।। সারাবেলা প্রতিবেদন ।।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে বিদায় নিয়েছেন স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী। ৮৪ বছর বয়সে আজ মারা গেছেন মুক্তিযুদ্ধকালীন ৮ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার । রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতাসহ সারাদেশ শোক প্রকাশ করছে এই বীরের বিদায়ে।
শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় আবু ওসমান চৌধুরী মারা যান। তার ব্যক্তিগত সহকারী আবুল বাশার গণমাধ্যমে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, আবু ওসমান চৌধুরী দীর্ঘদিন ধরেই বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় ভুগছিলেন। স্মৃতিশক্তিও ক্রমে লোপ পাচ্ছিল তার। এক সপ্তাহ আগে অসুস্থ অবস্থায় তাকে সিএমএইচে ভর্তি করা হয়। সেখানে পরীক্ষার পর তার নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিশ্চিত হওয়া গিয়েছিল। এর মধ্যে তার ব্রেন টিউমারও ধরা পড়ে।
সেক্টর কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরীর মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও বিরোধীদরীয় নেতা রওশন এরশাদ। রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ বলেন মহান মুক্তিযুদ্ধে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব:) আবু ওসমান চৌধুরীর অবদান জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে। রাষ্ট্রপতি এক শোকবার্তায় মরহুম আবু ওসমান চৌধুরীর রুহের মাগফিরাত কামনা করেন ও তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার মদনেরগাঁও গ্রামে জন্ম হয় আবু ওসমান চৌধুরীর। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে বিএ পাস করার পর ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান। ১৯৬৮ সালের এপ্রিল মাসে তিনি পদোন্নতি পেয়ে মেজর হন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.)আবু ওসমান চৌধুরী পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন মেজর হিসেবে কুষ্টিয়ায় কর্মরত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৬ মার্চ আবু ওসমান চৌধুরী পদ্মা মেঘনার ওপারে কুষ্টিয়া থেকে বরিশাল জেলা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাকে দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গণ নামকরণ করে সেই রণাঙ্গণের অধিনায়কত্ব গ্রহণ করেন।
অপারেশন সার্চলাইট-এর সংবাদ পেয়ে ২৬ মার্চ সকালে বেলা ১১টায় তিনি চুয়াডাঙার ঘাঁটিতে পৌঁছে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। পরে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার তাকে দক্ষিণ পশ্চিমাংশের আঞ্চলিক কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত করে। মে মাসের শেষ দিকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এম এ জি ওসমানী দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনকে দুই ভাগ করে ৮ নম্বর ও ৯ নম্বর সেক্টরদ্বয় গঠন করেন। এই সময় ৮ নম্বর সেক্টরের দায়িত্বে আবু ওসমানকে নিয়োগ করা হয়।
প্রাথমিকভাবে আট নম্বর সেক্টরের অপারেশন এলাকা ছিল কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর ও পটুয়াখালী জেলা। মে মাসের শেষে অপারেশন এলাকা সংকুচিত করে কুষ্টিয়া ও যশোর, খুলনা জেলা সদর, সাতক্ষীরা মহকুমা এবং ফরিদপুরের উত্তরাংশ নিয়ে এই এলাকা পুনর্গঠন করা হয়। এই সেক্টরের প্রধান ছিলেন আবু ওসমান চৌধুরী এবং পরে মেজর এম এ মঞ্জুর।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আবু ওসমান চৌধুরীকে লেফটেনেন্ট কর্নেল হিসেবে পদোন্নতি দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তাকে আর্মি সার্ভিস কোরের (এএসসি) পরিচালকের দায়িত্ব দেন।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সেনা অভ্যুত্থানের সময় একদল সেনাসদস্য আবু ওসমান চৌধুরীকে হত্যার জন্য তার গুলশানের বাড়িতে হামলা করে। বাড়িতে না থাকায় তিনি সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও নিহত হন তার স্ত্রী নাজিয়া খানম।
পরবর্তী সময়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন আবু ওসমান চৌধুরী। তিনি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যানের পদেও ছিলেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে আবু ওসমান চৌধুরীকে বিজেএমসির চেয়ারম্যান করা হয়। পরে তাকে চাঁদপুর জেলা পরিষদের প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাধীনতাযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ২০১৪ সালে আবু ওসমান চৌধুরীকে স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করে সরকার।