কওমিই ভাঙলো ভাস্কর্য

কুষ্টিয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙেছে স্থানীয় কওমী মাদ্রাসার দুই শিক্ষক ও দুই শিক্ষার্থি। শুক্রবার গভীররাতে শিক্ষকরা পাহারায় থেকে ছাত্র দ্ইুজনকে দিয়ে ভাস্কর্য ভাঙান। ভাস্কর্য ভাঙার দুইদিনের মাথায় গতকাল রোববার দুপুরে প্রেস ব্রিফিং করে এসব তথ্য জানায় কুষ্টিয়া পুলিশ।

|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||

কুষ্টিয়ায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভেঙেছে স্থানীয় কওমী মাদ্রাসার দুই শিক্ষক ও দুই শিক্ষার্থি। শুক্রবার গভীররাতে শিক্ষকরা পাহারায় থেকে ছাত্র দ্ইুজনকে দিয়ে ভাস্কর্য ভাঙান। বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন এই ভাস্কর্য ভাঙায় জড়িত অভিযোগে চার জনকে আটক করা হয়েছে। ভাস্কর্য ভাঙার দুইদিনের মাথায় গতকাল রোববার দুপুরে প্রেস ব্রিফিং করে এসব তথ্য জানায় কুষ্টিয়া পুলিশ। এরইমধ্যে শনিবার সন্ধ্যাতেও ভাস্কর্য নির্মাণস্থলে নম্বরবিহীন মাইক্রোতে আসা কয়েক যুবক দুই রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোঁড়ে এবং ভাস্কর্যটি কালো কাপড়ে মুড়ে দিয়ে যায়। এদিকে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে শনিবার থেকে কুষ্টিয়াতো বটেই রাজধানীসহ সারাদেশে উগ্রপন্থী মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ শক্তির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ অবস্থান নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগি সংগঠনসমূহ এবং দেশের অন্যান্য প্রগতিশীল দল ও সংগঠন। সংক্ষুব্ধ প্রকাশ জানাচ্ছে সাধারণ মানুষও। ঘটনার বিস্তারিত জানতে ৩ সদস্যের কমিটি করেছে স্থানীয় জেলা প্রশাসন।

এদিকে রোববার বিকেলে কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন সিসিটিভি ফুটেজের তথ্যাদিসহ পুলিশী তৎপরতার সবশেষ তথ্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গ্রেফতার চারজন হলেন-মাদ্রাসাছাত্র আবু বক্কর মিঠন (১৯), সবুজ ইসলাম নাহিদ (২০) এবং মাদরাসা ইবনি মাসউদ (রা.)-এর শিক্ষক আল আমিন ও ইউসুফ আলী। এসময় অতিরিক্ত ডিআইজি কে এম নাহিদুল ইসলাম, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এস এম তানভির আরাফাতসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

ছবি : সংবাদ সারাবেলা

ডিআইজি ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, মাদ্রাসাছাত্র আবু বক্কর মিঠন ও সবুজ ইসলাম নাহিদ তাদের মাদ্রাসা থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার পথ হেঁটে এসে ভাস্কর্য ভাঙচুর করে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায় সাদা পাঞ্জাবী, পাজামা ও কালো কোট পরা ওই দুই ছাত্র মই বেয়ে ভাস্কর্যের বেদিতে ওঠে। পরে একজনের ব্যাগ থেকে হাতুড়ি বের করে ভাস্কর্যে ভাঙচুর চালায়। মিশন শেষ করে তারা একইভাবে হেঁটে মাদ্রাসায় ফিরে বিষয়টি দুই শিক্ষককে জানায়। যাদেরকে ইতোমধ্যেই গ্রেফতার করা হয়েছে। এ সময় শিক্ষকরা ওই ছাত্রদের মাদ্রাসায় না থেকে বাড়ি চলে যেতে বলেন।

গ্রেফতার হওয়া ৪ জনের বিরুদ্ধে পুলিশ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেছে জানান ডিআইজি ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘ওই মাদ্রাসা থেকে হাতুড়ি উদ্ধার করা হয়েছে, যাতে সাদা রঙ লেগেছিল।’

