|| সারাবেলা প্রতিবেদন ||
দল ও জোটে নানামূখি সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাতী দল (বিএনপি)। বর্তমান পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় যাওয়ার ক্ষেত্রে দলের সুনির্দিষ্ট কোন লক্ষ্য না থাকায় বিএনপির নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে। দুরত্ব বাড়ছে শরীক দলগুলোর সঙ্গেও। নিজ দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে চরম সমন্বয়হীনতা। তৃণমুল নেতাকর্মীদেরকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না-এমন অভিযোগও রয়েছে। এ অবস্থায় দলটির নেতাকর্মীদের নূন্যতম আগ্রহ না থাকার পরও জাতীয় সংসদের উপনির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনে অংশগ্রহণ তারা মানতে পারছে না। নেতাকর্মীরা মনে করেন, এসব নির্বাচনে নিশ্চিত পরাজয় জেনেও হাইকমান্ড কেন অংশ গ্রহনের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে তা আমাদের কাছে বোধগম্য নয়। এ নিয় তাদের কাছে সন্দেহের জন্ম দিচ্ছে। আগ্রহ না থাকলেও শুধু ব্যক্তিগত অবস্থান ধরে রাখতে দলীয় মনোনয়ন নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ‘অনৈতিক’ প্রতিযোগিতায় দলে বিভক্তি থেকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে গিয়েও ঠেকছে। ১০ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় উপজেলা, পৌর ও ইউনিয়ন পরিষদের ২৯টি পদের মধ্যে অনেকে আগ্রহ না দেখাচ্ছেন না। গত ১২ই নভেম্বর ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনের ভোটের দিন রাজধানীতে বাসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ১৪টি মামলা হয়েছে। এতে হতাশায় থাকা দলটি নতুন করে চাপে পড়েছে।
দলটির নেতারা বলছেন, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের হুমকি-ধমকিতে সৃষ্ট ভয়, গ্রেফতার-মামলার শঙ্কা, দলের বিভক্তি ও ভোটের ফল আন্দাজ করে আগ্রহ হারিয়েছেন নেতাকর্মীরা। এ কারণে ভোটের দিন বিএনপি প্রার্থীর প্রতীকের পক্ষে বুথে পোলিং এজেন্টও খুঁজে পাওয়া যায় না। এ অবস্থাতেও নির্বাচনের পক্ষে থাকা নেতাদের যুক্তি হচ্ছে- গণতন্ত্রের পথে থেকে নিরপেক্ষ সরকার ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনের পরিচালনায় জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠায় এ ছাড়া বিএনপির আর কোনো গতি নেই। নির্বাচনী ট্র্যাকে থেকেই আন্দোলনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে হবে। এর আগে নিজ দলকে গুছিয়ে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করবে দলটি। কিন্তু এ লক্ষ্যে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে থাকা দলটির নেতারা বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ফলে দলের নেতাকর্মীদের নামে বাড়ছে মামলার সংখ্যা। এতে বিভক্তির পাশাপাশি নেতাকর্মীরা মনোবল হারাচ্ছেন। দলও সাংগঠনিক শক্তি হারাচ্ছে। নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ তুললেও ন্যূনতম প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না দলটি। বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী থাকার পরও নির্বাচন থেকে বিএনপির অর্জন শুধুই হতাশা।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিপক্ষে ছিলেন দলের বেশিরভাগ নেতাকর্মী। ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে বিএনপির সর্বত্রই সমালোচনা এখনো চলছে। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান (পদত্যাগ করেছেন), মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বরচন্দ্র রায় বিরোধিতাও করেছিলেন। খালেদা জিয়াবিহীন নির্বাচনে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল অংশই নেননি।
বিএনপির একাধিক নেতা জানান, ওই নির্বাচনের আগে ২০-দলীয় জোটকে ‘অবমূল্যায়ন’ করে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে আরেকটি জোট গঠন করা নিয়েও নির্বাচনের আগে সমালোচনা হয়। কিন্তু অনেকেই প্রকাশ্যে তা বলতে পারেননি। কিন্তু খোদ খালেদা জিয়াই গত আগস্টে স্থায়ী কমিটির নেতারা সাক্ষাৎ করতে গেলে ড. কামালের নেতৃত্বে জোট গঠন নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। দলের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতা বলেন, যারা নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে ছিলেন তাদের উদ্দেশ্য তো সরকার গঠন নয়; তাদের উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় সংসদের বিরোধী দলে থাকা। এর পর আস্তে আস্তে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে মাইনাস করা। কিন্তু সরকার তাদের সে আশা পূরণ হতে দেয়নি। যদিও খালেদা জিয়া শারীরিক ও আইনি জটিলতায় মাইনাস হওয়ার অবস্থায়, লন্ডনে অবস্থান করা ও আইনি জটিলতায় মধ্য থাকা তারেক রহমানের অবস্থাও দুর্বল সূতায় বাঁধা। এ অবস্থায় কোনো কোনো মহল থেকে তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান ও তার মেয়ে জাইমা রহমানের নাম উচ্চারণ হচ্ছে। গুঞ্জন রয়েছে, জাইমা রহমানের পাশাপাশি প্রয়াত আরাফাত রহমান কোকোর বড় মেয়ে জাফিয়া রহমান উভয়কেই রাজনীতিতে টেনে আনতে পারেন দাদি খালেদা জিয়া।
২০-দলীয় জোটের একাধিক নেতা বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে পুনর্র্নিবাচন দাবি করার পরও মহাসচিব ছাড়া দলটির নির্বাচিত সব এমপি শপথগ্রহণ ও সংসদে যোগ দেন। এর পর করোনা পরিস্থিতির কারণে দুটি বাদে জাতীয় সংসদের সব উপনির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনেও অংশ নেয় বিএনপি। দলটির ভাইস চেয়ারম্যান ও যুগ্ম মহাসচিব পর্যায়ের দুই নেতা বলেন, বিএনপি কেন নির্বাচনে যায়- এ প্রশ্নের কোনো উত্তর তাদের কাছেও নেই। উত্তর কে দিতে পারবেন তা-ও তারা জানেন না। বরং জাতীয় সংসদের যতগুলো আসনে উপনির্বাচন হয়েছে বগুড়ার একটি আসন ছাড়া সবটিতেই বিশাল ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে বিএনপি। ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচন কেন্দ্র করে বিএনপির ইতিহাসে যা নেই, সেটিও হয়েছে। মহাসচিব বাসায় ডিম ও ইটপাটকেল ছুড়ে মারা হয়েছে। এ আসনে দল এখন কয়েক ধারা-উপধারায় বিভক্ত। ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনে দলের একটি অংশ ধানের শীষের পক্ষে না নেমে বরং আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে নানাভাবে সহযোগিতা করার অভিযোগও আছে।
সম্প্রতি নির্বাচনে অংগ্রহণের মধ্য দিয়ে বিএনপির অর্জন কোথায় জানতে চাইলে যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, নানা নির্যাতন, নিপীড়ন, হামলা মামলা সহ্য করে নির্বাচনে অংশগ্রহণের মধ্যে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি বিএনপি গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের ভোট ছাড়া ক্ষমতা পরিবর্তনের অন্য কোনো উপায় বিএনপির জানা নেই। পরাজয় জেনেও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি এতে করে নেতাকর্মীদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা কাজ করছে বলে অভিযোগ সম্পর্কে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন- থাকতে পারে। দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকলে এরকম অভিযোগ আসতেই পারে। তবে তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনমুখী দল এবং বিএনপি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে।