলারও একই অবস্থা। এখানকার ইটভাটারও মাটির যোগান আসছে টপসয়েল থেকে। এই মাটির যোগান দিতে নীতিমালার তোয়াক্কা না করেই রামচন্দ্রপুর উত্তর ইউনিয়নের তেমুরিয়া, চাপিতলা, আমিনগর, বিষ্ণপুর, ও বলিঘরসহ অন্য ইউনিয়নের মাঠের ফসলি জমি কেটে নেয়া হচ্ছে ইটভাটায়।

ক্ষতিগ্রস্ত ও জমির মালিকরা বলছেন, ভাটার মালিকরা কৃষকের দারিদ্রের সুযোগ নিয়ে নামমাত্র দামে জমি কিনে প্রথমে মাটির ওপরের অংশ কেটে নেয়। পরে ড্রেজার বসিয়ে গভীর গর্ত করে বালি বিক্রি করেন। ড্রেজারের টানে পাশের জমির যখন ভাঙন শুরু হয় তখন ওই জমির মালিক মাটিখেকো সিন্ডিকেটের কাছে তার জমিটিও বিক্রি করতে বাধ্য হন। এভাবে ইটভাটার মালিকরা ফসলি জমিগুলোকে একে একে গ্রাস করে নিচ্ছে।

উপজেলার তেমুরিয়া গ্রামের কৃষি জমির মালিক অলিউল্লাহ বলেন, আমার এখানে ৩৫ শতক জমি আছে। পাশের জমিটি যেভাবে কাটছে তাতে আমার জমিটিও একদিন বিলীন হয়ে যাবে। আমি এই কৃষি জমি রক্ষায় প্রশাসনের সাহায্য চাইছি।

স্থানীয় সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে একসময় দেশে আর কৃষিজমি খুঁজে পাওয়া যাবে না। অদূর ভবিষ্যতে দেশে খাদ্যসংকট দেখা দেবে।

এ বিষয়ে মুরাদনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাইনউদ্দিন আহম্মেদ বলেন, একবার কোন জমির টপসয়েল নিয়ে গেলে ওই জমিতে আগামী ১৫-২০ বছর ফসল হবে না। বিষয়টি আমরা রাষ্ট্রিয়পর্যায়েই উদ্বিগ্ন। কৃষিজমিগুলো রক্ষায় সমন্বয় কমিটির মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। এভাবে চলতে থাকলে আবাদি জমিগুলো অনাবাদি হয়ে পড়বে এবং কৃষিতে উৎপাদন কমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে খাদ্যসংকট দেখা দিতে পারে।

মুরাদনগর উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (ভূমি) সাইফুল ইসলাম কমল বলেন, আবাদি জমি কেটে শ্রেণি পরিবর্তন করার আইনগত কোন বিধান নাই, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে কাউকে কোন ছাড় দেওয়া হবে না।

উপজেলা নির্বাহী অফিসার অভিষেক দাশ বলেন, নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমাদের অভিযান চলছে।   

সংবাদ সারাদিন