এর আগে রাজধানীতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানান, কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় এখন পর্যন্ত চারজনকে আটক করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আটক চারজনের দুইজন জড়িত ছিল এবং তাদের কথামতো আরও দুজনকে আটক করা হয়েছে। দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তৎপর রয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, ভাস্কর্য ভাঙচুরের ঘটনায় তদন্ত চলছে। তদন্তে যাদের নাম বেরিয়ে আসবে, তাদের নামেই মামলা হবে।। গতকাল রোববার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এসময়ে বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মুসলিম সভ্যতার যুগে, আলবেরুনি বলেন, ইবনে বতুতা বলেন, তাদের ভাস্কর্য বিভিন্ন জায়গায় শোভা পাচ্ছে। সেগুলে তো কেউ ভাঙছে না। আমরা বলছি, ভাস্কর্য মানেই পূজা নয়; ভাস্কর্য মানে হচ্ছে খ্যাতিমান মানুষদেরকে সম্মান দিয়ে তাদেরকে ধরে রাখা। তাদের যে অবদান দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, সেটাকে হৃদয় দিয়ে ধারণ করা।

আসাদুজ্জামান খান বলেন, অনেক ইসলামিক দেশে মুদ্রার মধ্যে বাদশাহদের ছবি রয়েছে। সৌদির বাদশাহর ছবি রয়েছে, পাকিস্তানের কায়েদে আজমের ছবি রয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধানের ছবি রয়েছে। সেটা পকেটে নিয়ে আমরা ঘুরছি। অথচ একটি ভাস্কর্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম সাক্ষী হয়ে থাকবে, সেটা আমরা ধ্বংস করতে চাইছি। দেশের বিভিন্ন স্থানে স্থাপিত ভাস্কর্যের নিরাপত্তা নিয়ে সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, সব ভাস্কর্যের নিরাপত্তার বিষটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে।
প্রসঙ্গত গেলো শুক্রবার মধ্যরাতে কুষ্টিয়া শহরের পাঁচ রাস্তার মোড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়। ভাস্কর্য ভাঙচুরের একটি ভিডিও ফুটেজ ভাইরাল হয়। সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ঘড়িতে তখন রাত ২টা ১৬ মিনিট। দু’জনই দাঁড়িওয়ালা। টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবি পরা দুইজনের মধ্যে একজনের পিঠে হ্যাভারস্যাক শহরের যে সড়কটি মজমপুর গেট হয়ে পাঁচ রাস্তার মোড়ে এসে মিশেছে সেখানে এসে যুবক দুইজন বাঁশ বেয়ে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে উঠে এলোপাথাড়ি আঘাত করে ভাস্কর্যটির মুখ ও হাত ভেঙে ফেলে। ভাঙার কাজ শেষ করে তারা নির্বিঘ্নে ঘটনাস্থল ছেড়ে যায়।

স্থানীয়রা জানান, পাঁচ রাস্তার মোড় এলাকায় একটি ব্যাংক, অপর একটি ব্যাংকের ফার্স্ট ট্র্যাক বুথসহ রাস্তায় সিসি টিভি ক্যামেরা স্থাপন করা আছে। ওইসব সিসি টিভি ক্যামেরার ফুটেজ পুলিশ সংগ্রহ করে হামলাকারী দুজনকে শনাক্ত করে। গতকাল রোববার সকালেই মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে জড়িত চারজনকে আটক করা হয়। এরা হলেন শিক্ষক আল আমিন হোসেন ও ইউসুফ আলী এবং শিক্ষার্থি আবু বকর ও আবু নাহিদ।

কুষ্টিয়াতে বিক্ষোভ 
বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙচুরের প্রতিবাদে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে গতকাল রোববার বিকেল ৩টায় জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয় । সভায় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও কুষ্টিয়া সদও (৩) আসনের সংসদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

ছবি : সংবাদ সারাবেলা

অন্যদিকে রোববার ৬ই ডিসেম্বর সকালে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির বিশেষ সভায় আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ভাস্কর্য নিয়ে কোনো অপব্যাখা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আলেম-উলামা মাশায়েখের নাম দিয়ে কিছু লোক মাঠ উত্তপ্ত করছে দাবি করে হানিফ বলেন, যারা ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে তারাই বঙ্গবন্ধুর এই ভাস্কর্য ভেঙেছে।

হানিফ বলেন, আমরা দেখেছি আমাদের দেশে সকল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আমাদের বসবাস করছে। একদিকে মাগরিবের আজান হচ্ছে আবার অন্যদিকে শাখা বাজিয়ে প্রদ্বীপ জ্বালিয়ে হিন্দু ধর্মালম্বীরা তাদের রীতিনীতি অনুযায়ী পূজা অর্চনা করতেন।
ইসলামে উগ্রবাদের স্থান নেই উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, তাদের কথার সঙ্গে ইসলামের কোনো মিল নেই। কিন্তু আলেমদের নাম করে যারা উগ্রবাদের কথা বলছে সেটা ইসলাম বলে না। ইসলাম শান্তির কথা বলে।
সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া ও পতাকা উত্তোলন করতে এবং তাদের মনিটরিং করতে কুষ্টিয়ার মাদরাসা সুপারসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে কঠোরভাবে জেলা প্রশাসনকে নির্দেশ দেন। এদেশ আমাদের সকলের। তবে রাজনীতির কারণে সমাজে বিভেদ আছে। আমরা ভবিষ্যত প্রজন্মকে ভালো কিছু উপহার দিতে চাই। এজন্য সকল বিভেদ ভুলে সুন্দর ও সুখী সমাজ গড়তে সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে বলেও জানান তিনি।

ছবি : সংবাদ সারাবেলা

জেলা প্রশাসক মো. আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে এসময় কুষ্টিয়া-৪ আসনের সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার এসএম তানভীর আরাফাত, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ্ব সদর উদ্দিন খান, সাধারণ সম্পাদক আজগর আলী, সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আতাউর রহমান আতা, শহর আওয়ামী লীগের সভাপতি তাইজাল আলী খান, প্যানেল মেয়র মতিয়ার রহমান মজুনসহ সকল সরকারি দফতরের প্রধান, জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও সুধীজন।

সভায় কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার (এসপি) এসএম তানভীর আরাফাত বলেন, বঙ্গবন্ধু, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ। তিনটি শব্দই এক। বঙ্গবন্ধুর হাত মানে দেশের ১৭ কোটি মানুষের হাত। কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধু ভাস্কর্যে হামলা চালিয়ে যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়েছে তারা বাংলাদেশকে ভালো চায় না। ঘটনার পর আমরা পুলিশের পক্ষ থেকে আমাদের বেশ কিছু টিম আলাদা আলাদা ভাগে ভাগ করে কাজ করছি। আমরা শীঘ্রই ভালো কিছু জানাতে পারবো।

কুষ্টিয়া প্রেসক্লাব (কেপিসি) সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব বলেন, পৌরসভা কর্তৃপক্ষ যে এই ভাস্কর্য স্থাপন করছে তা প্রশাসন কিংবা জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়নি। অবশ্যই এটি জেলা প্রশাসনকে জানানো দরকার।

উল্লেখ্য, শুক্রবার রাতে ভাস্কর্যটির কিছু অংশ ভেঙ্গে দেয় দুর্বৃত্তরা। পরে সকালে নির্মাণ শ্রমিকরা কাজে গিয়ে তা দেখতে পান। ১৩ই নভেম্বর কুষ্টিয়া পৌরসভার অর্থায়নে শুরু হয় ভাস্কর্য নির্মাণ, এর কাজ শেষ পর্যায়ে ছিল। ১৬ই ডিসেম্বর বিজয়ের দিনে এটি উদ্বোধনের কথা ছিল।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

সংবাদ সারাদিন